রুডলফ রকারের এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমঃ তত্ত্ব ও অনুশীলন - অধ্যায়ঃ চতুর্থ- এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের উদ্দেশ্য ( দ্বিতীয় অংশ)
ভাষান্তরঃ এ কে এম শিহাব
প্রচলিত ঘটনা প্রবাহ নিয়ে পিটার ক্রপতকিনের বক্তব্য যথাযথভাবেই প্রমানিত হয়েছে। রাশিয়া এখন দুনিয়ার যে কোন দেশের তুলনায় সমাজবাদ থেকে অনেক দূরে। একনায়কতন্ত্র অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা ও মুক্তি শ্রমজীবী মানুষের জন্য নিশ্চিত করতে পারেনি, বরং মানুষের উপর নিপিড়ন নির্যাতন চেপে বসে, সকল প্রকার উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে, সাধারন মানুষের মর্যাদা ও সম্মান ভুলন্ঠিত হয়। এই শাসন কালে রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেনী তেমন কিছুই অর্জন করতে পারেনি, শোষণ আর ধবংস তাদের জিবনকে করে তুলে দুর্বিসহ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার যাঁতাকল সাধারন মানুষকে দাসের স্তরে নামিয়ে দেয়। স্টেখানভ ব্যবস্থার মত উৎপাদন বৃদ্বির জন্য প্রশাসন মরিয়া হয়ে উঠে। মানুষ তাদের জীবন ও শ্রম দানের উপর সকল প্রকার স্বাধীনতা হারিয়ে বসে। বাধ্যতা মূলক শ্রম দানের জন্য সমাজবাদ মানুষকে বাধ্য করে। এই পরিস্থিতি মানুষকে বিরক্ত করে, তাদের কর্মের সকল আনন্দ তারা হারিয়ে ফেলে, তাদের ব্যাক্তিগত কর্মোদ্যম হারিয়ে যায়, তারা সমাজবাদের কথা ও শুনতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
আমরা এখানে জার্মানীর কথা বলছিনা। একটি পার্টি যেমন সামাজিক গনতন্ত্রী বা তাদের কেন্দ্রীয় কমিটির পরিবর্তে কোন একজন ব্যাক্তি দায়িত্বশীল নয়, যারা ১৯১৮ সালের নভেম্বরে একটি বিপ্লবের জন্য শ্রমিক শ্রেনীর লোকদেরকে সতর্ক করে দিয়েছিলো। সেই সময়ে জার্মান জনগণ বিপ্লবের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলো না, সেটা তারা করেছিলো সমাজবাদের পরিক্ষা নিরিক্ষা করার জন্য। ক্ষমতার উত্থান পতন একদিনে হয় না, এই সম্পর্কে সুনির্দিস্ট করে কেহ তেমন কিছু বলতে ও পারেন না । এটা অবশ্যই একটি ধারাবাহিক কর্মের ফল হিসাবেই দেখা হয়।
স্পেনের এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্ট শ্রমিক ইউনিয়ন সমূহ, বিশেষ করে কাতালুনিয়ায় যেখানে তাদের প্রভাব ছিলো অত্যন্ত প্রবল, তারা সেখানে সমাজবাদি বিপ্লবের জন্য শ্রমিক আন্দোলনের একটি চমৎকার উদাহরন সৃষ্টি করে। তারা সেখানে দেখিয়ে দেয় যে শ্রমিক ইউনিয়নকে অবশ্যই বিপ্লবী ধারায় থাকা চাইঃ সমাজবাদের ধারায় নিজেদেরকে কায়েম মোকাম রেখে নিজেদের স্থান তৈরী করে নিতে হবে ক্রমশ। তার জন্য সমাজবাদি শিক্ষা ও প্রশিক্ষন এবং সরাসরী কাজ করার ধারায় থাকতে হবে। কোন প্রকার রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে নয়। স্পেনে শ্রমিক আন্দোলনের নির্ভরতা কোন রাজনৈতিক দলের উপর ছিলো না।তারা নির্ভর কত ট্রেড ইউনিয়নের উপর।
১৯ শে জুলাই ১৯৩৬ সালে, ফ্যাসিস্ট জেনারেল ফ্রাঙ্কোর ষড়যন্ত্রের ফলে প্রকাশ্য বিদ্রোহের শুত্রপাত হয়। সেই সময়ে সি এন টি বিরোচিত ভাবে তাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলে । এফ এ আই কাতালুনিয়ায় কর্তৃত্ব গ্রহন করায় ষড়যন্ত্র কারীদের মধ্যে হতাশা নেমে আসে। সেই উত্থান বা পদক্ষেপ হঠাত করে গড়ে উঠেনি। এটা পরিস্কার ছিলো যে কাতালুনিয়ার শ্রমিকগন মাঝ পথে থামবেন না। তাই তারা ভূমির যৌথ করন, কারখানা ও শ্রমিকদের কর্মস্থলে সমিতি গড়ে তুলে; সেই আন্দোলনের সামগ্রীক নেতৃত্ব দেয় সি এন টি এবং এফ এ আই। তারা এরাগন, লেভান্ত এবং দেশের অন্যান্য স্থানে মুক্ত এলাকা গঠন করে ইউ জি টি কার্যক্রম জোরদার করে। কিন্তু ফ্যাসিস্ট শক্তির উন্মত্ত তৎপরতা স্পেনের সামাজিক বিপ্লবের বিনষ্ট করে ফেলে।
এই রকমের ঘটনা প্রবাহ বুঝিয়ে দেয় যে, এনার্কো-সিন্ড্যাকালিস্ট শ্রমিকগন স্পেনে কেবল লড়াই সংরামই করবে না, তারা দির্ঘকাল ধরে যে সমাজবাদি শিক্ষা পেয়েছে তা বাস্তবে রূপায়ন করবে। স্পেনের উদারতাবাদি সমাজতন্ত্রীদের জন্য এটা ছিলো একটি ইতিবাচক দিক। সি এন টি এবং এফ এ আই প্রথম ইন্টারন্যাশনারের সময় থেকে যে স্বাধীন চেতনায় সমৃদ্ব হয়েছে তা এখন কাজে লাগাবার বুদ্বিবৃত্তিক বিকাশের মওকা পেয়েছে। স্পেনের স্বাধীকার পন্থী শ্রমিক আন্দোলনকারীগন যে আদর্শ লালন করতে শিখেছেন তাথেকে তারা পিছিয়ে যান নাই, যার বিপরীত চিত্র দেখি জার্মানীতে; তারা বুর্জোয়া পার্লামেন্টের পেছনে গিয়ে নিজেদের শক্তির ক্ষয় করেনি। জনগণের মধ্যে সমাজবাদ নিয়ে এক প্রকার ভয় কাজ করত, তারা তাদের অর্থনৈতিক প্রতিস্টানাদি নিয়ে ও আতঙ্কে ছিলো।
সি এন টি অন্যান্য দেশের শিল্প শ্রমিকদের মত কোন জোট ছিলো না। এটা শ্রমিক কৃষক এবং বুদ্বি বৃত্তিক কর্মী পর্যায়ের লোকদেরকে যুক্ত করে গড়ে উঠে। তাই দেখা যায় কৃষক, শ্রমিক অন্যান্য নগর কেন্দ্রীক কর্মীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্বে লড়াই করছে। আর এটা হলো দির্ঘ সময় ধরে শ্রমিকদেরকে সমাজবাদি শিক্ষা প্রদানের ফল। সমাজবাদের বিভিন্ন দল, সত্যিকার উদারতাবাদি এবং ফ্যাসিবাদ বিরুধী গ্রুপ সকলেই একত্রিত হয়ে কাজ করেছেন, এটা প্রমানিত হয়েছে যে,এই ধরনের উদ্যোগ সি এন টির সৃজনশীলতারই পরিচায় বহন করে । তাদের মধ্যে অনেকে প্রকৃতিক বুদ্বমত্তা, চিন্তাশীলতা, অযৌক্তিকসহনশীলতা ইত্যাদি সি এন টির কাজের ফলে সকল কিছুই মীমাংসিত ও সমন্বিত হয়ে যায়। শ্রমিক , কৃষক, কারিগর, বিজ্ঞানী সকলে মিলে সমবায় গড়ে তুলেন। মাত্র তিন মাসে মধ্যে সামগ্রীক পরিবেশে এক প্রকার ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়। কাতালুনিয়াতে নয়া মানব সমাজের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়।
কাতালোনিয়াতে তিন-চতুর্থাংশের চেয়ে ও বেশী জমি যৌথকরন করা হয় এবং শ্রমিকদের সিন্ডিকেট দ্বারা সমবায়ভাবে চাষ করা হয়। প্রতিটি সম্প্রদায়ের মধ্যে এটি নিজেই একটি ব্যবস্থার উপস্থাপন করে এবং তার নিজস্বভাবে তার অভ্যন্তরীণ বিষয় সমন্বয় সাধন করে, ফেডারেশন হল সংস্থার সংস্থা এর মাধ্যমে তার অর্থনৈতিক নীতি স্থির করা হয়। এইভাবে নতুন ধারণা এবং পারস্পরিক উদ্দীপনা, এবং মুক্ত উদ্যোগের সম্ভাবনা সংরক্ষিত করা হয়। দেশের এক-চতুর্থাংশ জমি ছোট কৃষক মালিকদের হাতে থাকে, যাদেরকে যৌথভাবে গড়ে উঠা খামারে যোগদান বা তাদের পারিবারিক পশুপালন অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে মুক্ত পছন্দের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদের ছোট হোল্ডিংসগুলি্র সঙ্খ্যা তাদের পরিবারের আকারের অনুপাতেও বৃদ্ধি পেয়েছে। আরাগানে সমষ্টিগত চাষের জন্য ঘোষিত কৃষকদের একটি অতি চমৎকার ব্যবস্থা । চার শত সমষ্টিগত খামারের মধ্যে যে সকল খামার এই প্রদেশে রয়েছে, যার মধ্যে দশটি সমাজতান্ত্রিক ইউ জি টি নিয়ন্ত্রণাধীন, বাকি সবগুলি সি.এন.টি. এর সিন্ডিকেট দ্বারা পরিচালিত হয়। কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। মাত্র এক বছরে চাষের আওতায় ফেলে রাখা ভূমির ৪০% জমি চাষের আওতায় আনা হয়েছে। লেভান্তে, আন্দালুসিয়া এবং ক্যাসিটালে, এছাড়াও, সিন্ডিকেট পরিচালনার অধীনে সমষ্টিগত কৃষি ক্রমবর্ধমান উন্নত অগ্রগতি অর্জন করছে। অনেক ছোটো সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সমাজতান্ত্রিক জীবনধারা ইতোমধ্যেই প্রকৃতিগত ভাবে গড়ে উঠেছে, বাসিন্দারা এখন অর্থের বিনিময়ে কিছু করা বা বহন করে না, বরং তাদের যৌথ শিল্পের পণ্যগুলি থেকে তাদের নিজেদের চাহিদা পূরণ করে এবং সম্মিলিতভাবে তাদের কমরেডদের সামনে দিকে জীবন যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে।
বেশীরভাগ গ্রামীণ সমিতির কর্মীদের ব্যক্তিগত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়েছে এবং যুদ্ধের অবসান না হওয়া পর্যন্ত নতুন ব্যবস্থার আরও উত্সাহিত করা হয়েছে, যা বর্তমানে জনগণের সার্বভৌমত্ব দাবি করে। এই মজুরির পরিমাণ পরিবারের আকার দ্বারা নির্ধারিত হয়। সি এন টি এর দৈনিক বুলেটিনগুলির অর্থনৈতিক রিপোর্টগুলি ছিলো খুবই আকর্ষনীয় নয়া মেশিন ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করার মাধ্যমে সমষ্টিগত এবং তাদের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের হিসাবগুলি সাথে সাথে জনগণকে জানিয়ে দিত। যা আগে প্রায় সকলেরই অজানা ছিল। কেবল কাস্টাইলে সমষ্টিগত কৃষি কাজে গত বছরের তুলনায় এইবার আরো দুই মিলিয়ন প্যাসেট ব্যয় করা হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের ইউ.জি.টি. গঠনের পর জমির সমৃদ্ধ করার অ যৌথকরনের বিশাল কাজটি অনেক সহজ হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে সাধারণ আন্দোলনে যোগদান অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যে সমস্ত বিষয় সি.এন.টি. প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হয়। সিএন টি এবং ইউ জি টি এই দুই সংগঠনের একটি সমবায়করণ সহজতর করে দেয় যা দুই প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদেরকে একটি জোটে পরিনত করে।
কিন্তু শ্রমিকদের সিন্ডিকেটগুলি শিল্পের ক্ষেত্রে তাদের অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জন করেছে, যেহেতু তারা নিজের হাতে শিল্পের পরিচালনার জন্য প্রশাসনকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করেছে। কাতালোনিয়াতে এক বছরের মধ্যে রেলপথ একটি সম্পূর্ণ আধুনিক সরঞ্জামের সাথে যুক্ত ছিলযাতায়াত ব্যবস্থায় পরিনত হয়, এবং সময়সীমায় এই পরিষেবাটি এমন একটি বিন্দুতে পৌঁছেছিল যেটি এখন পর্যন্ত একটি রেকর্ড। একই অগ্রগতি ঘটেছিলো সমগ্র টেক্সটাইল শিল্পে, মেশিন নির্মাণে, বিল্ডিংয়ে এবং ছোট শিল্পগুলিতে, সমগ্র পরিবহন ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করা হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে সিন্ডিকেটগুলি একটি বিস্ময়কর কাজ করেছে। তথাকথিত নিরপেক্ষ চুক্তির কারনে স্প্যানিশ সরকার বিদেশ থেকে কোনও প্রকার যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে অস্ত্র আমদানি করতে পারছিলোনা তা একটি বাধা হয়ে ওঠে। কিন্তু ফ্যাসিস্ট বিদ্রোহের আগে কাতালোনিয়ায় সেনা সরঞ্জাম নির্মাণের জন্য একটি কারখানা ও ছিলো না । অতএব, প্রথম উদ্বেগ ছিল, যুদ্ধের চাহিদা পূরণের জন্য অস্ত্র শিল্পের কারখানা পুনর্নির্মাণ করা। সিন্ডিকেটের জন্য এই ধহরনের একটি কাজ করা খুবই কঠিন ছিল, ওন্যদিকে ইতিমধ্যে তাদের হাতে একটি নতুন সামাজিক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মত কঠিন দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিলো। কিন্তু তারা কাজটি অত্যন্ত উৎসাহ উদ্দীপনা এবং কারিগরি দক্ষতা ব্যবহার করে সম্পাদন করেছেন যা কেবলমাত্র শ্রমিকদের দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় এবং তাদের এই কাজের জন্যই অসংখ্য মৃত্যু ঠেকানো গেছে। শ্রমিকগন কারখানাগুলিতে বারো এবং চৌদ্দ ঘন্টা পর্যন্ত প্রতিদিন কাজ করেছেন। কাতালোনিয়া এখন প্রায় ২৮৩টি অস্ত্র নির্মান কারখানা আছে । যা যুদ্ধের উপকরণ তৈরিতে দিন ও রাতের কাজ করে, যা সিমান্ত এলাকায় সরবরাহ করা যায়। বর্তমানে কাতালোনিয়া সমস্ত যুদ্ধের চাহিদার বৃহত্তর অংশ সরবরাহ করছে। অধ্যাপক আন্দ্রে ওলটমারস একটি নিবন্ধের মাধ্যমে ঘোষণা করেছেন যে এই ক্ষেত্রে কাতালোনিয়ার শ্রমিকদের সিন্ডিকেট "বিশ্বযুদ্ধের প্রাদুর্ভাবের পরে চৌদ্দ মাসে ফ্রান্সে যতটা লাভবান হয়েছে এই ক্ষেত্রে সাত সপ্তাহের মধ্যেই এটি সম্পন্ন হয়েছে"।
এটা সত্য যে একটি কেবল চুক্তি দ্বারা সব কিছু করা সম্ভব হয় না। দুর্ভাগ্যজনক হলে সত্য যে, যুদ্ধ স্পেনের সমস্ত যুদ্ধবিমুখ প্রতিটি জেলখানার ভেতর যুদ্ব একটি প্রচন্ড ঝাঁকুনি দেয় যা তাদেরকে কাতালোনিয়াতে যুদ্বের মাঠে নিয়ে আসে; তাদের সংখ্যা এক মিলিয়নের বেশী কাতালোনিয়ার হাসপাতালের অসুস্থ এবং আহতদের প্রায় ৫০ শতাংশ ক্যাটালোনিয়ার লোক নয়। অতএব, এই সকল কাজের চাহিদার প্রেক্ষিতে শ্রমিকদের সিন্ডিকেট যথাযত ভাবে সম্পাদন করেছে । সি.এন.টি. এর শিক্ষকদের দ্বারা সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন, শিল্পকর্মের সুরক্ষার জন্য সমিতি নিজ দায়িত্বে শত শত কাজ করেছেন। যার অন্যান্য বিষয়ে উল্লেখ করা নিস্প্রয়োজন।
সেই যুদ্বকালিন সময়ে সি এন টি ১২০,০০০ মিলিশিয়া গড়ে তুলে, যারা যুদ্ব ক্ষেত্রের নানা ফ্রন্টে লড়াই করছিলেন। এই এই রকমের যানবাজ কর্মী বাহিনী এর আগে আর কোন সংগঠন তৈরী করতে পারে নাই। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্বে সি এন টি-এফ এ আই যে বিরত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে যার জন্য ফ্রান্সিস্কু এস্কো এবং বিউনাভেন্টুরা ডরুতী তাদের জাতি স্প্যানিশদের নিকট বীর হিসাবে চিরস্মরনীয় হয়ে আছেন।
এই পরিস্থিতিতে এটা বুঝা যাচ্ছিলো যে, সিন্ডিক্যাট গুলো সামাজিক পুনর্গঠনের কাজ সমূহ সঠিক ভাবে সম্পাদন করতে পারছিলো না, এবং নিজেদের সংগঠনকে মজবুত করার জন্য যথাযথ ভাবে মনোযোগ দিতে পারছিলো না। যুদ্বের প্রয়োজনীয় উপকরন, সরঞ্জামাদি ফ্যাসিস্ট বাহিনী জার্মান, ইতালীর দখলে ছিলো। পুঁজিবাদ সম্পূর্ন বৈরী আচরন করে প্রতিবিপ্লবে সহায়তা করেছে, অন্যদিকে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সাথে স্পেনের কমিউনিস্ট পার্টির সখ্যতা ছিলো খুবই গভীর ফলে এরা ও প্রতিবিপ্লবের পক্ষে কাজ করে। ফলে সিন্ডিক্যাট সমূহ সঠিক ভাবে নিজেদের কার্যক্রম সম্পাদন করতে পারেনাই। কিন্তু সিন্ডিক্যাট সমূহ কারখানা ও জমি দখলে দিয়ে সমাজবাদের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলো। তারা প্রমান করে দিয়েছিলো যে কোন পুঁজিবাদী লোকের সহায়তা ছাড়া ও ব্যাপক আকারে উৎপাদন করা সম্ভব, মুনাফা পাগল চক্র ছাড়া ও শিল্প কারখানা পরিচালনা করে মানুষে চাহিদা সন্দর ভাবে মেটানো সম্ভব। যদি ও যুদ্ববাজ চক্র স্পেনে নানা ভাবে এর বিরুদ্বে প্রচারনা চালিয়েছে এর পর ও এটা স্পস্ট হয়ে উঠে যে এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম মানুষকে নয়া ব্যবস্থা উপহার দিতে সক্ষম। শুধু তাই নয় সমাজবাদি আন্দোলনের জন্য একটি উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্টগন যদি শ্রমিক শ্রেনীর মধ্যে এবং প্রতিটি দেশেই সত্যিকার স্বাধীন সমাজতন্ত্র চায় তবে, তাদেরকে প্রচলিত সংগঠন সমূহকে অর্থনৈতিক লড়াই সংগ্রামে যুক্ত করতে হবে। অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে সকল দেশে একেই ভাবে সকল কার্যক্রম অনুসরন করতে হবে। প্রতিটি দেশের নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, রচম রেওয়াজ আছে। মানুষে মন মানসিকথা ও আলাদা ধরনের হয়ে থাকে। এই জন্য ফেডারেশন ভিত্তিক যৌথজীবন যাপনের জন্য মানুষকে ক্রমে আগ্রহী করে তুলতে হবে, তাদের প্রচলিত চিন্তা ভাবনায় যে উপাদান সমূহ বিদ্যমান আছে তা ব্যবহার করা যেতে পারে।
মহান চিন্তক ক্রপতকিন বলেছিলেন, ইংল্যান্ডকে উদাহরন হিসাবে গ্রহন করা যায়, সেখানে তিনটি বিশাল আন্দোলন হয়েছে। সেই বিপ্লবী আন্দোলনের সময়ে শ্রমিক শ্রেনীর লোকদের এবং সামগ্রীক সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থার বেহাল দশা হয়ে পড়েছিলোঃ ট্রেড ইউনিয়নবাদ, সমবায় আন্দোলন, এবং নগর সমাজবাদের আন্দোলন তিব্ররূপ ধারন করেছিলো; সেই আন্দোলনের সময়ে তাদের একটি নির্দিস্ট লক্ষ্য স্থির করা ছিলো তারা এক যোগে কাজ ও করেছিলো, একেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তৎপর ছিলো সকলেই। শ্রমিক শ্রেনীকে ও এটা বুঝতে হবে যে মানুষের সামগ্রীক স্বাধীকারের বিষয়টির জন্য কাজ করা কেবল তাদেরই দায়িত্ব নয়। কিন্তু সেই স্বাধীকার তখনই সম্ভব যখন সাধারন জনগণ রাজনৈতিবিদদের স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসাবে কাজ না করে শ্রমিকদের তৈরী সংগঠনে নিজেদের যুক্ত না করবেন।
সর্বোপরি, তাদের এই প্রচেষ্টাগুলি জাতীয় রাস্ট্রের স্বার্থের সাথে যুক্ত করা উচিত নয়, দুর্ভাগ্যবশত, বেশিরভাগ দেশে এই ঘটনা ঘটেছে। দুনিয়ার সকল শ্রমিক নিজেদের স্বার্থে নিজেরা কাজ করে যাবেন। নিজের স্বার্থে লড়াই করবে। তবে এর অর্থ এই নয় যে তারা কেবল রাষ্ট্র ও মালিক পক্ষের বিরুদ্বেই লড়বেন। বরং সামগ্রীক পরিস্থিতি পাল্টানোর জন্য নিরন্তর চেস্টায় লিপ্ত থাকবেন। শ্রমিক শ্রেনী ও ট্রেড ইউনিয়নের সম্মিলিত চেস্টায় সকলেই সমাজবাদি দলের পক্ষে লড়াই করবেন। জার্মানীতে ট্রেড ইউনিয়ন সমূহ দরিদ্র শ্রমিকদের দল সমূহে গুরত্ব দেয়নি। তারা শ্রমিকদের পরিবর্তে ধনীক শ্রেনীর আড্ডার টেবিল বেশী পছন্দ করত। যেখানে যেখানে পারস্পরিক সহযোগীতা করা দরকার ছিলো সেখানে তা পরিলক্ষিত হয়নি।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে বুর্জোয়া শ্রেনীর লোকেরে কিছু শ্রমিকদেরকে কতিপয় ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে। তারা দেখাতে চায় অন্যদেশের শ্রমিকের তুলনায় তাদের দেশের শ্রমিক শ্রেনী সুখি জীবন যাপন করছেন। তবে তার বিনিয়ে ময়ে বুর্জোয়া শ্রেনী তাদের স্বাদীনতা কেড়ে নেয় আর সাথে সাথে অন্যদেশে লোকের উপর বেড়ে যায় শোষনের মাত্রা। ইংল্যান্ড, ফ্র্যান্স,হল্যান্ড ইত্যাদি দেশের শ্রমিকদেরে কিছু অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে বুর্জোয়া দেশ সমূহ তাদের কলোনি ও অন্যান্য দেশের শ্রমিকের উপর শোষণের পরিমান বৃদ্বি করে ফেলে; তবে এই পরস্থিতি বেশীদিন ঠিকে না । এক সময় জনগণ বুঝতে পারে এবং জেগে উঠে এবং তারা ন্যায্য পাওনার জন্য দাবী জানায়। সাম্প্রতিক কালে এশিয়ার শ্রমিকদের মাঝে ও সেই প্রবনতা বেড়ে চলেছে । কোন কোন সময় স্বল্প সুবিধা মানুষের সামনে বিশাল সুযোগ এনে দেয়। উচ্চ বেতন ভাতাদি বাজারে পন্য দাম বৃদ্বি করে দেয়। কিন্তু একেই সময়ে তাদের অন্যদেশের ভাই বোনেরা সিমান্তের অপর পাড়ে নিম্ন মানের জীবন যাপন করেন । এই ধরনে পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের সামনে নয়া দিগন্তের উন্মোচন ঘটায়। যা আন্তর্জাতিক সংগঠনের কংগ্রেসে উত্থাপিত হতে পাড়ে। দেশে দেশে শ্রমিকে শ্রমিকে স্বাধীনতা ও মজুরীর ব্যবধান বাড়তেই থাকে। ফলে শ্রমিকে পারস্পরিক বন্দ্বন বা ঐক্য অনেক ক্ষেত্রে শিতিল হতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক সংগঠন সমূহের উদ্যোগ শ্রমিক শ্রেনী বুর্জোয়া শ্রেনীর বিরুদ্বে লড়াই করে সঞ্চালিত করে থাকে। শ্রমিক শ্রেনী তখন মালিক পক্ষের বিরুদ্বে লড়াই সংগ্রামে ন্যায় প্রতিস্টায় এগিয়ে এসে শ্রমিক ও অন্যান্য সাধারন মানুষকে যক্ত করে সামাজিক বিপ্লবের পথকে সুঘম করে দেয়। কিন্ত জার্মান সমাজনাদি প্রেস বিশ্ব যুদ্বের কালে অন্য দেশের ভূমিক দখলে নেবার আহবান জানায়। আর এর পেছনে মুল কারন ছিলো শ্রমিক দল বা পার্টি সমূহ রাজনৈতিক দলের লেজুরে পরিনত হয়েছিলো। এই বিকৃতিটি আরো অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিলো। আসল কথা হল শ্রমিক শ্রেনী যখন বুঝবে যে সক্ল দেশে সকল স্থানে সকল কালে তাদের স্বার্থ এক ও অভিন্ন তখনই কেবল তারা এক হয়ে কাজ করতে সক্ষম হবেন । যা শ্রমিক শ্রেনীর আন্তর্জাতিকের ভিত্তি হিসাবে কাজ করবে ।
ইতিহাসের প্রতিটি সময়েই তার সুনির্দিস্ট সমস্যা দেখা দেয় এবং তা সমাধানের জন্য বিশেষ কিছু পদ্বতি ও অনুসরন করতে হয়। আজ আমাদের সময়ে বড় সমস্যা হলো মানুষকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার সমস্যা। এখন রাজনৈতিক বিপ্লবের সময় নয়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নাগপাশ থেকে মানুষকে মুক্ত করার সময় এসেছে। এখন প্রতিনিয়ত এটা প্রতিয়মান হচ্ছে যে, পুঁজিবাদী বুর্জোয়া গণতন্ত্র মানুষের চাহিদা মেটাতে ব্যার্থ হয়ে নিজেরাই ফ্যাসিবাদে রূপ নিচ্ছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক সমাজবাদ বুর্জোয়া রাজনীতির শুকনো নদিতে সাঁতার কাটতে চাইছে। এরা এখন মানুষকে সত্যিকার সমাজবাদি শিক্ষা না দিয়ে ভূয়া সংস্কারবাদি পথে হাঁটছে। কিন্তু পুঁজিবাদের উন্নয়ন, আধুনিক বড় বড় রাষ্ট্র আমাদের জন্য নয়া পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে, সেখানে আমরা সকল শক্তি নিয়োজিত করে একটি সার্বজনীন মহা বিপ্লবের জন্য কাজ করছি। বিগত বিশ্ব যুদ্বের সময়কার আর্থ-সামাজিক অবস্থা এখনো অব্যাহত আছে, যা সকল মানুষের সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে বিনাশ করে চলছে। আর সেই জন্যই আজ আমাদের একান্ত চেষ্টা যে, আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাকে আমাদের নতুন করে সমাজবাদের ভিত্তিতিতে গড়ে তুলা। তবে কেবল উৎপাদনকারীগনই এই কাজ করতে সত্যি সক্ষম, কেননা তারাই হলো সমাজে মূল্য সৃজনকারী শক্তি। যারা সকল কিছুতে নতুনত্ব আনতে পারেন। তাদের কাজ হলো শ্রমকে অর্থনৈতিক শোষন মুক্ত করা, সকল সামাজিক প্রতিস্টান সমূহকে রাজনীতির প্রভাব থেকে আলাদা করা, সমাজে নারী পুরুষ সহ সকল মানুষের মাঝে সহযোগীতামূলক শ্রম পরিবেশ সৃজন করা যারা কেবল সামাজিক স্বার্থে কাজ করবেন। একটি কর্মময় মানব সমাজ গড়ে তুলার জন্য শহরে, নগরে ও গ্রামে গঞ্জে সকলে মিলে এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের লক্ষ্য বাস্তবায়নে এক যোগে কাজ করে যেতে হবে।