এ কে এম শিহাব অনূদিত গ্রেগরী পেট্রোভিচ ম্যাক্সিমফ প্রণীত প্রোগ্রাম অব এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম ( সম্পূর্ন বই)

এ কে এম শিহাব অনূদিত

গ্রেগরী পেট্রোভিচ ম্যাক্সিমফ প্রণীত প্রোগ্রাম অব  এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম

লেখক গ্রেগরী পেট্রোভিচ ম্যাক্সিমফ  প্রসঙ্গেঃ

গ্রেগরী পেট্রোভিচ ম্যাক্সিমফ ১৮৯৩ সালের ১০ ই নভেম্বর রাশিয়ার নিভৃত পল্লীর মিটোশিনো প্রদেশের স্মলনেস্ক গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন । তিনি প্রথম জীবনে ধর্মীয় বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে প্রিস্ট হিসাবে স্বীকৃতি অর্জন করেন। তিনি অল্প দিনের মধ্যেই বুঝতে পারেন যে, এই পথ তার জন্য নয় তাই তিনি গীর্জা ছেড়ে সেন্ট পিটাসবোর্গে চলে আসেন। তিনি সেখানে ১৯১৫ সালে একজন কৃষি বিশারদ হিসাবে গভীর জ্ঞান অর্জন করে। তিনি তার ছাত্র জীবনেই বিপ্লবী হিসাবে নাম লিখান । তিনি ১৯১৭ সালের রাশিয়া বিপ্লবের একজন প্রথম সারির প্রচারক ও বিপ্লবী ছিলেন । পরে তিনি লাল ফৌজে  ভর্তি হন । সেই সময়ে বলশেভিকগন এই লাল ফৌজদের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেনীকে নিরস্ত্র করার জন্য অভিযান পরিচালনা করছিলেন । তিনি বলশেভিকদের সেই কাজের বিরুধিতা করার অপরাধে মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত হন। তবে তার প্রতি ইস্পাত শ্রমিকদের সংহতি ঘোষনা তাকে বাচিয়ে দেয় । তিনি এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্ট পত্রিকা গোলস ট্রাডা (ভয়েস অফ লেবার) এবং নভি গলোস ট্রাডা (নিউ ভয়েস অফ লেবার) সম্পাদনা করেন। ৪ ই মার্চ, ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ক্রোনস্টেড বিদ্রোহের সময় গ্রেপ্তার হন । তিনি ম্যাগনিতে টেগানাকা জেলখানায় অন্যান্য কমরেডদের সাথে আটক হন। চার মাস পর তিনি প্রায় তের দিনের জন্য অনশন ধর্মঘটে যান এবং ইউরোপীয় সিন্ডিক্যালিস্টদের হস্তক্ষেপের ফলে তিনি দশদিন পর অনশন ভঙ্গ করেন, পরে তিনি রেড ট্রেড ইউনিয়ন ইন্টারন্যাশনালের একটি কংগ্রেসে যোগদান করেন, তার প্রচেস্টার ফলে তার কমরেডদের বিদেশে নির্বাসিত হওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিত করে।

তিনি বার্লিন গিয়েছিলেন, যেখানে তিনি ‘রবোটীরাখ’ (শ্রমজীবন) সম্পাদনা করেন, যা নির্বাসনে রাশিয়ান সিনডিক্যালদের একটি কাগজ। তিন বছর পর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও প্যারিস যান, পরে তিনি শিকাগোতে বসতি স্থাপন করেন। সেখানে তিনি ১৬ মার্চ, ১৯৫০ তারিখে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত গলস ট্রুজেনসিকা (ওয়ার্কার্স ভয়েস) এবং পরে ডেইলো ট্রুডো-প্রুভঝেনি (শ্রমজীবন - জাগরণ) সম্পাদনা করেন।

ম্যাক্সিমোফ তার জীবনের পূর্নতার আগেই হ্রদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরন করেন। তার মৃত্যুতে চারি পাশে শোকের ছায়া নেমে আসে। তিনি কেবল একজন সৃজনশীল চিন্তক ছিলেন না, তিনি অত্যন্ত দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তিনি অনেক বড় মাপের মানবিকতার অধিকারী মানুষ ছিলেন । তিনি একজন সামগ্রীক চিন্তার অধিকারী লোক ছিলেন । তার চিন্তায় হতাশার আধার কাটিয়ে আলোর জ্বলক ফোটানোর প্রয়াস ছিলো খুব স্পষ্ট । তিনি নিজেকে একজন এনার্কিস্ট হিসাবে এই জন্য গড়ে তুলেন নাই যে এটা তার উপর কোন দায়িত্ব, বা বাহির থেকে কেউ তা চাপিয়ে দিয়েছে তার উপর। এই চেতনা তার হ্রদয়ের চেতনা ছিলো। যা তার কর্ম  ও চিন্তাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে ছিলো । যা দ্বারা তিনি সারাজীবন চালিত হয়েছেন ।

  • রুডলফ রকার

ভূমিকাঃ এনার্কিজমের আলোকে আধুনিক সমাজ

প্রচলিত সমাজ হল পুঁজিবাদী সমাজ। এই সমাজের ভিত্তি হলো ব্যাক্তিগত সম্পত্তি। এই সমাজের প্রধান চরিত্র হলো উৎপাদন করা হবে বানিজ্যের জন্য, মুনাফার জন্য । উৎপাদন সম্পর্ক ও গড়ে উঠে এরই উপর ভিত্তিকরে, সকল পন্য বিতরন করা হয় বা মালিকানা গ্রহন করা হয় ব্যাপক সংখ্যায় শ্রমিকের মজুরী সহ স্বল্প সংখ্যক লোকের জন্য – পুঁজিবাদী শ্রেনীর স্বার্থে। বিপুল পরিমান মানুষ কেবল শ্রম শক্তির বাহন হয়ে থাকে- শারিরিক ও মানসিক বা মেধাগত শ্রম পুঁজিবাদীদের নিকট বিক্রি করে দেয়া হয় ;  শুধু তাই নয় প্রলেতারিয়েত, দরিদ্র কৃষক, মধ্যবিত্ত, ক্ষুদ্র শিল্পের উৎপাদন যা নিজেরা উৎপাদন করেন, তারা সকলেই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ্য ভাবে পুঁজিবাদের নিকট বন্দ্বী। পুঁজির নিকট দায়বদ্ব হয়ে আছেন ।

আধুনিক সমাজের এই পদ্ধতির কারণে, অবিচ্ছিন্ন সম্পদ এক প্রান্তে সঞ্চিত হয়, অন্যদিকে ভয়াবহ দারিদ্র্য রয়েছে। উন্নত পুঁজিবাদের দেশগুলিতে এই বিষয়টি বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়, যেখানে সমাজের শ্রেণিবিভাগটি অত্যন্ত স্পষ্ট ও তাত্পর্যপূর্ণ। “ কেহ কেহ বলেন,  সত্যিকার ভাবে বেশী সম্পত্তির মালিক ও কম সম্পত্তির মালিকদের মধ্যে ভেদ রেখা টেনে দেয়া সত্যি কঠিন কাজ । যেহেতু এই সমাজ গুলো একে অপরের সাথে নানা ভাবে পারস্পরিক ভাবে সম্পর্কিত হয়ে আছে ।  তাদের মধ্যে স্পস্ট ভাবে তেমন কোন ভেদ রেখা দৃশ্যমান নয়। যদিও প্রানী জগত ও বৃক্ষ জগতের মাঝে একটি স্পস্ট ভেদ রেখা আছে, হিংস্র প্রানী জগত ও মানুষের মাঝে খুব সহজেই পার্থক্য নিরূপন করা যায় ।

মানব সমাজে সাম্য নির্ভর করে পরিস্থিতির উপর, যদি ও অনেক ক্ষেত্রে অনেক তথ্য উপাত্ত মজুদ নেই, তবে এটা বলা যায় যে, সামাজিক পরিবর্তন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির বদল হলে অজান্তেই অনেক কিছু পাল্টে যায়। সামাজিক শ্রেনী বিভক্তি অনেকটা স্পস্ট । প্রায় সকলেই বলতে পারেন সমাজে কারা উচ্চ বিত্ত, মধ্য বিত্ত  আর কারা নিম্ন বিত্ত  বা প্রলেতারিয়েত।  এটা দিবালোকের মতই স্পষ্ট যে কে কে অনেক জমির মালিক, কাদের নিয়ন্ত্রনে অনেক বেশী মজুর আছে । যারা কৃষি শ্রমিক হিসাবে গ্রামীন পরিবেশে কাজ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করেন” ( এম এ বাকুনিন)। আধুনিক সমাজে রাষ্ট্র তার সকল শক্তি দিয়ে যেমন তার লোকদের চালনা করে তেমনি গ্রামীন সমাজে ধর্ম ভিত্তিক নৈতিকতার আবরনে তাদেরকে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রন করা হয় ।

পুঁজিবাদী সমাজের সকল কিছুই নির্ভর করে পন্য কেনা বেচার উপর- বাজারের বৈশিস্ট্য হলো এটা বিতরনের মাধ্যম যে সকল পন্য ব্যবহার উপযোগী করা হব, তা এই প্রক্রিয়ায় বিতরন করা হবে । আর সেই কারনেই একটি পুঁজিবাদী সমাজে সকল কিছুই পন্য হিসাবে পরিগনিত হয়ে থাকে । ( তা কেবল বস্তুগত জিনিষ নয়, বিজ্ঞান, শিল্প, এমন কি নৈতিক গুণাবলী ও বিক্রয়  যোগ্য।) ফলে, উৎপাদন  অংশ ক্ষুধা দারিদ্র আর মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হয়। কেননা সেই মানুষ গুলো ও পণ্যে পরিণত হয়ে  পড়েন । সেই সমাজের মধ্যে মানুষের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, চিন্তা ভাবনা, শারীরিক প্রয়োজোন সকল কিছুই পন্য হিসাবে গন্য হয় ।

পুঁজিবাদী ধনিক শ্রেনী ও তাদের সম্পদের সুরক্ষা দেয় রাষ্ট্র; ফলে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেনী যখন কাজের জন্য মালিক পক্ষের সাথে কোন চুক্তিতে আবদ্ব হয় তখন রাষ্ট্র শ্রমিক নয় মালিক পক্ষের স্বার্থে কাজ করে থাকে। সামাজিক এই নীতিমালায় সাধারন ভাবে ধরে নেয়া হয় সাম্য ও ন্যায্যতা বজায় রাখা হবে, কিন্ত বাস্তবতা হলো সকল সময়েই  সুবিধাবাদি শ্রেনীর পক্ষে সকল কিছু হয়ে থাকে। এমন কি শ্রমিক বা প্রলেতারিয়েতগন প্রতিবাদ করলে তাদের বিরুদ্বে রাষ্ট্র শক্তি প্রয়োগ করে থাকে । প্রচলিত ব্যবস্থায় দূর্বলদের জন্য কোন জায়গা নেই, এখানে শক্তিমানদেরই পুজা করা হয় । এই প্রচলিত পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদী শ্রেনী বেশ কিছু সুবিধা আদায় করে নেবার সুযোগ পায়, রাস্ট্রীয় সুবিধার পাশা পাশি শ্রমিকদের শ্রমে উৎপাদিত পন্যের সিংহ ভাগ মালিক পক্ষ তাদের পকেটস্থ করে নেয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভেতর শ্রমিক শ্রেনী মধ্যস্থতা করার পরিধি ও সীমিত। প্রায়স রাষ্ট্র মালিকদের পক্ষ নিয়ে শ্রমিকদেরকে নির্মম ভাবে দমন করার কাজ খুবই বিশ্বস্থতার সাথে করে থাকে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এখন পর্যন্ত যে উন্নয়ন হয়েছে তা সামগ্রীক ভাবে মালিক পক্ষ ব্যবহার করতে চায় না, বরং খুবই সীমিত  আকারে উচু স্তরে বিশেষ করে শোষক শ্রেনীর লোকেরা এই সকল প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে । আজো মেহেনতী মানুষ প্রযুক্তির সুফল ভোগ করার সুযোগ পায় নাই । যাদের শ্রমে ঘামে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক বিকাশ হয়েছে তার সুফল চুড়ান্ত বিশ্লেষণে পুঁজিবাদী শ্রেনীর ঘরে চলে যাচ্ছে । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন হচ্ছে তা কাজে লাগাতে পারলে উৎপাদন ব্যবস্থাকে আরও সহজতর করা সম্ভব হবে । প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লে উৎপাদন ব্যবস্থায় বড় বড় শিল্পের বিকাশ হবে । ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প গুলো নিজেদের পুঁজি সহ নানা কারনে সংকুচিত হয়ে পড়বে। তখন এরা বড় শিল্পের উপর নির্ভরশীল হয়ে পরবে । ফলে শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্বি পাবে ।

অধিকন্তু, ক্রমবর্ধমান হারে যান্ত্রিকিকরনের ফলে পন্য উতপাদনের হারে দ্রুত বৃদ্বি পায়, ফলে উদ্যোক্তাদের মাঝে শ্রমিকদের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দেয়। তখন রাস্ট্রীয় ক্ষমতার চত্রছায়ায় মালিক পক্ষ অপেক্ষাকৃত দূর্বল জনশক্তি যেমন- নারী ও শিশুদেরকে কাজে লাগিয়ে দেয়। সেই কারনে ক্রমবর্ধমান যান্ত্রিকিকরনের ফলে বেকারত্ব বেড়ে যায়, পুঁজিবাদীরা ভাড়াটে শ্রমিক কাজে লাগায়, মজুরী কমিয়ে দেয় আর সমাজে বাড়ায় তিব্র শোষণ ও  দারিদ্রতা।

আধুনিক সময়ে যান্ত্রিকতার যে বিকাশ হয়েছে তাতে মানুষ নিজের শক্তি ও সময় ব্যবহার করতে পারছে, অর্থনীতিতে সঞ্চার করতে পারছে বিপুল অগ্রগতি, উৎপাদন করতে পারছেন বিপুল পরিমানে পন্য সামগ্রী যা মানুষের চাহিদা মাটানোর জন্য সরবরাহ করা হচ্ছে নানা ভাবে । কিন্তু এখনো পুঁজিবাদ সকলের চাহিদা মেটাতে পারছে না । এখোনো অগনিত মানুষ শিল্প পন্যের নাগালের বাইরে রয়ে গেছেন। তা ছাড়া পুঁজিবাদের নিজস্ব দূর্বলতার কারনেই সকল মানুষের সমান ভাবে চাহিদা মেটানো সম্ভব নয় । এমন কি মানুষের নিত্য প্রয়জনীয় পন্য যেমন খাদ্য, কাপড়, গৃহ এবং শিক্ষার মত জিনিষ ও সকলকে দেয়া পুঁজিবাদের পক্ষে অসম্ভব । প্রচুর মানুষ আছেন যারা তাদের পছন্দ সই কাজ খোজে পাচ্ছেন না, বেকারত্ব, অর্ধ বেকারত্ব মানুষের পেছনে লেগেই আছে ।

প্রচলিত ব্যবস্থায় পুঁজিবাদী দেশ সমূহে মানুষের অগনিত মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাচ্ছে । ফলে উৎপাদিত পন্য ধ্বংস করা ও এক সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে । দেশের ভেতরে স্তুপিকৃত পন্য ধবংস করতে না  পেরে আন্তর্জাতিক বাজারে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। অথচ এমন অনেক পন্য আছে যা অনেক দেশের জন্যই উপযোগী নয় । ফলে অর্থনীতিতে দেখা দেয় সংকট, মন্দ্বা, ও দেওলিয়াত্ব ইত্যাদি। অনেক উদ্যোক্তার কর্ম ক্ষেত্র বিনাশ হয়ে যায় । নিচে নেমে যায় কর্মজীবী  মানুষের জীবন যাত্রার মান ।

উতপাদনে বিশৃঙ্খলা এবং বাজারে দেখা দেয় সীমাহীন প্রতিযোগীতা ফলে বড় পুঁজির অধিকারী সংস্থা গুলো একচাটিয়া ভাবে সুবিধা আদায় করে নেয় – তারা তখন নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলে সিন্ডিক্যাট, কার্টেলস ও ট্রাষ্ট ব্যবস্থা। যা আমরা বিংশ শতাব্দীতে অনেক উদাহরন দেখেছি । যারা অর্থনীতি ও রাজনীতিক জীবনে ব্যাপক প্রভাব বলয় তৈরী করে শিল্পোন্নত দেশ সমূহে ব্যাপক সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। সেই পথ ধরেই পুঁজিবাদী দেশ সমূহ নিজেদের শিল্পের বিকাশ ও পুঁজির পরিমান ব্যাপক ভাবে বাড়িয়ে নিয়েছে। এই পরিস্থিতির কারনে বিবর্তনের ইতিহাসে নয়া অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে – পুঁজিবাদের অধ্যায় বিকশিত হয়েছে এবং যাকে আমরা পুঁজিবাদের চূড়ান্ত উন্নয়ন মনে করি ।

পুঁজিবাদ বর্তমান দুনিয়ায় এখন একটি সাম্রাজ্যবাদি স্তরে উন্নিত হয়েছে এবং এটার  অর্থনৈতিক অবস্থাটি এখন একটি কম্যান্ডে পরিনত হয়েছে । পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আর নতুন কিছু দেবার নেই এখন এর বিদায় নেবার সময় হয়েছে । এটা এখন যতদিন ঠিকে থাকবে তা মানুষকে কস্ট ছাড়া আর কিছুই দিতে পারবে না । সুনির্দিস্ট ভাবে বললে  বলতে হয়, সাম্রাজ্যবাদ এখন দুনিয়ার সকল জায়গা থেকে সকল সম্পদ নিজের দেশে পুঞ্জীভূত করার জন্য যা যা করনীয় তার সবই করবে ।  যুদ্ব, খুন ও গুম সব । দুনিয়ায় তাদের কথাই চলবে। অন্যদের কথা কেবলই কথার কথা ছাড়া আর কিছুই নয় । তা কেবল অর্থনৈতিক বিষয়ে নতুন রাজনৈতিক এমন কি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ও তাদের ইচ্ছাই শেষ কথা । সকল জাতি সকল দেশ তাদের কথা বাহিরে যাবার কোন সাধ্য নেই ।

অন্যান্য দেশে  ব্যাপক ভিত্তিক বিনিয়োগ করার পেছনে সাম্রাজ্যবাদি দেশ গুলোর নজর থাকে সংশ্লিষ্ট দেশ সমূহের প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানব শ্রম শোষণ করার দিকে । তারা সত্যিকার ভাবেই “পিতৃভূমির” ধারনাটিকে কুসংস্কার হিসাবেই বিবেচনা করে থাকে। তাদের নিকট মুনাফাই হলো আসল কথা । নিজেরা জাতীয়তাবাদের কথা বললে ও আদতে এরা শোষক হিসাবে আন্তর্জাতিক ধ্যান ধারনার  উপাসক ।

পুঁজি কখনো “পিতৃভূমি” চিনে না । আমরা দেখতে পাচ্ছি বড় বড় ট্রাষ্ট সমূহ রাস্ট্রীয় আইনের আওতায় আবদ্ব। সকল সংস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আসলে অভিন্ন। তাদের লক্ষ্য দুনিয়ার উপর প্রভূত্ব কায়েম করা । তাদের মধ্যে ও সেই জন্য পারস্পরিক প্রতিযগীতা বিদ্যমান আছে । আর সেই জন্যই পুঁজিবাদী সমিতি সমূহ বাজারের দখল নেবার জন্য মরিয়া হয়ে প্রচেস্টায় লিপ্ত রয়েছে । বিভিন্ন দেশের এই মরিয়া চেস্টার ফল হিসাবে কোন কোন সময় আমরা “সশস্ত্র শান্তি”র মহড়া দেখতে পাই, তবে প্রায়স তা যুদ্বে রূপ নেয় । ১৯১৪-১৯১৮ সালে এই রকমের একটি লড়াই আমরা দেখেছি । সাম্রাজ্যবাদি যুদ্ব দুনিয়াকে অসাম্য করে তোলে, বিজয়ী ও বিজেতা হিসাবে যেমন বিভক্তি রেখা টেনে দেয় তেমনি প্রলেতারিয়েত ও দরিদ্র কৃষকদের জন্য জীবন দুর্বিসহ করে তোলে । সাম্রাজ্যবাদ হলো সকল যুদ্বের উৎস। এটা স্পষ্ট করেই বলে দেয়া যায় যে, যতদিন পুঁজিবাদ থাকবে ততদিন যুদ্ব ও দুনিয়াময় বিরাজমান থাকবে ।

সাম্রাজ্যবাদের বিকাশ মানেই হলো বেকারত্বকে স্থায়ীত্ব প্রদান করা, এটা মানুষের বিশ্বাস নিয়ে খেলা করে, ধর্মকে কাজে লাগায় রাষ্ট্র, আইন ব্যবহার করে মানুষকে বিকশিত হতে বাঁধা প্রদান করে । এটা প্রলেতারিয়েতের আন্দোলন সংগ্রামকে কঠিন করে দেয় এমনকি তাকে দমনে নানা প্রকার ব্যবস্থা গ্রহন করে থাকে । যদি ও সমাজের কিছু অংশে শ্রেনী চেতনা বৃদ্বি পায়, শোষণ সম্পর্কে মানুষ সচেতন হয়, প্রতিবাদ প্রতিরোধের দাবী তিব্রতর হয় । তবে এটা ও স্পস্ট হয় যে প্রচলিত সংগঠন সমূহের বদলে নয়া সংস্থা গড়ে তুলা ছাড়া  এই পরিস্থিতির বদল করা সম্ভব নয় ।

ইতিহাসের মহান উদ্যোগ যা রাশিয়ার সমাজ ব্যবস্থাকে পাল্টে দিয়েছিলো ১৯১৭- ১৯২১ সালে মধ্য ইউরূপের কয়েকটি দেশকে প্রচন্ড ঝাকুনি ও দিয়েছিলো, সেই ঝাকুনির পেছনে ও পুঁজিবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী যুদ্বই ছিলো প্রধান নিয়ামক । রাশিয়া ও জার্মানীর বিপ্লবের জন্য কোন ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত বিবচনায় ছিলো না; কিন্তু রাশিয়ার বিপ্লবটি রাস্ট্রবাদি সমাজবাদের খপ্পরে পড়ে যায়। ফলে রাস্ট্রীয় সমাজবাদ আর পুঁজিবাদী সমাজের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখা যায়নি। যেখানে উভয়ই রহস্য জনক পদ্বতী অনুসরন করে সকল সমস্যার সমাধানের প্রায়স চালায়; তারা চেষ্টা করেন ক্ষমতা ও সংহতি, সমতা ও শোষণ, প্রগতি ও দারিদ্রতার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে । যা আদতে অসম্ভব ব্যাপার । কেননা এই গুলো পরস্পরের সম্পূর্ন বিপরীত বিষয়। এই গুলো কোন গুনগত বা পরিমান গত উপাদান নয় যা একে অন্যকে প্রভাবিত করতে পারে।  রাশিয়ান বিপ্লবে প্রচলিত রাস্ট্রীয় ও সামাজিক সমস্যার সমাধানের জন্য কঠোর ও কট্টর সাম্যবাদি পন্থা অনুসরন করা হয়েছিলো। আসল বিষয় হলো সাম্যবাদ কৃতৃত্ববাদি ভাবধারা দিয়ে বাস্তবায়ন করা যায় না । তা করা হলে সামাজিক ভাবে নানা ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করবেই । তার জন্য দরকার সামাজিক শক্তির বিকাশের সাথে সাথে সকলের স্বেচ্ছাকৃত অংশগ্রহন নিশ্চিত করা ।  যা ছিল রাসিয়ান বিপ্লবে একেবাই অনুপস্থিত।

রাশিয়ায় ক্ষমতা ভিত্তিক সাম্যবাদের চর্চা আমাদেরকে অনেক কিছু শিখিয়েছে, আমরা পদ্বতীর বাস্তবসম্মত জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছি । রাষ্ট্র ভিত্তিক সাম্যবাদি চর্চায় পন্যের উৎপাদন ও বিতরন প্রক্রিয়ায় আমলতন্ত্র এক অন্দ্ব ভুতের মত জনগণের উপর চেপে বসে । সেই প্রাশাসনিক ব্যবস্থায় সকল প্রকার উৎপাদন যন্ত্র, সরবরাহ করার পন্য, সকল শ্রমিকের শ্রম, এবং একজন ব্যাক্তি নিজে ও রাস্ট্রের মালিকানায় চলে যায়, যা প্রকারান্তরে স্বল্প সংখ্যক মানুষের ক্রিড়নকে পরিনত হয়। সমাজের সকল স্তরের মানুষ যারা শ্রম দিয়ে নানা প্রকার পন্য উৎপাদন করেন তারা সেই ব্যবস্থায় শুধুই রাস্ট্রের ক্ষমতা বৃদ্বির কাজ করে থাকে। ফলে যারা প্রশাসনে থাকে তাদের ও ক্ষমতা বাড়তে থাকে । যা অনেক ক্ষেত্রে আবার জনগণকেই নানা ভাবে নিপিড়নের শিকার হতে হয় ।

আমলাতন্ত্রের জাল শিল্প সম্পর্ককে  এবং অর্থনৈতিক জীবন ও সমাজকে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করে, এরা সকল প্রকার জনশক্তিকে রাস্ট্রের জন্য কাজ করতে বাধ্য করে থাকে,  জনগনকে নানা বিভক্ত করে, সামাজিক স্তরবিন্যাস তৈরী করে, জনগণকে অফিসিয়াল নিয়ন্ত্রনে চালিত করে আমলাতন্ত্রের প্রভাব বলয়  বজায় রাখে। জনগনের ব্যাক্তিগত পরিচয়ের বিপরীতে তাদেরকে “জনশক্তি” নামে অবহিত করে থাকে।  রাষ্ট্র যেমন পরিকল্পনা করে সে তার ইচ্ছেমত জনশক্তিকে ব্যবহার করে থাকে। সেই ক্ষেত্রে সাধারন মানুষের আশা আকাংখার চেয়ে রাস্ট্রীয় আমলাদের স্বার্থই প্রাধান্য পেয়ে থাকে । এই প্রক্রিয়া যদি কোন সাম্যবাদি সমাজে ও অনুসরন করা হয় তবে মানুষ এক প্রানহীন রোবটে পরিনত হয় । মানুষ রাস্ট্রের দৃষ্টি ভঙ্গীর বাইরে কিছু ভাবতেই পারে না । ফলে ব্যাক্তি হিসাবে মানুষের সৃজনশীলতার মৃত্যু ঘটে। সামাজিক স্তর বিন্যাস আরও শক্তিশালী হয়। নিশ্চিত ও নিরাপদ হয় আমলাদের রাজত্ব।

নাগরিক সমাজের জীবন একটি পুলিশ রাস্ট্রের সত্যিকার অর্থে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যেতে পারে না। ক্ষমতার কেন্দ্রীকতার কারনে একটি সাম্যবাদি রাস্ট্রে ও সাধারন মানুষ রসকষ হীন ভাবে জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। মানুষকে পদে পদে পর্যবেক্ষনের শিকার হতে হয় । এই পদ্বতী মানুষের স্বাধীনতাকে কবর দিয়ে দেয়। সমাবেশ করা, মুক্তভাবে কথা বলা, সংবাদ আদান প্রদান করা, শিল্প সংগ্রাম জোরদার করা, ও ব্যাক্তি হিসাবে নিজের উন্নয়ন সাধন কোন ভাবেই সম্ভব হয় না । এই সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া মানুষের ব্যাক্তিগত সম্পর্ককে পর্যন্ত বিনষ্ট করে ফেলে । নাগরিক জীবন হয়ে উঠে দুর্বিসহ।

এই ধরনের সামাজিক বিবর্তন পুঁজিবাদের অধীনে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারনে অধিকতর তিব্রতর হবে, শ্রেনী সংগ্রাম হবে আগের যেকোন সময়ের তুলনায় নির্মম ও নিস্টুর প্রকৃতির। রাশিয়ার সমাজ ব্যবস্থায় আমরা যে অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছি, তাতে বুঝা যাচ্ছে সামাজিক এই কাঠামোতে প্রচুর অসামঞ্জস্য বিদ্যমান ছিলো। এই সমাজ কাঠামোটি পরিগঠনের পেছনে স্বাধীন সাম্যবাদের বদলে  কৃতৃত্ববাদি সাম্যবাদ অনুসরন করা হয়েছিলো । এই বিষয়টি স্পষ্ট হয় যখন আমরা পুঁজিবাদী পুলিশি ব্যবস্থার রীতিনীতি গুলো অধ্যয়ন করি। বলশেভিক চক্র নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য বিকল্প পথ হিসাবে রাস্ট্রবাদি ধারনার অনুসরন ও অনুকরন কঠোর ভাবে করতে থাকে ।

রাশিয়ার বিপ্লব শুরু হয়েছিলো ধনিক শ্রেনীর সমাজকে চুরমার করে দিয়ে একটি স্বাধীন ও মুক্ত সমাজ গড়ে তুলার জন্য, কিন্তু একটি অভিজাত চক্র একনায়কতান্ত্রিকতার আমদানি করে বসে, তারা ফিরে যায় “ ওয়ার কমিউনিজম” এর পথে। যা আদতে পুজিবাদেরই নামান্তর । তবে, এই বিপ্লব  ফ্র্যান্স বিপ্লবের মত একটি মহান ধারনা দুনিয়ার সামনে মানুষের হাজির করেছে, মানুষকে প্রেরনা দিয়েছে পুরাতন ধ্যান ধারনা থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য। এই বিপ্লবের আসল লক্ষ্য ছিলো দুনিয়ার সকল দেশের, জাতির ও বর্নের  শ্রমিকদেরকে আন্দোলন সংগ্রামে প্রেরনা সৃষ্টি করে দিতে ।

কেবল মাত্র এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্ট বিপ্লব ই  প্রলেতারিয়েত এবং সমগ্র মানব সমাজকে সত্যিকার স্বাধীকারের দিকে নিয়ে যেতে পারে, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ সৃজন করতে পারে সামাজিক জীবনে । এই মতবাদই কেবল মানুষকে নিরাপদ করতে পারে সকল যুদ্ব, সন্ত্রাস থেকে, এমন কি যে সকল রাষ্ট্র সাম্যবাদের নামে শাসনের নামে নানা ভাবে মানুষকে নিপিড়ন করছে। রাশিয়ার সাম্যবাদের দেউলিয়াত্ব, জার্মানীর সামাজিক গণতন্ত্রের প্রহেলিকা, ও পুঁজিবাদের সামাজিক  দ্বান্দ্বিকতা এবং প্রচলিত সমাজে শ্রমজীবী মানুষের লড়াই সংগ্রামের একটি সুস্টু সুরাহা করতে পারে এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম।

কেবল মাত্র সামাজিক বিপ্লবই ব্যাক্তিগত সম্পত্তির বিনাশ করতে পারে, আর চিরতরে বিলিন করতে পারে এর ভিত্তি রাষ্ট্র যন্ত্রকে। প্রতিস্টা করতে পারে সামাজিক মালিকানা, রাস্ট্রবিহীন ফেডারেশন ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা। যার মৌল কাঠামোটি তৈরী হবে স্বাধীন ও মুক্ত চুক্তির মাধ্যমে কারখানা ও গ্রামীন উন্নয়ন শাখা প্রশাখার। এটাই নিশ্চিত করে দিবে সামগ্রীক স্বাধীনতার। তা সামজের মানুষের ব্যাক্তিগত স্বাধীকার, উন্নয়ন, এবং মানব সমাজের উপর থেকে বিতারিত করবে সকল প্রকার প্রভূত্বের । সেই সমাজে কোন ভাবেই মানুষের উপর মানুষ প্রভূত্ব করতে পারবে না ।

রাশিয়ার অভিজ্ঞতা আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, সাম্প্রদায়িক সামাজিক চক্র দূর করতে হলে অবশ্যই এনার্কিস্ট সাম্যবাদ অনুসরন করতে হবে। রাস্ট্রবাদি পুঁজিবাদের বিতারনের জন্য সামগ্রীক ভাবে এনার্কিস্ট সাম্যবাদ চর্চা করতে হবে। এটা কেবল প্রলেতারিয়েত শ্রেনীকে প্রতিবিপ্লব প্রতিরোধে সহযোগিতা করবে না, বরং সমাজের পরগাছে ও পরজীবীদেরকে সমূলে বিনাশ করতে সাহায্য করবে। এছাড়া সামাজিক পর্যায়ে নানা বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য “প্রলেতারিয়েতের একানায়কত্ব” কায়েমের ও দরকার হবে না ।

এই পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে কিছু অবস্থার মুখোমুখী হতে  হয়, সেই প্রসঙ্গে লিটাকুনিন বলেছেন, “ জমির মালিকানা পাবে তারাই যারা নিজেদের হাতে জমিতে ফসল ফলান, যাকে বলা হয় কৃষি যৌথ খামার। পুঁজি ও কারখানার মালিকানা চলে যাবে শ্রমিকদের নিকট । যাকে বলা হয় শ্রমিক ইউনিয়ন”। একেই সময়ে, “ সকল রাজনৈতিক দল মুক্ত স্বাধীন ফেডারেশনের আওতায় চলে আসবে, এই গুলো কৃষি ও শিল্পের আওতায় নিজেদের জায়গা করে নিবে”। যাকে বলা হয়, রাজনৈতিক সামাজিকি করন, বা মুক্ত গ্রামে মুক্ত ফেডারেশন; অর্থনীতিতে প্রতিস্টিত হবে সিন্ডিক্যালিজম । সাম্যবাদি সংগঠনের মাধ্যমে স্বাধীন মুক্ত কারখানায় স্থাপিত হবে । এই প্রক্রিয়ায় সকল গ্রাম ও কারখানা  সকলেই একত্রিত হবে এবং উৎপাদনে তৎপর হবে। জনগণের চাহিদার আলোকে উৎপাদন অব্যাহত রাখবে ।

“ গ্রাম ও কারখানা” বাকুনিন প্রস্তাব করেছেন, “ সব কিছু নিচের দিক থেকে পুনঃ গঠনন করা হবে, প্রথমেই কিছু নতুন ভাবে স্থাপন বা গঠন করা হবে না – প্রতিটি সংস্থা ও প্রতিস্টানকে যথাযথ ভাবে সংস্কার ও পুনঃগঠন করা হবে । তবে, প্রতিটি সংস্থাই হবে প্রানবন্ত। সেই গুলো এখন যেমন আছে তার ছেয়ে শত গুন ভালো সেবা প্রাদন ও উৎপাদনে ভূমিকা রাখতে পারবে । সেই নয়া সংগঠন গুলো নিজেদের সাধ্যমত প্রচারনায় অংশ গ্রহন করবে। তাদের উপর কোন রাষ্ট্রীয় খবরদারী থাকবে না। তারা নিজেদের মত করে প্রচারনা চালাতে পারবে, নিজেদের বিকাশ সাধনে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে। যতক্ষন পর্যন্ত নিজেদেরকে একটি দক্ষতাগত উন্নত স্তরে পৌঁছাতে না পারবে  ততক্ষন পর্যন্ত ব্যবস্থাপনাগত প্রশিক্ষন অব্যাহত থাকবে”।

শ্রমিক শ্রেনীর লকেরা স্বাধীকার অর্জনের মহান লক্ষ্য ও দুনিয়াকে হেফাজত করার জন্য কাজ করবে। আন্তর্জাতিক এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের কাজই হলো বিপ্লবের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা।  মানব জাতির ইতিহাসে সৃষ্ট সমস্যার সমাধানে - ইতিহাসের অনিবার্য দাবী পুরনের জন্য এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম সক্রিয় ভাবে কাজ করে যাবে। প্রলেতারিয়েতের মুক্তি নিশ্চিত করবে। শ্রেনী সংগ্রামের ফলাফল সকল মানুষের জন্য নিবেদন করবে এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম । আজ সেই মহান কাজটি সময়ের দাবী হয়ে উঠেছে। অত্র পুস্তকে এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের বিপ্লবের অন্তর্বতী কালিন সময়ে করনীয় সহ নানা দিক তোলে ধারার প্রায়স থাকবে।

প্রথম ভাগ- অর্থনীতি

প্রথম অধ্যায়ঃ উৎপাদন শিল্প

সাম্রাজ্যবাদী লড়াই সংগ্রামে এটা প্রমানিত হয়ে গেছে যে,  রাশিয়ায় একটি অসফল  বিপ্লব হওয়া সত্বে ও পুঁজিবাদী সমাজকে তাত্ত্বিক ভাবে যত বেশী শক্তিশালী মনে করে হয়েছিলো বাস্তবে তা নয়।

রাশিয়ার বিপ্লবের অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে আরও একটি জিনস তোলে ধরেছে যে, সামাজিক বিপ্লবে মানুষের চাহিদার মাত্রা বৃদ্বি পায়, তবে সেই সময়ে উৎপাদনের পরিমান কমে যায়; এটায় আরও স্পষ্ট হয়েছে যে, দেশ যখন বিপ্লবের পতাকা উর্ধে তোলে ধরে তখন বুর্জয়ারা বিপ্লবের বিপরীতে আক্রমনাত্মক হয়ে উঠে।

এই পরিস্থিতিতে অবর্ননীয় দুর্ভিক্ষ ও অনাহার দেখা দেয়। ফলে বাস্তব অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য পূর্ব প্রস্তুতী থাকা একান্ত আবশ্যক। যদি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার মত পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেই প্রস্তুতিতে কে কোথায় কি কি দায়িত্ব পালন করবেন তা সুনির্দিস্ট ভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। প্রধানত কি কি উৎপাদন করতে হবে, কি ভাবে তা সুরক্ষিত হব, তার জন্য পূর্নাংগ পরিকল্পনা থাকা চাই ।        ( বিপ্লবের জন্য সামগ্রীক প্রস্তুতি অত্যাবশ্যক)।

রাশিয়ান বিপ্লবের অভিজ্ঞতা বলে সেই সময়ে বাধ্যতামূলক উৎপাদনের জন্য মানুষের উপর চাপ প্রয়োগ করা ছিল অত্যান্ত ক্ষতিকারন ও বিপদজনক পদক্ষেপ; এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম এই ধরনের বাধ্যতামূলক ভাবে কারখানা পরিচালনা, শ্রমিকদের স্পেশাল বাহিনী বা অন্য কোন প্রকারের সংস্থান করার  চরম বিরুধী। সিন্ডিক্যালিস্ট উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিকদের স্বাধীনতার গ্যারান্টি দেয়াই আসল উদ্দেশ্য । অর্থাৎ প্রতিটি মানুষ তার কাজের বিষয়ে পূর্ন স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে। মানুষ তার পছন্দ মত কাজ বাঁচাই করে গ্রহন ও পরিবর্তন করতে পারবে।

সামাজিক বিপ্লবের ফলে নতুন সমাজ, তার অস্তিত্বের প্রথম দিন থেকেই শ্রমের একীকরণ নিশ্চিত করার উপায়গুলি কি কি তা খুঁজতে হবে, যাতে এককথায় চেতনাগত এবং শারীরিকভাবে উভয়কেই  ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে । পুঁজিবাদী সমাজে শিল্প ও কৃষি শ্রমিকের মধ্যে সম্পূর্ণ আলাদাতা অবস্থান দেখা যায়, কিন্তু সিন্ডিকেটবাদী সমাজ দৃঢ়ভাবে শিল্প ও কৃষির সম্পকর্কের মধ্যে আরও ঘনিষ্ঠতা অর্জনের প্রচেষ্টা চালাবে এবং যার ফলে শ্রমিকরা কারখানা এবং জমিতে  বিকল্প কাজে যোগদান করতে সক্ষম হবে।

রাশিয়ার শিল্প প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতাটি দেখিয়েছে যে উৎপাদন কেন্দ্রিকীকরণের নীতিটি সমগ্র শিল্প যন্ত্রপাতির নীতিমালা, যা একটি সরকারী শ্রেণির উদ্ভবের দিকে পরিচালিত করে, উৎপাদকদের কাছ থেকে / সামাজিক অর্থনীতির প্রশাসনকে অপসারণ করার জন্য, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে চলমান সংকটের দিকে শ্রমিকদের স্বাধীন কার্যকলাপের বিরোধীতা করে এবং এই অভিজ্ঞতার কারণে,  এনার্কো-সিন্ডিক্যালস্টিগন কারিগরি কেন্দ্রীকরণ এবং প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ভিত্তিতে উৎপাদন প্রক্রিয়া নির্মাণ করবে।

এই ভাবে রাশিয়ার বিপ্লব আমাদেরকে নিজেদের ত্রুটিগুলি সংশোধন করে প্রাপ্ত সমস্যার সামাধান করে সামগ্রীক উৎপাদন ব্যবস্থায় একটি হ্রদয়তাপূর্ন পরিবেশ আনয়নের জন্য পরিবেশ তৈরী করে দিবে- এটা ছিলো প্রত্যাশা। এই অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে প্রমানিত হয়েছে; মহান চিন্তক ক্রপথকিন যেমন বলেছিলেন যে, “ কোন রাস্ট্রের পক্ষেই সামগ্রীক উৎপাদন ব্যবস্থার সুস্ট ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব নয়, ট্রেড ইউনিয়ন গুলো যদি দায়িত্ব গ্রহন না করে তবে বিপর্যয় অনিবার্য”। তবে অবশ্যই শ্রমিক শ্রেনীকে একমত করতে হবে যে তারা যেন বৃহত্তর জনগণের ব্যবহার উপযোগী পন্য উৎপাদন করেন । তাদেরকে উৎসাহিত করতে হবে যে, সকলেই যেন জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নে একেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করেন । মন্ত্রী পরিষদ ও নানা প্রকার কমিটির খেয়াল খুশিমত সিদ্বান্ত চাপিয়ে দেয়া নয় সত্যিকার জনগনের চাহিদার আলোকে সকল কিছু পরিচালিত হবে । তবে কাজের সুবিধার জন্য কমিটি থাকবে । তা হবে খুবই সরল সহজ প্রকৃতির । তা গঠিত হবে কৃষি খামারে আর শিল্প কারখানায় । সকল কমিটিই পরিচালিত হবে শ্রমিকদের ইচ্ছে অনুসারে” । আর তা চালিত হবে শ্রমিকদের স্বার্থে।

উপরোক্ত পরিস্থিতির আলোকে এনার্কো – সিন্ডিক্যালিস্টগন বিশ্বাস করেন যে, সামগ্রীক সামাজিক  পরিবর্তনের জন্য সমগ্র শ্রমিক শ্রেনীর লোকদেরকে অবশ্যই সচেতন করতে হবে। যাতে উৎপাদক শ্রেনী “ সামাজিক নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে উৎপাদন সংস্থান, উৎপাদনের নীতিমালা, ও এর সামাজিকিকরন এবং বিকেন্দ্রীকরণ প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিত অবহিত হবেন।  এই সকল কাজে নিয়োজিত থাকবে এনার্কো সিন্ডিক্যালিস্ট সংগঠন সমূহ । তাছাড়া উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সিন্ডিক্যালাইজেশন করবেন সকল শ্রমিক নিজেদের হাতে, আর এতে নেতৃত্ব দিবে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন, প্রতিটি কারখানা ও ফার্মকে একত্রিত করার জন্য শ্রমিক সংগঠন সমূহ ক্রমে ভোক্তা বান্দ্বব উৎপাদন পরিবেশ সৃজন করবেন”।

রাশিয়ান বিপ্লবের অভিজ্ঞতা বলে, সুসংগঠিত উৎপাদন ব্যবস্থার প্রতিটি উপকরন সাধারন ভাবে পরিবর্তন ও পরিমার্জন করতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে সিন্ডিক্যালাইজেশনের সময় প্রতিটি কর্ম যেন শ্রমিক বান্দ্বব হয় । প্রতিটি উৎপাদন কারী প্রতিস্টানই হবে তৃনমুলের সাথে সম্পর্কিত তারা উৎপাদনের ব্যবস্থাপনাকে ও সাধারন মানুষের নাগালের মধ্যে রেখে সামগ্রী উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবেন । প্রতিটি ফ্যাক্টরী পরিচালনার ক্ষেত্রে স্থানীয় শ্রমিকদেরকে ব্যবস্থাপনার জড়িত রাখাবে । উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া নীতির অবসান হবে ।

সাম্যবাদ সফল ভাবে প্রতিটি কারখানায় প্রতিস্টার জন্য, যথাযথ ভাবে প্রতিটি কারখানায় সুস্টুভাবে দক্ষতার সাথে কর্ম সম্পাদনের লক্ষ্যে, সকল প্রকার ব্যাক্তিগত উদ্যোগে স্থাপিত কলকারখানাকে একত্রিকরন করা হবে।  একেই সাথে সকল উৎপাদন কেন্দ্র যেন গুন ও মান বজায় রেখে উৎপাদন করতে সেই বিষয়িটি নিশ্চিত করা হবে। এই একত্রিকরন করার ক্ষেত্রে কোন ভাবেই ব্যাক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হবে না, সেই জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত, প্রশাসনিক, তথ্যগত সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে সামগ্রীক উৎপাদন ব্যবস্থাপনাকে একেই কমান্ডের আওতায় নিয়ে আসা হবে । ( ক্রপথকিন, পৃস্টা-২৩)

এই পদ্বতীটি বাস্তবায়নের জন্য নিম্নলিখিত পন্থা অনুসরন করা হবেঃ

১। স্বব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ফ্যাক্টরী – কমিউন চালাবে

২। কমিউনের উৎপাদক পরিষদের ফ্যাক্টরী

৩। ইউনিয়নের উৎপাদক পরিষদ

৪। সাধারন শ্রমিকদের কংগ্রেস ( জনগণের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক)।

সকল উৎপাদন প্রক্রিয়াটা সংগঠিত করা হবে উক্ত ব্যবস্থাপনাগত নীতিমালার আলোকে, যেকোন সময়ে রি-কল বা ফেরত নেয়া যায় এমন প্রতিনিধিগনের মাধ্যমে সকল ব্যবস্থাপনা ও নির্দেশনা বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষন করা হবে । আভ্যন্তরীণ শৃংখলা ও সামগ্রী ব্যবস্থাপনায় যেন কোন প্রকার ব্যাঘাত না ঘটে সে দিকে সবিশেষ নজর রাখা হবে ।

রাশিয়ার বিপ্লবের অভিজ্ঞতা আমাদের শেখায় যে, বৈজ্ঞানিক ও উৎপাদনের সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্বির কাজ অব্যাহত থাকবে, যতক্ষন পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেনী অধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে সক্ষম না হয়ে উঠবেন। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার উত্তরাধিকার হিসাবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গীগত দিক গুলোতে  সংকির্নতার প্রশ্রয় পাবে না । প্রচলিত সমাজের বুদ্বিবৃত্তিক লোকেরা বিপ্লবের পর ও তাদের স্ব স্ব কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারবেন, তাদের অধিকার কোন ভাবেই সীমিত বা ক্ষুন্ন হবে না । তবে সামাজিক উত্থানের সূচনা থেকে সকলের সমান অধিকার বজায় থাকবে ।

এটা সত্য যে সূচনা লগ্নেই সাম্যবাদকে সামগ্রীক ভাবে অনুসরন  করা যাবে না; “ চাহিদা মত বিতরন” এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ কিছু পদক্ষেপ গ্রহন কর দরকার হয়ে পড়বে ।

প্রাথমিক ভাবে সকলের জন্য যে নীতিটি বাস্তবায়ন করা হয়ে তা হলো ; “ সকলের জন্য সমান অংশীদারীত্ব”। সমান অংশীদারিত্ব উৎপাদনের ব্যাপক গতি নিয়ে আসবে, সিন্ডিক্যালিস্ট শিল্পে তা ব্যাপক ভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। ছোট ছোট পদক্ষেপের মাধ্যমে সর্বস্তরে এই পদ্বতী চালু করা হবে; প্রত্যেকের জন্য তাদের চাহিদার আলোকের বিতরন করার নীতি বজায় থাকবে।

সকলের জন্য সমান অংশীদারিত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে যারা যার উপর  নির্ভরশীল তাদেরকে অনুপুরক সাহায্য দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে । রেশনিং ব্যবস্থায় পরিমান ততই বাড়বে , কমিউনের উৎপাদন যতই বাড়বে ।  এছাড়া কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র শিল্প সম্পর্কে এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্টগন সকল কিছু  তাৎক্ষনিক ভাবেই সমন্বিত করে বিশাল আকারে উৎপাদনে যাওয়ার বিষয়ে উৎসাহী নয়। তবে, পারস্পরিক সহযোগিতা, একে অন্যের সাথে মিলে মিশে কাজ করার পরিবেশ তৈরী করা হবে। সকলেই স্বাধীন সিদ্বান্ত গ্রহন করে নিজেদের কাজ করার পূর্ন সুযোগ পাবেন । এনার্কো- সিন্ডিক্যালিস্টগন সকল সময়েই চেষ্টা করে নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প গুলোকে একত্রিত করতে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সহায়তায় তাদের উৎপাদন ও সামগ্রীক ব্যবস্থাপনার বিকাশ ঘটাতে। প্রগতির ছুঁয়া ছাড়া সামগ্রীক উন্নয়ন সম্ভব নয়।

দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ মৌলিক শিল্পসমূহঃ

১। কৃষি

কৃষি হল মৌলিক শিল্পের একটি খুবই গুরুত্বপূর্ন শাখা, এটা শুধুমাত্র এইজন্য নয় যে এই কর্মে বেশী সংখ্যক মানুষ জড়িত। এটার বড় কারন হলো এই শাখাটি জাতীয় জীবনে বিশাল অবদান রাখে ।

সাম্যবাদের ভাগ্য ও অনেকাংশেই কৃষির উপর নির্ভর করে । এই খাতটি সাম্যবাদি ধারায় রূপান্তর করতে সময় যেমন বেশী আগে তা আবার জটিল ও বটে। এই খাতে পুঁজিবাদের চেতনা প্রবল, এই খানে প্রযুক্তির ব্যবহার ও শ্রমিকদের সামাজিকিকরনের মধ্যে তা স্পস্টভেবে দৃশ্যমান । সেই কারনেই কৃষি উৎপাদন খাতটি সাংগঠনিক ও প্রকৌশলগত দিক থেকে পশ্চাৎ পদ হয়ে আছে । তাই প্রায় দশ মিলিয়ন কৃষকের সমাহার আজো সংগঠিত হতে পারেনি, ব্যাক্তি কেন্দ্রীক, ক্ষুদ্র মালিকানার স্থরে রয়ে গেছেন,  অন্যদিকে প্রকৌশলগত পশ্চাৎ পদতার কারনে সাম্যবাদের পথে এদেরকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া ও বেশ কঠিন কাজ । তাই কঠিন বাস্তবতা হলো তাদের জমির মালিকানার বদল, প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার, উন্নত চাষাবাদ, প্রবর্তন করার জন্য অধিকতর সময় ব্যায় করতে হবে ।

পুঁজিবাদ, ব্যবসায়ীক ভাবে ব্যাক্তিদেরকে একত্রিত করে, তাদের শ্রমকে সামাজিকি করন করে যাচ্ছে, যা সাম্যবাদি সমাজ বিনির্মানের জন্য এক ধরনের প্রস্তুতীর কাজ ও সাম্যবাদি উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলার জন্য সহায়ক । এইটি যান্ত্রিকতায় পূর্ন সাম্যবাদি সংস্থা ও মালিকানার একটি ধরন – এই কারখানা গুলো আগামীদিনের জন্য মুক্ত উৎপাদন ব্যবস্থার প্রাথামিক পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করা যায়। প্রথামিক পর্যায়ের শিল্প উৎপাদনকারী প্রতিস্টান সমূহ সাম্যবাদি প্রকৃতির এবং সিন্ডিক্যালিজমের জন্য পুঁজিবাদ ও রাস্ট্রের বিপরীতে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির পথে এগিয়ে যাবার পথ  তৈরী করছে। সামাজিক শ্রম মালিকানা সিন্ডিক্যালিস্ট সাম্যবাদের উদাহরন হিসাবে পরিগনিত হয়।

এই ধরনের পরিস্থিতি কৃষি ব্যবস্থা থেকে অনেক পৃথক। এই খাতে পুঁজিবাদের সামাজিকি করনের প্রক্রিয়াটি একেবারেই অনুজিবাদেরেই খাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষকের সংখ্যাই অধিক, ব্যাক্তিগত আলিকানা, ব্যাক্তিগত শ্রমের বিনিয়োগ ই বেশী চোখে পড়ে। এই গুরুত্বপূর্ন দিক গুলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে সাম্যবাদী সমাজে রূপান্তরিত  হওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাঁধা হিসাবে কাজ করে ।

শিল্প কারখানায় শ্রমিক শ্রেনীর লোকদেরকে একত্রিত করে দেয়। যা যৌথ মালিকানা গড়ে তুলার জন্য উপযোগী। তবে কৃষি ফার্মের ক্ষেত্রে ও যৌথ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে যৌথ মালিকানা ও গড়ে তুলা সম্ভব ।

কৃষি খাতে যৌথমালিকানা নেই, তবে, তা শ্রমের যৌথতাকে স্পষ্ট করে তুলতে পারে, মিলিয়ন মিলিয়ন কৃষি ক্ষেত্রের ব্যবস্থাপনা প্রাচীন নিয়মেই চলছে। তা ও নানা ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । তা এখনো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্বি করা যায়নি। তবে যৌথ মালিকানা শ্রমের যৌথতা নিশ্চিত করতে পারবে । যা নিবিঢ়ভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে অনেক শক্তিশালী করতে পারবে, উৎপাদন বাড়িয়ে কমিউনের সকল মানুষের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। সাথে সাথে প্রাচীন উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে নয়া সামাজিক কাঠামোর উদ্ভব ঘটাবে। তবে এই কর্মকান্ড কোন ভাবেই ডিক্রী জারি করে সম্ভব নয় তা করতে হবে ক্রমান্বয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করে। আর সেই প্রক্রিয়াটি সম্পাদন রাতারাতি করা সম্ভব নয় তার জন্য দরকার কিছু পদিক্ষেপ গ্রহন করা ।

কৃষিকে সামাজিকিকরন করা দুইটি উপাদানের উপর নির্ভরশীলঃ

১। উৎপাদনের প্রধান মাধ্যমকে সামাজিকি করন। যেমন- জমি ।

২। শ্রমের সামাজিকি করন ।

ভূমির সামাজিকিকরন হলো একটি বিপ্লবী পদক্ষেপ এবং এই পদক্ষেপ সফল হয় বাধ্যতামূলক আইনের মাধ্যমে; শ্রম শক্তিকে সামজিকিকরন হলো একটি প্রক্রিয়া মাত্র, এই ধরনের কার্যক্রমের জন্য যে সামাজিক প্রস্তুতি দরকার এখনো সম্পন্ন হয় নাই। তবে অবশ্যই সামাজিক ভাবে যৌথতা বিষয়ে সচেতনতা সৃজনের মাধ্যমে মালিকানার ধারনা পাল্টাতে হবে এবং সমাজবাদের জন্য অনুকুল পরিবেশ তৈরী করতে হবে ।

কৃষির যৌথতা, একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয় তা কোন ঘটনা চক্রে হবার কথা নয় । তা হতে হবে পরিকল্পিত ও জন অংশ গ্রহনের ভেতর দিয়ে । আর সেই কারনেই এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম যে কার্যক্রম গ্রহন করেছে তাতে দুইটি বিষয় যুক্ত রাখতে হবে বলে জোর দিচ্ছেঃ জমির সামাজিকিকরন ও শ্রমের সামাজিকি করন ।

১। জমির সামাজিকি করন

১। জমির সকল প্রকার মালিকানার অবসান করতে হবে – ব্যাক্তিগত, দলীয়, সমবায়, সামরাদায়িক, পৌরসভা বা রাস্ট্রের যাই হোক না কেন তা জনগণের সম্পত্তি হিসাবে স্বীকৃত হবে ।

২। জমিকে সামাজিকি করনের ফলে জমি পন্য হিসাবে বাজার থেকে প্রত্যাহার করা হবে; জমি কেহ ক্রয় করতে, বিক্রয় করতে, ভাড়া দিতে পারবে না । সকলেই জমিতে ব্যাক্তিগত ভাবে বা যৌথ ভাবে কাজে নিয়োজিত হবেন।

৩। প্রতিটি ব্যাক্তি জমিতে সমান অধিকার  লাভ করবেন, সমভাবে নিজের স্বাধীন শ্রম বিনিয়োগের জন্য অধিকার পাবেন।

৪। জমির প্রাপ্যতা সাপেক্ষে প্রত্যেক্যে  সমপরিমাণ জমি ব্যবহারের জন্য প্রদান করা হবে। এই বিষয়ে সিদ্বান্ত নিবে জাতীয়  কৃষক কংগ্রেস। যা গঠিত হবে সাধারন শ্রমিক কনফেডারেশনের অংশ হিসাবে ।

৫। প্রতিটি শিল্প কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন সমূহ তা পরিচালনার দায়িত্ব নিবে, অন্য দিকে জমির সামগ্রীক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিবে কৃষক সমতি।

২। শ্রমের সামাজিকি করনঃ

১। ভূমির সামাজিকি করন হলো কৃষি শ্রম সামাজিকিকরনের প্রাথমিক শর্ত । যে ক্ষেত্রে কেবল শ্রম ও মালিকানা সামাজিকিকরন করা হয়, সেই ক্ষেত্রে উৎপাদনের হার কমে যেতে পারে। তাই সত্যিকার সাম্যবাদের জন্য সামগ্রীক ভাবে সব কিছুই সামাজিকিকরনের জন্য কাজ করতে হবে ।

২। যে সমাজটি বিপ্লবের ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসে, তা ক্রমে উৎপাদন ব্যবস্থাকে সামাজিকি করন করা হয়, এই সমাজের  কৃষি ব্যবস্থাকে ও সমান গুরুত্ব দিয়ে সাম্যবাদের আদর্শে রূপায়ন করার কাজ চলতে থাকে। গ্রামীন ও শহরের জনসংখ্যার মাঝে সামঞ্জস্য বিধান করে একটি ভারসাম্য পূর্ন পরিবেশ গড়ে হয়। ক্রমে পুরাতন ও প্রচলিত ব্যবস্থা ও প্রতিস্টানের বিলুপ সাধন করা হয় ।

৩। সামাজিকিকরন কৃত কৃষিব্যবস্থা সাম্যবাদি কৃষি ব্যবস্থার সাথে সম্পূর্ন ভাবে একাকার হয়ে যেতে পারে। বিপ্লবের সূচনা থেকেই কৃষি সংগঠন সমূহ সাম্যবাদি কার্যক্রমের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হিসাবে পরিগনিত হবে ।

কৃষিতে সাম্যবাদের প্রয়োগ প্রক্রিয়ায় এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের দৃষ্টি ভঙ্গী হলো ছোট কৃষকদেরকে বিলুপ্ত না করা বা কেবল বড় বড় কৃষি ফার্ম স্থাপন না করা । তারা মনে করে মানুষের উপর বাধ্যতা মূলক শ্রম চাপিয়ে দেয়া প্রতিক্রিয়াশীলতার নামান্তর। তাই, সকল শ্রম শক্তিকে এক একটি ক্ষদ্র ইউনিট হিসাবে বিবেচনায় নিয়ে স্বেচ্ছাকৃত ও স্বাধীন বিষয় হিসাবে বিবেচনা করে সাম্যবাদি ধারায় প্রবাহিত করার প্রয়াস চালায়।

এভাবেই অর্থনৈতিক ইউনিট গুলো রূপান্তরিত হবেঃ ক) সমবায় ভিত্তিতে সচেতন ভাবে কৃষি সংশ্লিষ্ট জনগণকে ক্রমে ব্যাক্তিগত সম্পত্তির ধারনা থেকে বেড় করে যৌথ মালিকানার ধারনায় উন্নিত করা হবে । খ) কৃষি খামারের যৌথ করনের পাশাপাশি  উৎপাদনকারী কল কারখানা সমূহকে এবং অন্যান্য সামগ্রীক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সাম্যবাদি ধারায় নিয়ে আসতে হবে ।

৪) সুদক্ষ ভাবে কৃষি উৎপাদন পরিচালনার জন্য কৃষি খামার গুলোকে খুব বেশী বড় আকারে তৈরী করা হবে না । সাধারন ভাবে সেই সকল খামারকে  দশ জন কৃষক দিয়ে গড়ে তুলা হবে। যারা পাশা পাশি অবস্থানে আছেন তাদেরকেই প্রাধান্য দেয়া হবে । তবে স্থান বিশেষে এর সংখ্যা  কম বেশী হতে পারে । তবে সকলের পরিবার ও পারিবারিক কার্যক্রমকে একত্রিত করা হবে না । পরিবার গুলো পৃথকই থাকবে।

৫) কৃষি কার্যক্রমের আওতায় অন্তর্বত্তীকালিন সময়ে তিন ধরনের সংগঠন থাকবেঃ  ক) স্বতন্ত্র  খ) সমবায় এবং গ) সাম্যবাদি । স্বতন্ত্র ধারার সংগঠন সমূহ প্রথমিক ভাবে তেমন উল্লেখ যোগ্য ভাবে গড়ে তুলা হবে না ।

৬) ব্যাক্তিগত পর্যায়ের  অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে খুবই দ্রুত ও সফল ভাবে রূপান্তরের কাজ করা হবে । এছাড়া  অন্যান্য ভোগ্যপন্য-উৎপাদন কার খানা গুলোকে ও ব্যাক্তিগত অবস্থা থেকে যৌথ ব্যবস্থার দিকে যৌক্তিক সময় ও পদ্বতী অনুসরন করে অর্থনীতিকে সামাজিকি করনের মাধ্যে সাম্যবাদ কায়েম করা হবে । সেই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দুই ধরনের পদ্বতী অনুসরন করা হবে। ক) আক্রমনাত্মক এবং খ) রক্ষণাত্মক ।

১। আক্রমনাত্মক ব্যবস্থায় কৃষি শ্রমিকদেরকে সরাসরি কাজে নিয়োগ দেয়া হবে এতে থাকবেঃ

১। যারা ইতিমধ্যেই কৃষি কাজে জড়িত আছেন তাদেরকে সেই কাজেই রাখা হবে, তবে তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্বির পদক্ষেপ নেয়া হবে। একেই ধারায় সামিজিকিকরনের কাজ হবে কল কারখানায় ।

২। যে সকল ব্যবসা বানিজ্য কৃষি পন্য নিয়ে কাজ করছে তাদেরকে সাম্যবাদি ধারায় রূপান্তরিত করা হবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে ও একেই পদ্বতী অনুসরন করা হবে ।

৩। কৃষি ভিত্তিক শিল্প সমূহের সামাজিকি করন ও সমবায়ী করনের নিবিঢ় ভাবে সম্পাদন করার জন্য যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করা হবে। যেমন- চিনি, টেক্সটাইল, সিগারেট, এবং নানা প্রকার ফলের জুস ইত্যাদিকে সাধারন ভাবে সাম্যবাদি ধারায় রূপান্তর করা হবে ।

৪। বড় আকারের আটা-ময়দার কল এবং সিরামিক্সের কারখানা ও সাধারন প্রক্রিয়ায় সামিজিকি করন করা হবে।

৫। চাষাবাদ যোগ্য জমির উন্নত চাষাবাদের জন্য সমিতি উদ্যোগ নিবে।

৬। পুর্নাংগ সাম্যবাদি সমাজ গড়ে তুলার জন্য কৃষিতে পুর্বিন্যাস সাধন করা হবে ।

৭। কৃষিকে শিল্প ভিত্তিক খাত হিসাবে রূপান্তর করা । কৃষি পন্যকে কারখানার সাথে সমন্বয় সাধন করা। উপযুক্ত কৃষির জন্য উপযুক্ত এলাকা নির্বাচন এবং উপযুক্ত কারখানা স্থাপন করে উৎপাদন বৃদ্বি করা । যেমন- চিনি, ফলমূল, শাক সবজি, মদ, সিগারেট, বিয়ার ইত্যাদি। কৃষি ভিত্তিক কল কারখানা ও কামার গড়ে তোলে সাংগঠনিক পদ্বতী অনুসরন করে উৎপাদন ব্যবস্থায় নবযুগের সূচনা করবে । তাই বিশেষ কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করা হবেঃ

১। সাম্যবাদি শিল্পের উদ্যোগতাগন তাদের নিকটবর্তী ব্যাক্তিগত উদ্যোগ সমূহকে সহযোগিতা করার প্রায়স চালাবেন। কৃষি ভিত্তিক সমাবায় গুলোকে শক্তিশালী করে রাশিয়ার ক্রিমিয়ারী সমাবায় সমূহের মত করে গড়ে তুলা হবে ।

২। কম্পোজিট কৃষি-শিল্প গুলোকে পরস্পরের সাথে একটি সংযোগ সৃজন করতে হবে। যেন কার্মীগন মৌসুম ভিত্তিক কাজ করতে পারেন। যখন কৃষিতে কাজ কম থাকবে তখন তারা শিল্পে সময় দিবে এবং যখন কৃষি শিল্পে বেশী কাজ থাকবে তখন শিল্প শ্রমিকগন সেখানে গিয়ে প্রয়োজন অনুসারে সময় দিয়ে কাজ করবেন ।

৩। পারস্পরিক  সহযগিতা মূলক চেতনায় লালিত শ্রমিক কর্মীগন  নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে নিজেদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখবেন। সেই সহযোগিতা অনেক সময় কয়েক দিন, কয়েক ঘন্টার জন্য কর্ম বিনিময়ের ব্যবস্থা রাখা হবে । যাতে খামার ও শিল্পের মধ্যে একটি সংযোগ দৃড়ভাবে গড়ে উঠে ।

২। সুরক্ষামূলক ব্যবস্থাগ্রহন করা । যেমন – মিলিয়ন মিলিয়ন ব্যাক্তিগত ফার্মের সাম্যবাদি  অর্থ ব্যবস্থায় অব্যস্থ করে গড়ে তুলার লক্ষ্যে নিবিড় ভাবে কাজ করে সমবায় বিত্তিক ধারায় নিয়ে এসে ক্রমে সাম্যবাদি ব্যবস্থায় রূপান্তর করতে হবে ।

আত্মরক্ষামূলক পদ্বতী সমূহ সকল সময়েই পরিবর্তনকালিন কিছু সময়কে কাজে লাগায়, সেই সময়ে প্রতিটি প্রতিস্টানকে নতুন ভাবে ঢেলে সাজানোর জন্য বা কিছু প্রতিস্টানকে বিলুপ্ত করার লক্ষ্যে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করে থাকে। সেই গুলোকে সত্যিকার স্বাধীন ভোক্তা উৎপাদকে রূপান্তর করে দেয় । তবে তা কোন ভাবেই পুঁজিবাদের আওতায় পরিচালিত সমবায়ের মত নয়। সকল পরিবর্তনের লক্ষ্যই হলো সত্যিকার সাম্যবাদের দিকে চালিত করা । স্থানীয় উদ্যোগে যৌথতাকে উৎসাহিত করা ও ফেডারেটিভ সংস্কৃতির বিকাশ সাধন করা ।

অন্তবর্তী কালিন সময়ে সমবায় ভিত্তিক কৃষকদের কাজ হবে তাদের চার পার্শের ব্যাক্তিগত খামারিদেরকে জাতীয় অর্থনীতির মূল ধারায় সম্পৃক্ত করা। তাদেরকে ক্রমে প্রকৃতিক জীবনের সাথে অভ্যস্থ করে যৌথ খামারের রীতিনীতির সাথে সম্পৃক্ত করে গড়ে তুলা । শোষণ মুক্ত পরিবেশে বিকশিত হবার পরিবেশ  তৈরী  করে দেয়া ।

যৌথ খামারের মৌলিক ও প্রাথমিক ভিত্তি হবে গ্রামীন কৃষি সমিতি, তারা উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয় সহ সকল কর্ম সম্পাদন করবেন। প্রযুক্তিগত যন্ত্রপাতি সহ সকল আধুনিক উপকরনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ও তাদের উপরই অর্পিত হবে। গ্রামীন সমিতির ফোরাম সমূহ সারাদেশের কউন্সিলের সাথে যুক্ত হবেন তাদের মাধ্যমেই সামগ্রীক ব্যবস্থাপনার জন্য পরিচালনা পরিষদ গড়ে উঠবে। এই পরিষদ সাম্যবাদি সমাজের বিনির্মানে নেতৃত্ব দিবেন। যাদের কাজ হবে  সকল মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধিনতা নিশ্চত করা ।

কৃষি ঋন ও পন্য সরবরাহের জন্য কৃষি ব্যাংক স্থাপন করবে সাম্যবাদি অর্থনীতি, তাদের কাজ হবে কৃষি সংস্থা সমূহকে সহায়তা করা। এই ব্যাংক সমূহ কৃষি ঋন প্রদানের পাশা পাশি পন্য আদান প্রদান করবেন স্থানীয়, আঞ্চলিক, দেশ ও বিদেশে। যাতে সামগ্রীক ভাবে কোথাও কিছু অভাব অনুভূত না হয় ।

যেহেতু গ্রামীন সমিতি গুলো মৌলিক ফোরামের ভেতর থেকেই বিকশিত হবে, সেহেতু, তারাই জমির বন্ঠন করার কাজ সহ পরস্পরের মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রায়স চালাবেন । প্রত্যেকের কার্যক্রম নির্ধারন ও সীমা ঠিক করে দিবেন। স্ব স্ব ক্ষেত্রে সকলেই যেন মুক্ত ভাবে সৃজনশীলতার সাথে কাজ করতে পারেন ।

পশু পালনঃ

অন্যান্য চাষাবাদের মত গরু ছাগল পালন করা ও প্রতিটি দেশের জন্য  একটি গুরুত্বপূর্ন কাজ, সারা দুনিয়ায় এমনটি ব্যাপক ভাবেই হয়ে থাকে । কোন সমাজ বা দেশ যখন বিপ্লব সাধন করে তখন এই জাতীয় কাজের গুরুত্ব আরও অনেক বেড়ে যায়। কৃষি কাজের সাথে পশু পালন করার কাজটি কেবল যুক্ত করলেই হবে না । তার আরও বিকাশের জন্য অধুনিক পথ ও পন্থা খোজে দেখতে হবে । অধিক হারে উৎপাদন করে মানুষের চাহিদা মেটানো একটি গুরুত্বপূর্ন লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।

পশু পালনের যে খামার গড়ে তুলা হবে তা যেহেতু কৃষি খামারের সাথেই যুক্ত থাকবে তাই এটাকে ও প্রথমিক স্তরে বানিজ্যিক ভাবে উন্নয়ন করা হবে। এই খামারের মধ্যে থাকবে মাংশ, দুধ, মুরগী ইত্যাদি। এইসকল খামার ও সামাজিকি করন করা হবে ।

সামগ্রীক কৃষি ব্যবস্থার সামাজিকি করনের আগে, পুশুপালন প্রকল্প সমূহকে একটি পদ্বতীর আওতায় নিয়ে  আসতে হবে, তাদের প্রজনন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সমবায় এবং শিল্প সমূহ পশু পালন ব্যবস্থাকে আরও শক্তি শালী করবে ।

গরুর প্রজনন ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য তাকে কৃষি শিল্পের সাথে সমন্বয় করা হবে, শিল্প কারখানাকে যে প্রক্রিয়ায় সামাজিকিকরন করা হয়েছে তেমন পশু পালন পদ্বতীকে ও বিশেষ ভাবে গড়ে তুলা হবে । এখানে গরুর উৎপাদন, মোটাতাজাকরন, জবাইকরন ঘর নির্মান, মাংশ কাটা ও প্যাকেটিং করা, এবং চাহিদা মোতাবেক সরবরাহ করা ইত্যাদি কাজ খুবই দক্ষতার সাথে সম্পাদন করা হবে ।

তবে আদিবাসি যারা পূর্ব থেকে গরু ছাগল ভেড়া সহ নানা প্রকারের জীব জন্তু পালন করে এসেছে তাদেরকে চাপ দিয়ে এই আধুনিক পদ্বতীতে আনা হবে না । তাদেরকে তাদের মতই কাজ করতে দেয়া হবে । চিন্তা চেতনায় যখন তারা আধুনিক পদ্বতী গ্রহনের স্তরে উন্নিত হবে তখনই কেবল তাদেরকে সামাজিকিকরনের মূল ধারায় যুক্ত হবে । তবে তাদের মধ্যে সমবায় পদ্বতী ও সাম্যবাদি অর্থনীতির সুফল সমূহ তোলে ধরা হবে । কৃষি ব্যাংক সমূহ তাদেরকে অর্থ ও পন্য সহায়তা দিয়ে যাবে। তাদের এলাকা সমূহে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য রাস্তা ঘাট নির্মান করে দেয়া হবে।যাতে তারা সহজেই শহর নগরের সাথে যুক্ত হয়ে নিজেদের উৎপাদিত পন্য ক্রয়বিক্রয় করতে পারেন। এমন কি দূর দূরান্ত থেকে যারা আসবেন তাদের জন্য পথে থাকা-খাওয়ার সু ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।

গবাদি পশুপালন ও শাক-সব্জিবাগানঃ

যেহেতু,  শাক-সব্জির বাগান কৃষি কাজের থেকে বিচ্ছিন কোন খাত নয়, তাই যে সকল সবজি বাগান বানিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে সেই গুলিই সামাজিকি করন করা হবে । সামাজিকি কৃত খামার গুলিকে ও আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজানো হবে। সকল প্রকার বৈজ্ঞানিক কলা কৌশল ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্বি করা হবে । যাতে সকলের চাহিদা মেটানো যায়।

বনজ সম্পদঃ

বনজ সম্পদ ও একটি মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ । যে সকল খালি জমি আছে তাতে ব্যাপক ভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্বতীতে বনায়ন করা হবে । এই বনে উৎপাদিত সকল সম্পদ সকলের স্বার্থে ব্যবহার করা হবে ।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কাস্ট অর্থনীতিতে বরাবরই লুট পাট চলে এসেছে, ফলে নানা দেশের বন বিভাগ বিনষ্ট হয়েছে। কিন্তু আমাদের ভূমির মাটি ও আবহাওয়া বা জলবায়ুর সুরক্ষার জন্য বনজ সম্পদের বিকাশ ও রক্ষণ করা অতিব জরুরী বিষয়। বনজ সম্পদ কেবল নির্মান শিল্প বা জ্বালানীর উপকরন নয় বরং অনেক উৎপাদক কারখানার গুরুত্বপূর্ন উপাদান সরবরাহ কারী । এটা কেবল জীব জন্তু আর পাখীর আধার নয় বরং তা থেকে নদি নালার উৎপত্তি হয় এবং মাটির আদ্রতা রক্ষায় বিশাল ভূমিকা পালন করে থাকে । যা কৃষি কাজের জন্য অতিব জরুরী বিষয় । তাই সামগ্রীক কল্যানার্থে বনজ সম্পদের সুরক্ষা দরকার। বনজ সম্পদকে অবশ্যই সামাজিকি করনের আওতায় আনা হবে। সকল প্রকার ব্যাক্তি ও রাষ্ট্রীয় মালিকানার বসান ঘটাতে হবে। এটাকে করা হবে সামাজিকিকরনের মাধ্যমে একটি  অবানিজ্যিক উদ্যোগঃ এই সম্পদ কেহই বিক্রি বা ক্রয় করতে বা ভাড়া দিতে পারবে না ।

কৃষি ভিত্তিক জেলা গুলোতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বন ভূমি গড়ে তুলা হবে, তা কোন ভাবেই সামাজিক শিল্প গুলোর দ্বারা নষ্ট করার সুযোগ দেয়া হবে না, সেই বন ভূমি গুলো কৃষক সমতির নিয়ন্ত্রনে দিয়ে দেয়া হবে । দরকার হলে জ্বালানী না নির্মান কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে । অন্যান্য বন ভূমি গুলো সিন্ডিক্যালিস্ট পদ্বতীতে সাম্যবাদি অর্থনীতির আওতায় সামগ্রীক ব্যবস্থাপনার জন্য ফেডারেশনের নিকট ন্যস্ত হবে ।

যদি কোন অঞ্চলে কাঠের অভাব হয় তবে সামাজিক বনজ সম্পদ থেকে সমাবায় ও ব্যাংকের মাধ্যমে তা পুরনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে ।

বনজ সম্পদ সামাজিকি করনের ফলে বনায়ন ও কাঠ শিল্প ব্যাপক ভাবে মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করে তুলা হবে। যে সকল কাঠ শিল্প গৃহ সজ্জার কাজে জড়িত তাদেরকে সমন্বিত করে সমাবায় ভুক্ত করা হবে। ক্রমে তাদেরকে সাম্যবাদি ধারায় যুক্ত করে নেয়া হবে । কাঠ শিল্পলের সাথে সম্পর্কিত বন ভূমি কৃষি খামার ও পশুখামার  ইত্যাদির মধ্যে একটি চমৎকার সমন্বয় সাধন করা হবে । যারাএই কাজে উৎসাহী ও দক্ষ তাদেরকে  বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দিয়ে তাদের শ্রমের সত্যিকার মর্যাদা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে ।

মাছের চাষ ও শিকারঃ

ক) মাছের চাষ

সাম্যবাদি অর্থনীতিতে সকল জলাশয় ও জসলজ সম্পদ জাতীয় করন করা হবে । মাছের চাষ ও ক্রয় বিক্রয় এই প্রক্রিয়ায় সম্পাদন করা হবে । ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাষীদেরকে  প্রথমে সমবায়ের আওতায় আনা হবে । পোনা উৎপাদন ও মাছ ধরার জন্য বিশেষ দল কাজ করবেন। মাছের নানা প্রজাতির সুরক্ষার জন্য উপযুক্ত স্থান সমূহে মাছের জন্য অভয়ারণ্য স্থাপন করা হবে।

খ) শিকার

সাম্যবাদি বনাঞ্চলে শিকারের ব্যবস্থা ও রাখা হবে। সমবায় সমিতি সমূহ সেই ব্যবস্থা করবে। সেই ব্যবস্থা করার জন্য ক্রয় ও বিক্রয় কমিটি এবং ব্যাংক সমূহ নগদ অর্থ ও পন্য বা উপকরন দিয়ে সহায়তা দান করবে । আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিশেষ ভাবে  শিকারের অংশ নিতে পারবে । নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় বনাঞ্চল ও শিকারের স্থান সমূহ সংরক্ষন করা হবে ।

খনিজ শিল্পঃ

উৎপাদন শিল্পের মতো খনিজ সম্পদ নিষ্কাশন সম্পর্কিত শিল্পের সেই শাখাগুলি পুঁজিবাদী বিকাশের আওতায় পড়েছে, যা সামাজিকীকরণের পক্ষে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে এবং সাধারণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তাদের গুরুত্ব সত্যিই বিশাল যে তাদের সামাজিকীকরণ অনুজ্ঞাসূচক. সেই কারণে সাম্যবাদি সমাজকে সামাজিক বিপ্লবের প্রথম থেকেই খনিজ সম্পদগুলিকে সম্পূর্ণ সামাজিকীকরণ থেকে ঘোষণা করতে হবে।

১।  দেশের সকল বৃহৎ শিল্প কারখানা গুলোকে সাম্যবাদি অর্থনীতির স্বার্থে সিন্ডিক্যালাইজেশন করে নিতে হবে।

২। সাম্যবাদি অর্থনীতির অনুকূলে সকল প্রকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুটির শিল্পকে সমবায়ের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

৩। খনির শিল্পের বিভিন্ন শাখার শিল্পায়ন, যেমন সমন্বিত শিল্পের ভিত্তিতে যৌথ ইউনিটগুলির  মাধ্যমে রাসায়নিক, ধাতব ও অন্যান্য প্রক্রিয়াকরণের শিল্পের শাখার সাথে তাদের একীকরণ করতে হবে।

৪। শিল্প সম্পর্কিত উৎপাদন শাখার শিল্পায়িত ও অ-শিল্পিত উদ্যোগের গ্রামীণীকরণ, যেমন যৌগিকভাবে কৃষির সাথে তাদের ঐক্যবদ্ধতা ক্রমশ একীকরণের নীতির ভিত্তিতে আশেপাশের কৃষির জনসংখ্যা ও শ্রম সংগঠিত করে তাদের অর্থনৈতিক কক্ষপথে আঁকড়ে ধরে রাখার কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে।

৫। প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের কারখানার মতোই খনিজ সম্পদ উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় বিশেষ বিবেচনায় রাখা হবে। সমিতির  উত্পাদন কমিটির দ্বারা শিল্প কারখানা পরিচালিত হবে।

অধ্যায়ঃ ৩ পাবলিক সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রিজ

১। দালান কোটাঃ

বিপ্লবের সাথে সাথে অন্যান্য উৎপাদন কেন্দ্র সমূহের সামাজিকি করনের পাশাপাশি বড় বড় দালান কোটাকে ও সামাজিকি করন করা হবে ।

সমগ্র দেশে বড়ী ঘর নির্মানের জন্য নির্মান সমিতি সামগ্রীক নির্মান কর্ম সম্পাদন ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করবে। নির্মান শ্রমিক সমিতির সমবায় ও পল্লী গৃহ নির্মান সমিতি সমন্বয়ের মাধ্যমে সকল নির্মান প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।

নির্মান কার্যের সুবিধার জন্য ব্যাংক প্রয়োজনীয় ঋন সুবিধা প্রদান করবে।

২। গৃহায়ন সমস্যা

গৃহায়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক সমস্যা রয়েছে, ফলে গৃহ ব্যবসা নিয়ে ফটকা কারবার চলে, যত দ্রুত সম্ভব এই খাতকে সামাজিকি করন করা হবে, বসবাসের জন্য গৃহ নির্মান করা হবে অলাভজনক প্রকল্প হিসাবে ।

যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরন করে বাস গৃহ বিতরন করা হবে, সেই জন্য বন্দবস্ত প্রাপ্ত ব্যাক্তিদের কোন প্রকার ভাড়া বা মূল্য পরিশোধ করতে হবে না । প্রয়োজন মত হোটেল বা বোর্ডিং নির্মান করা হবে । এই সামগ্রীক কর্মকান্ড গৃহ নির্মান ও ব্যবস্থাপনা কমিটি এই কার্য সম্পাদন করবে।

গৃহ নির্মান প্রকল্পে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ যেন সুবিধা নিতে পারেন তার জন্য শহর ও গ্রামে কৃষি ও শিল্প কারখানার মাঝে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে ।

৩। পরিবহন খাত

সকল প্রকার পরিবহন খাত, বিশেষ করে রেলপথ, এবং পানি পথ ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করতে পারলে অনেক দিক থেকে লাভবান হওয়া যায়। আধুনিক সাম্যবাদি অর্থনীতিতে এই খাত ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবহন খাতের উন্নয়ন না হলে উৎপাদন ব্যবস্থা ও বাঁধা প্রাপ্ত হয় । সিন্ডিক্যালাইজেশন প্রক্রিয়ায় প্রথম পদক্ষেপেই এই খাতকে সামাজিকিকরন করা হবে ।

পরিবহন ব্যবস্থাটিকে সিন্ডিক্যালিস্ট নীতির ভিত্তিতে সাজানো হবে, যমন- সাধারন উপরি ভাগে, মাটির নীচ দিয়ে, আকাশ পথে, এবং পানি পথের সকল পরিবহন কে পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের হাতে হস্তান্তর করা হবে। সকল ব্যাক্তিগত  পরিবহন খাতকে সামাজিকি করন করা হবে। পরিবহন খাতকে ও সাধারন সাম্যবাদি অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত করা হবে, ন্যায় সঙ্গত ভাড়া নির্ধারন করে দেয়া হবে। এই পরিবহন খাত নিয়ে কোন প্রকার চল চাতুরীর সুযোগ দেয়া হবে না । সকল কিছুই সামাজিক স্বার্থে পরিচালিত হবে। সেই সামাজিক চুক্তিকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হবে । সেই চুক্তি কোন বিশেষ ব্যাক্তির ইচ্ছার উপর নির্ভর করে হবে না । তা নির্ধারন করা হবে সমবায় সমিতির মাধ্যমে। এই খাতকে শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজনে ব্যাংক অর্থ ও পন্য দিয়ে সহায়তা করবে।

৪। মেইল, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন এবং রেডিও।

চিঠিপত্র এবং টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা রেল সড়কের মতই জাতীয় অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য সামাজিকি করন করা হবে। ইতিমধ্যে বহুদেশ এই খাত গুলোকে জাতীয় করন করে সুফল পেয়েছে। অনেক দেশেই জনগণের স্বার্থের সাথে রাষ্ট্রের স্বার্থ সমার্থক নয়। তাই পোস্টাল ও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থাকে ব্যাক্তি ও কর্পোরেশনের আওতামুক্ত করতে হবে এবং এমনকি অবশ্যই রাস্ট্রের নিয়ন্ত্রন বিলুপ্ত করতে হবে। একেই ভাবে টেলিফোন ও রেডিও কে সকল প্রকার জন স্বার্থ বিরোধী প্রভাব থেকে স্বাধীন করতে হবে ।

সকল প্রকার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সিন্ডিক্যালাইজড করতে হবে। এই সকল ব্যবস্থার সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা সেই সকল খাতের সেবা প্রদান কারী শ্রমিক ইউনিয়ন ও কর্মীদের হাতে হস্তান্তর করতে হবে । যা সামগ্রিক ভাবে সাম্যবাদি অর্থনীতির অংশ হিসাবে পরিচালিত হবে । পরবর্তীকালে অন্যান্য শাখার মতো এবং নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো শক্তিশালীকরণ এবং দেশের সমৃদ্ধকরণের অনুপাতে এটি শিল্পায়িত এবং গ্রামীণায়িত হবে, অর্থাৎ জনসাধারণের যোগাযোগের কর্মীরা তাদের শ্রম পরিবর্তিত করবে, শিল্প ও কৃষি উভয় ক্ষেত্রেই অংশ নেবে।

যেহেতু, বর্তমান সময়সূচীটি ডিজাইন করা হয়েছে, সেই জন্য ট্রানজিউশন সময়কালের মধ্যে, এখনও কৃষিতে অর্থনৈতিক ইউনিট থাকবে এবং কারুশিল্প এবং কুটিরর শিল্পের কিছু অংশে যা সাম্যবাদী অর্থনীতির অংশ হবে না, পরবর্তীটি উপযুক্ত চুক্তিতে প্রবেশ করবে তাদের সমবায় সমিতিগুলির অফিসগুলির মাধ্যমে পৃথক ইউনিটগুলির সাথে জনসাধারণের যোগাযোগ পরিষেবাগুলির ব্যবহার সম্পর্কিত বিষয়ে যুক্ত হবে।

৫। পাবলিক সার্ভিসেস।

জনসেবাগুলির মধ্যে রয়েছে: সুয়ারেজ , পানি, গ্যাস ও গরম করন, বিদ্যুৎ, জনকল্যাণ ও অন্যান্য কাজ যা শহুরে ও গ্রামীণ জনগনকে পরিসেবা দিয়ে থাকে।

এই পরিসেবাগুলি সাম্যবাদি অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং সিন্ডিকালাইজড করা হবে, যেমন এই পরিসেবাগুলির পরিচালনা ও সংগঠন জনসাধারণের পরিসেবা কর্মীদের ইউনিয়নে স্থানান্তর করা হবে। এখানে, অর্থনীতির অন্যান্য সকল শাখায় যেমন শিল্পায়ন ও গ্রামীণকরণের নীতি ধীরে ধীরে চালু করা হবে, যার ফলে অবশেষে শ্রম সংহতকরণে পরিণত হবে।

স্বতন্ত্র কৃষি ইউনিটগুলির জন্য জনসাধারণের পরিষেবাদির ব্যবস্থাটি গ্রামের জীবনযাত্রার মৌলিক পরিবর্তনগুলির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই উন্নতিগুলি কমিউনিস্ট অর্থনীতির দ্বারা সম্পূর্ণরূপে উত্সাহিত করা হবে এবং সেই কারণে গ্রামগুলির মাধ্যমে জনসাধারণের পরিষেবাগুলি ব্যবহার করা যা দেশের কমিউনিস্ট কাঠামোর অংশ নয় তা কৃষক সমবায় সমিতিগুলির সাথে  সম্পর্ক উপযুক্ত চুক্তির দ্বারা নির্ধারিত হবে।

৬। মেডিসিন এবং স্যানিটেশন।

মেডিসিন ও স্যানিটেশন পাবলিক সার্ভিসেস যা একসাথে ওষুধপত্র ও ফার্মাসিউটিকাল শিল্পের সাথে, জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা হিসাবে সিন্ডিক্যালিক ভিত্তিতে গঠিত হবে। এই গুলিও কমিউনিস্ট অর্থনৈতিক সিস্টেমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

মেডিকেল ও স্যানিটারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করবে এবং সারা দেশের স্বাস্থ্যসেবা সংস্থার পরিচালনা করবে। এই সকল পরিষেবাগুলি, যেমন সকল শাখা এবং কমিউনিস্ট সমাজের কাজগুলি, শিল্পায়িত এবং গ্রামীণায়িত হবে, যেমন ধীরে ধীরে, এবং যেখানেই সম্ভব, চিকিৎসা ও স্যানিটারি কর্মীরা তাদের কাজগুলি শিল্প ও কৃষি শ্রমের সাথে একত্রিত করবে।

সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা সারা দেশকে চিকিৎসা ও স্যানিটারি সেন্টার, হাসপাতাল এবং স্যানটোটোয়ার নিখুঁত নেটের সাথে জুড়ে দেবে। যেহেতু এই পরিষেবাটি কমিউনিস্ট অর্থনীতির দ্বারা সমর্থিত হবে, তাই স্বতন্ত্র ইউনিটগুলি তার সহযোগিতামূলক সংস্থার ইউনিয়নগুলির মাধ্যমে তার খরচগুলি ও অংশীদার করতে হবে।

৭। সাধারণ শিক্ষা ও বিজ্ঞান।

প্রতিটি রাষ্ট্র তার নিজের স্বার্থেই এগিয়ে যাবার জন্য সাধারন শিক্ষাকে সাদরে গ্রহন করে থাকে। ফলে রাস্ট্রের হতে যখন নিয়ন্ত্রনভার থাকে তখন সেটা সাধারন মানুষকে দাসে পরিনত করার প্রায়স চালায়। রাস্ট্রের স্বার্থে শিক্ষাকে এবং বিজ্ঞানকে ব্যবহার করতে চায়, বিদ্যালয় সমূহকে একপেশে চিন্তার জন্য রোবট তৈরির কারখানা বানায় রাষ্ট্র। আমরা রাশিয়ায় সেই চিত্রই দেখেছি, একটি সাম্যবাদি রাষ্ট্র হিসাবে স্বাধীন চিন্তার শিক্ষা ব্যবস্থা প্রত্যাশা করেছিলো সকলেই কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো চিত্রই দেখল দুনিয়াবাসী। এরা ও তাদের বিদ্যালয় সমূহে রাষ্ট্রের কিছু দাসই পয়দা করেছিলো।

শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যই হলো শিশুদেরকে এমনভাবে গড়ে তুলা যেন তারা বড় হয়ে সামাজিক উন্নয়নের জন্য নিজেদেরকে নিয়োজিত করতে পারেন । তাই শিক্ষাকে অবশ্যই স্বাধীন ভাবে পরিচালনা করতে হবে, যেন প্রতিটি শিক্ষার্থী স্বাধীন ভাবে নিজেদেরকে নতুন চিন্তাধারার গড়ে তুলতে পারে, জন্ম দিতে পারে নতুন ধারনার । শিক্ষার ভিত্তি হবে যুক্তি ও প্রমান বিশ্বাস নয়, অধিবিদ্যা নয় তা হবে সত্যিকার বিজ্ঞান সম্মত; সম্মিলিত শিক্ষা সকল লিঙ্গের লোকদেরকে একটি সাধারন শিক্ষার নির্দেশনা দেয়, ফলে বিজ্ঞান, ব্যবসা ও শিল্পের জগতে একটি সম্প্রীতির পরিবেশ সৃজন করে। যা একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মানে সয়ায়ক হয়।

একটি বিদ্যালয় অবশ্যই শিক্ষা দিবে, যেমন পিটার ক্রপথকিন বলেছেন, “ আটার বছরের আগেই সকল ছেলে মেয়েদেরকে বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক ধারনা শিখিয়ে দিতে হবে। তারা যেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত বিষয়ে শিক্ষা গ্রহন গবেষণা নিয়ে কাজ করতে সক্ষম হন। একেই সময়ে তাদেরকে সক্ষম করে তুলতে হবে যেন তারা শিল্প কারখানায় উৎপাদন বিষয়ে অভিজ্ঞ হয়ে উঠে। তারা যেন সামাজিক সম্পদের ব্যবহার করতে জানে”। এই অবস্থা বিনির্মানের জন্য একেই কেন্দ্র থেকে একক নির্দেশনায় বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না ।

বিজ্ঞানে সঠিক বিকাশের জন্য চার্চ ও রাষ্ট্র থেকে বিদ্যালয় সমূহকে পৃথক ভাবে কাজ করতে দিতে হবে। তা নিরাজবাদি বিপ্লবে আগেই সম্পাদন করতে হবে। সত্যিকার বিজ্ঞানের বিকাশ করতে হলে অর্থনৈতিক সাম্য, স্বাধীন ও রাষ্ট্র বিহীন সমাজ অবশ্যই কায়েম করতে হবে।

বিজ্ঞানের সামাজিকি করনের জন্য সামাজিক বিপ্লব সাধান করতে হবে। এই কথার অর্থ এই নয় যে সকলের চিন্তা ভাবনাকে একেই সমতলে নিয়ে আসা হবে; বা সকলেই বিজ্ঞানী হয়ে যাবেন। বিজ্ঞানের সামাজিকি করনের অর্থ হলো, বিজ্ঞান বিকশিত হবে সত্যিকার বিজ্ঞান হিসাবে, বিজ্ঞান ব্যবহার করা হবে সকল মানুষের কল্যাণে। এই প্রসঙ্গে মাইক্যাল বাকুনিন বলেছেন, “ বিজ্ঞান হবে সকলের জন্য, এটাতে সকলেই অংশ নিতে পারবেন এবং সকলেই উপকৃত হতে পারবেন, কোন মানুষের জন্যই বিজ্ঞান ক্ষতিকারক হবে না”।

“ প্রতিটি লোক শিক্ষা পাবে, প্রতিটি লোক কাজ পাবেন”- সামাজিক বিপ্লবের পর সকল লোকের জন্য শিক্ষা ও কাজের বিষয়টি অবশ্যই নিশ্চিত করা হবে । বিজ্ঞানকে শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়া হবে, পল্লীর অঞ্চলে বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়া হবে। সাধারন জনগণ তাদের কাজে শারীরিক শ্রম সহজ করার জন্য ক্রমে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে শুরু করবেন। এবং বিজ্ঞানের সহায়তায় উন্নয়ন কর্মে প্রচন্ড গতি সঞ্চার হবে। “ এটা অবশ্যই সম্ভব, তা অবশ্যই করা হবে”- বলেছিলেন বাকুনিন, “এই অন্তর্বর্তী কালিন সময়টি যতদ্রুত সম্ভব অতিক্রম করা হবে। উচ্চতর বিজ্ঞান এবং ব্যবহারিক বিজ্ঞানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হবে । সকল প্রকার কুসংস্কারকে কঠোরভাবে বিলয় ঘটানো হবে। এখানে প্রভুত্বকারী শক্তির কোন অস্থিত্ব থাকবে না । কেবলই মানুষের স্বীকৃতি থাকবে সর্বত্র। মানুষের শক্তি ই হবে মুল শক্তি”।

নির্দেশনা, শিক্ষা ও বিজ্ঞান সামাজিকীকরণ শুধুমাত্র তাদের সিন্ডিকালাইজেশনের মাধ্যমে অর্জন করা যেতে পারে, অর্থাৎ এই পাবলিক পরিষেবাদির সংগঠন ও পরিচালনাকে শিক্ষা কর্মী ইউনিয়নে স্থানান্তরিত করা উচিত, তাদের কার্যক্রমগুলিকে আগ্রহী জনগোষ্ঠীর সাথে, বাবা-মা, অর্থনীতিবিদদের এবং তাদের সাথে সমন্বয় করা উচিত।  স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, একাডেমী, লাইব্রেরি, জাদুঘর এবং তাদের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব  শিক্ষা শ্রমিক ইউনিয়নের উপর ন্যাস্ত হবে।

জনসাধারণের জন্য সাধারণ শিক্ষার কর্মকাণ্ড কমিউনিস্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে । অতএব, দেশের সমবায় এবং  একক ব্যক্তিগত ইউনিটগুলি সমতাকে নিশ্চিত করার জন্য সমষ্টিগত অর্থনীতির কোষাগারে অবদান রাখবে, তাদের আয়গুলির একটি নির্দিষ্ট শতাংশ  বর্তুকী রূপে জমা রাখা হবে  এবং সাধারণ পরিষেবা গুলি বজায় রাখতে শিক্ষায় সেই অর্থ খরচ করা হবে ।

শিল্প ও থিয়েটার ও জনসাধারণের সেবা মূলক কাজ। তাদেরকে ও সাধারন শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত করে গড়ে তোলা হবে এবং উত্তরোত্তর বিকাশের ও ভালো ভাবে ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহন করা হবে ।

ধর্ম কোন পাবলিক সেবা খাত নয়। সামাজিক বিপ্লব প্রকৃতিগত ভাবে ধর্ম বান্দ্বব নয়। তবে , এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্টগন কোন ভাবেই মানুষের বিশ্বাসের উপর নিপিড়ন মূলক ব্যবস্থা গ্রহন করবে না । এই বিষয়ে এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্টগন জেনেভা কনভেনশনে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সমিতির বক্তব্য যথাযত ভাবে অনুসরন করবে। সেখানে বলা হয়েছে যে, “ ধর্মীয় বিষয় ব্যাক্তিগত চিন্তা ভাবনার ফসল, এটা যতক্ষন সাধারন মানুষের ক্রিয়া কর্মে যুক্ত না হয় ততক্ষণ তা অস্পৃশ্যই থেকে যাবে”।

৮। হিসাব - ব্যাংক এবং আর্থিক খাত।

হিসাব এবং পরিসংখ্যান উত্পাদন এবং খরচের মধ্যে সম্পর্ক সঠিক নিয়ন্ত্রণে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে। পরিসংখ্যানগত তথ্যগুলির সাহায্যেই কেবল তাদের প্রয়োজনীয় ভারসাম্য নির্ধারণ করা, এবং উপযুক্ত বিতরণ এবং বিনিময় সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে, পরিসংখ্যানগত তথ্য ছাড়া একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলা অসম্ভব। অতএব, পরিসংখ্যান,  পাবলিক সার্ভিস গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকা পালন করে থাকে। কারিগরি শাখাকে কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো নগদ ক্রেডিট প্রদান করবে , যা সরাসরি সংশ্লিষ্ট পাবলিক পরিষেবাদি এবং বিশেষ করে বিতরণ এবং বিনিময় পরিষেবার জন্য গঠিত হবে।

সমস্ত বিদ্যমান ব্যাংকগুলিকে সামাজিকীকরণ করা হবে এবং নগদ এবং পণ্য ক্রেডিটের জন্য ব্যাংকের সাথে একত্রিত হবে। এটি, তার পরিসংখ্যানগত ফাংশন ছাড়াও, সমস্ত স্বাভাবিক ব্যাংকিং ক্রিয়াকলাপ সম্পাদন করবে যা অবশ্যই, দেশের নতুন অর্থনৈতিক কাঠামোর সাথে পরিবর্তিত হবে। ব্যাংকটি কমিউনিস্ট অর্থনীতি এবং স্বতন্ত্র ইউনিট, বিশেষ করে কৃষি ইউনিটের পাশাপাশি বিদেশে স্বতন্ত্র ব্যক্তিদের মধ্যে  যোগাযোগ স্থাপন করবে। পরবর্তী ক্ষেত্রে, এটি বিদেশী বাণিজ্যের জন্য ব্যাংক হিসাবে কাজ করবে।

অভ্যন্তরীণ বিনিময় ক্ষেত্রের মধ্যে, ব্যাংকটি হ'ল কমিউনিজমের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র, প্রতিটি ইউনিটের উন্নতি এবং কৃষির যান্ত্রিকীকরণের জন্য দরকারী  উপাদান এবং আর্থিক ক্রেডিটের মাধ্যমে যান্ত্রিক দিক থেকে পৃথক ইউনিটগুলিকে প্রভাবিত করবে । ফলে গ্রামীণ শ্রমের সামাজিকীকরণ - কৃষির সামাজিকীকরণের প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত পুরন করা হবে।

ব্যাংক এবং অ্যাকাউন্ট্যান্সির সামাজিকীকরণ তাদের সিন্ডিকালাইজেশনের মাধ্যমে অর্জন করা উচিত, অর্থাৎ এই জনসাধারণ পরিষেবাগুলিকে পরিচালনাকারী শ্রমিকদের পরিচালনায় স্থানান্তরিত করা হবে এবং সাধারণ কমিউনিস্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কমিউনিজমের সুদৃঢ়তার সাথে, শ্রম শিল্প ও অন্যান্য পাবলিক পরিষেবাদি হিসাবে গ্রামীণকৃত হবে, অর্থাৎ এটি একীকরণের নীতিতে ধীরে ধীরে সংগঠিত হবে।

টাকা মূল্যবান শ্রমের একটি সুনির্দিস্ট প্রতীক হিসাবে পরিগনিত হয়ে আছে ।  যার বৃহত্তম অংশটি এখন কয়েকটি পুঁজিপতি ও রাস্ট্রের হাতে শোষণের মাধ্যম হিসাবে  ব্যবহ্রত হচ্ছে, তা অবশ্যই সামাজিকীকরণ করা উচিত। অর্থের সামাজিকীকরণ, অর্থাৎ শ্রম সমাজের ফিরতি শ্রমের ফসল, শুধুমাত্র তার বিলুপ্তি করন করতে, কোনও ক্ষতিপূরণ ছাড়াই সম্ভব। পুরাতন শাসনের মুদ্রা বিলোপ সামাজিক বিপ্লবের প্রথম কাজগুলির মধ্যে একটি।

যাই হোক, এটি ট্রান্সিশন প্যারিওডে সম্পূর্ণভাবে অর্থ বিলুপ্ত করা অসম্ভব, কারণ কিছু ফাংশন যা এখন অর্থের উপর নির্ভরশীল, এখনও চলতে থাকবে, যদিও তাদের বিপজ্জনক দিকগুলি সরানো হবে। পুরোপুরি পরিপক্ক কমিউনিস্টিজমের একটি সিস্টেমের ধীরে ধীরে পদ্ধতির বাস্তবায়নের সময় অর্থ বিলুপ্ত হয়ে যাবে । যা বিতরণ দ্বারা বিনিময় প্রতিস্থাপন করবে। কিন্তু ট্রানজিউশন সময়ের মধ্যে, ব্যক্তিত্বের সাথে সাম্যবাদের সহ-অস্তিত্বের কারণে, পণ্য বিনিময় পুরোপুরি বাদ যাবে না। এবং যেহেতু অর্থের মূল কাজ হল বিনিময় মাধ্যমের একটি মাধ্যম - বিনিময়য়ের সবচেয়ে সুবিধাজনক মাধ্যম - এই পর্যায়ে এটি ছাড়া এটি করা সম্ভব হবে না।

শুরুতে, শ্রমের অর্থ প্রবর্তনের বাস্তব অসম্ভবতা (যার মূল্য কার্য দিবসের উপর ভিত্তি করে) কমিউনিস্ট অর্থনীতিতে স্বর্ণের মুদ্রাগুলি চিনতে হবে এবং পুঁজিবাদের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত মানগুলির মাধ্যমে তাদের বিনিময়ে পরিচালিত করতে হবে। এটা বিশেষ করে বিদেশী বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। অভ্যন্তরীণ বিনিময়ে, শিল্পের একটি বৃহৎ অংশের সামাজিকীকরণের কারণে, যা উত্পাদনের স্কেল নির্ধারণ করার সুযোগ প্রদান করবে, মূল্য নির্ধারণ করা এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তাদের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

ট্রানজিউশন সময়ের কালে, অর্থ বৈষম্য ও শোষণ প্রতিষ্ঠার হুমকি হতে পারে না - কারণ উৎপাদন ছাড়াও উৎপাদন ও পরিবহণের সমস্ত মাধ্যমের সামাজিকীকরণ এবং কৃষি ব্যতীত শিল্পের সকল শাখায় শ্রম ও তার পণ্যগুলির সামাজিকীকরণ - এটি পুঁজিবাদী সমাজে যেমন শক্তি ছিল, তা হারাবে তাদের ক্ষমতা। নগদ অর্থ সুদের উপর ধার্য করা যায় না, তাই আর্থিক মূলধনের জন্য কোন জায়গা থাকবে না। উত্পাদনের সমস্ত সরঞ্জাম এবং মাধ্যম, সামাজিকীকরণ করা, বিক্রয় বা ক্রয়ের বিষয় নয়; তাই শিল্প মূলধনের জন্য কোন ব্যবস্থা থাকবে। ভাড়াটে শ্রম বন্ধের ফলে উদ্বৃত্ত মূল্যবৃদ্ধি দ্বারা হাউজিং মূলধনের সম্ভাবনা সরাতে হবে; সমবায় দ্বারা ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীর প্রতিস্থাপন এবং কমিউনিস্ট এবং ব্যক্তিগত অর্থনীতির মধ্যে মিশ্র উপাদান-আর্থিক নীতির সরাসরি বিনিময় প্রতিষ্ঠার ফলে ব্যবসায়ের মূলধন রূপে অর্থের সম্ভাবনাকে সরিয়ে ফেলা হবে। সুতরাং ট্রানজিউশন সময়কালে, যা সবকিছুকে সামাজিকীকরণ করা হবে, কিন্তু সকলকেই যুক্ত করা হবে না, অর্থ কেবল মানের মান হিসাবে বিদ্যমান থাকবে এবং অর্থনৈতিক সমতাগুলির বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে প্রাকৃতিক বিনিময় প্রক্রিয়ার সহজীকরণের মাধ্যম হিসাবে ঠিকে থাকবে।

সামাজিক উত্থানের পরে সমাজের স্থিতিশীলতার উপর নির্ভর করে, বার্টার মূল্যের নীতিতে প্রাকৃতিক বিনিময়কে আরও বেশি সুযোগ দেওয়া হবে, এবং এর ফলে মান হিসাবে অর্থের ব্যবহার হ্রাস পাবে। কৃষি সাম্রাজ্যের ধীরে ধীরে রূপান্তর অর্থের ভূমিকা আরও কমিয়ে দেবে এবং বন্টন দ্বারা বিনিময়ের প্রচলন - অবশেষে পুরোপুরি প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে এটিকে বাতিল করে দিবে।

৯। বিনিময় ও বিতরন

একটি পুঁজিবাদী সমাজে উৎপাদিত পন্যের বিনিময় ও বিতরন হয় ব্যবসায়ীক ভাবে। এই ধরনের বিতরন বিশৃংখল ও অসম। পুঁজিবাদী সমাজে যারা কাজ করেন তারা পায় কম এবং প্রায়স কম গুনাবলী সম্পন্ন পন্য ভোগ করে থাকে । আর যারা কাজ করেন না তারা পায় বেশী । পন্য উৎপাদকের নিকট ফিরে আসে। উৎপাদকগণ সেই সকল পন্য উঁচু দামে ক্রয় করেন। আর অন্য এক শ্রেনী মধ্যসত্ত্বভূগী হিসাবে মাঝ খান থেকে বিপুল অর্থ আত্মস্থ করে নেয়। একটি চক্র বাজারে নিজেদের নিয়ন্ত্রন কায়েম করে পরগাছা হিসাবে পন্যের মূল্য বাড়িয়ে নিজেদের সুবিধাটা আদায় করে নিতে পারে। একজন পন্য পয়দা কারী নিজেই সেই পন্যের ভুক্তা হিসাবে উৎপাদন খরচের চেয়ে অধিক মূল্যে পন্য কিনে নেয় ।

প্রকৃতিগত ভাবেই পুঁজিবাদী পদ্বতী একটি ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির হয়ে থাকে, এটা ব্যবসাকে ও বিনাশ করে দেয়, তাই এই ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটিয়ে যথাযথ ভাবে পারস্পারিক সম্প্রীতির মাধ্যমে, নিরাজবাদি বা অপুজিবাদি ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে।

সমাজ ও অর্থনীতিকে সাম্যবাদি ধারায় পুনর্গঠন করে উৎপাদন ব্যবস্থাকে নতুন ভাবে বিন্যস্থ করতে হবে। উৎপাদক কমিউন কায়েম করে তার সম্পূরক ভোক্তা কমিউন কায়েম করতে হবে । ভোক্তাদের সামগ্রিক কাজ সংঘটিত ভাবে সম্পাদন করার ব্যবস্থা করা হবে। গ্রামে শহরে বিতরন ব্যবস্থাকে সহজতর করার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হবে । ভোক্তা সমিতি সামগ্রিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রনের কাজে নিয়োজিত হবে ।

রাশিয়ান বিপ্লবের অভিজ্ঞতার থেকে এবং তার অপ্রত্যাশিত প্রবণতার পরবর্তী বিকাশের অভিজ্ঞতা থেকে শেখানো, অ্যানারোকো-সিন্ডিকালস্টরা ভোক্তাদের সহযোগীদেরকে বন্টনকারী সংস্থা হিসাবে ব্যবহার করবে, এমনভাবে নির্মিত যে  কমিটি মৌলিক সাংগঠনিক কোষ হয়ে যাবে। ভোক্তাদের কমিউনিস্টরা নিজেদের মধ্যে উভয় প্রযোজক এবং ভোক্তাদের একত্রিত করবে। ফলস্বরূপ, উৎপাদক বা ভোক্তাদের একনায়কতন্ত্রের উত্থানের কোনো সুযোগ নেই।

ভোক্তা সংগঠন, যা এখানে তার সর্বাধিক সম্ভাব্য অর্থে বোঝা যায়, এর দুটি মৌলিক উপাদান, অ্যাকাউন্টিং এবং বিতরণ কর্ম নিয়ে গঠিত হবে। তা অ্যাকাউন্টিং অ্যাকাউন্ট ক্যাশ-অ্যান্ড-গুডস ক্রেডিট দ্বারা পরিচালিত হবে, যা বিতরণকারী সংস্থার একটি অংশ হয়ে উঠবে।

সাম্যবাদি ব্যবস্থার আওতায় জাতীয় অর্থনীতিতে সকল প্রকার উৎপাদিত পন্যের একটি গুদাম ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলা হবে। সেখানে কারখানায়, উৎপাদন কেন্দ্রে এবং কর্মশালায়  তৈরী পন্য সংরক্ষিত রাখা হবে। সেখান থেকে সকল প্রকার দ্রব্য পন্য সরবরাহ করা হবে। গ্রামীন ও শহর অঞ্চলে সেই ব্যবস্থা থাকবে। যে সকল এলাকায় যে ধরনের দ্রব্য সকলের পছন্দনীয় সেই সকল অঞ্চলে সেই সকল পন্য দ্রব্য সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে ।

কৃষি পন্য ক্রয়ের জন্য কেহ চাইলে তার ইচ্ছেমত কিনতে পারবেন। সেই ব্যাংক নগদ ও অর্থে সহায়তা করবে। ক্ষেত্র বিশেষে পন্য দ্রব্য ক্রয়ের জন্য কিছু টুকেন প্রদান করা হবে। যেন ক্রেতা  সাধারন তাদের পছন্দ মত সব কিছু কিনতে পারেন। তবে তার জন্য যথাযথ হিসাব সংরক্ষিত থাকবে।

অন্তর্বর্তী কালিন সময়ে সাম্যবাদ হয়ত সকল মানুষের চাহিদা সম্পূর্ন ভাবে মেটাতে পারবে না । তবে প্রধান লক্ষ্য হবে সমাজের সকলের চাহিদা পুরন করা । সেই সাম্যবাদি সমাজের মূলনীতি ই হবে “সকলের চাহিদা মত সরবরাহ নিশ্চিত করা”। কৃষি ভিত্তিক প্রতিটি ইউনিটের সর্বাত্মক প্রচস্টা নিয়োজিত হবে মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানো।  সমাজের শিশু, প্রবীন ও অক্ষম লোকদেরকে প্রাধান্য দিয়ে পন্য সরবরাহের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে ।

ভোক্তানীতি হবে এমন যে, সকল কছুই অর্থের মানদন্ডে পন্যকে বিবেচনায় নেয়া হবে। সেই ক্ষেত্রে সমতা মূলক নীতির ব্যাতিক্রম হবে না । সমাজের নীতি হবে সকলেই সকলের জন্য কাজ করবেন । যারা কাজ করতে পারবেন না তারা ও কর্মজীবীদেরমতই পন্য দ্রব্য পাবেন। তবে, যারা কাজ করতে সক্ষম তাদেরকে অবশ্যই কাজ করতে হবে। নইলে তাকে না খেয়ে থাকতে হবে। হয় মরবেন বা এলাকা ছেড়ে চলে যাবেন। এই নীতি ক্রমে বাস্তবায়িত হবে।

অধ্যায়ঃ ৪ কর ব্যবস্থা

যে সমাজটি সামাজিক বিপ্লবের ভেতর দিয়ে বিকশিত হবে সেখানে কোন প্রকার রাষ্ট্রীয় সংস্থা থাকবে না, কোন প্রকার কর আদায়ের ব্যবস্থা ও রাখা হবে না। কোন প্রকার পন্য, শ্রম বা উৎপাদনের উপর করারোপ করা হবে না। সকল কিছুই সমাজের সম্পদ হিসাবে পরিগনিত হবে ।

তবে সেই সাম্যবাদি সমাজ গড়ে তুলার জন্য কিছু সময় নেয়া হবে। প্রাথমিক স্তরে কিছু কিছু ক্ষেত্রে করারোপ করা হবে। যেন সমাজের সত্যিকার সাম্য কায়েম করা যায় ।

এই আদায় কৃত কর গুলি পরিবহন, হাইওয়ে, ডাক সেবা, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, রেডিও, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবা, সাধারণ শিক্ষা ও সেনাবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ ও সংগঠনের জন্য ব্যবহার করা হবে - সমস্ত পাবলিক পরিষেবাদি যা পৃথক পৃথক ইউনিটগুলির নিষ্পত্তি করা হবে তবে যার খরচ তারা ভাগ করবেন না।

এই ধরনের ট্যাক্স আয় নীতির উপর ভিত্তি করে করা হবে। পরিমাণ জেনারেল কনফেডারেশন অব লেবার দ্বারা নির্ধারণ করা হবে। স্বতন্ত্র ইউনিটগুলিকে একত্রিত করে সহযোগী সমিতিগুলির মাধ্যমে ব্যাংকের ক্যাশ-অ্যান্ড-গুডস ক্রেডিট দ্বারা "কর" নেওয়া হবে।

অধ্যায়ঃ ৫ অন্তবর্তীকালিন সময়ে শ্রম

সামাজিক রীতিনীতি ও বিধি বিধান এমন ভাবে গড়ে তুলা হবে যেখানে বস্তুগত ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, সেখানে শ্রমের অধিকার রক্ষার জন্য  আর লড়াই করতে হবে না ।  শ্রম শোষণের সুযোগ চিরতরে বন্দ্ব করে দেয়া হবে, আর্থ সামাজিক কাঠামোতেই তা সুনিশ্চিত করা হবে। যেন কেহই শ্রম শোষণের শিকার না হন। এমন একটি সামাজিক পরিবেশ গড়ে উঠবে যেখানে প্রতিটি মানুষ প্রত্যেকের অধিকারের প্রতি শ্রদ্বাশীল হবেন ।

উৎপাদকগণ নিজেদের এই চাহিদার  প্রতি যত্ন নেবেন, যেমন প্রযোজক কমিউন অবশ্যই মেডিকে-স্যানিটারি অ্যাসোসিয়েশনের বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ধারিত প্রবিধানগুলিকে কঠোরভাবে অনুসরণ করবেন ।

শিশু শ্রমকে বিলুপ্ত করে দেয়া হবে। সামাজিক ভাবে ১৮ বছর পর্যন্ত সকলকে সমন্বিত শিক্ষা গ্রহন করতে হবে, যেন তারা চলমান উৎপাদন কর্মে নিয়োজিত হবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন । এভাবে শিল্পে শিশু শ্রমের সমস্যা অস্তিত্ব বন্ধ হয়ে যাবে। মহিলা শ্রম বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ধারিত প্রবিধান অনুযায়ী সংগঠিত হবে।

স্বাভাবিকভাবেই, নতুন সমাজকে শ্রমের সুরক্ষার জন্য বিশেষ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে না - এটি হল জনস্বাস্থ্য কর্মীদের ফেডারেশনের কাজ, যারা সমগ্র সমাজের নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে এবং বিশেষ করে উতপাদকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করবে ।

কাজের সময় প্রশ্নে, ছয় ঘন্টা কাজের দিন নিয়ে সমাজ প্রথম ধাপে শুরু হবে। এই বিষয়ে কিছু কম বেশী করতে হলে  উৎপাদক  সম্প্রদায়ের ও জনসাধারণের কর্মীদের ইউনিয়নগুলির সম্মেলন দ্বারা তা নির্ধারিত হবে এবং সামগ্রীকভাবে, সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যগুলির পরিমাণ, কর্মরত এবং বেকার উত্পাদকের সংখ্যা এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার উন্নতির উপর নির্ভর করবে। এই শর্তাবলী, এবং দেশের ভূমি সামাজিকীকরণের ডিগ্রী, সংহত শ্রমের সম্প্রসারনের  গতি নির্ধারণ করবে।

রূপান্তরিত সময়ের মেয়াদে ভাড়াটে শ্রমিকদের বিলুপ্তি  ঘটবে। উৎপাদক একজন ভাড়াটে কর্মী হবেন না, তবে  উৎপাদক  কমিউনের সক্রিয় ও সমান সদস্য হবেন, যার কাছ থেকে কেউ অতিরিক্ত মূল্যের মূল্য কমাবে না। প্রতিটি কাজে অংশগ্রহণকারী মজুরি পাবে না, কিন্তু জনসাধারণের সম্পদের সমান অংশ যা কারখানায় উৎপাদন করে সে সকলের সাথে সমানভাবে অংশীদার হবে। জনসাধারণের সম্পদের এই অংশ, যা পণ্য ও অর্থ উভয় ক্ষেত্রেই বিতরণ করা হবে, এবং সাধারণ কংগ্রেসের দ্বারা খুব তাড়াতাড়ি বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ধারণ করা হবে, তা নির্দিষ্ট পরিমাণে থাকতে পারে না। তার বৃদ্ধি বা হ্রাস জনসাধারণের সম্পদে কর্ম দক্ষতার ডিগ্রির উপর নির্ভর করবে, যা সাম্যবাদি অর্থনীতির সদস্যদের উপর প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ছাড়াও বাস্তবতার উপর নির্ভর করবে।

প্রতিটি ব্যক্তি, তার প্রাক্তন সামাজিক অবস্থান থেকে স্বাধীন ভাবে কাজ করার অধিকার ভোগ করবে এবং তা ব্যবহার করবে। সমাজের উপর এই মৌলিক নীতিটি যুক্তিসঙ্গত উত্পাদনশীল বা সামাজিকভাবে কার্যকরী ভাবে কাজ সহ সকলকে প্রদান করা হবে এবং এটির অক্ষমতার ক্ষেত্রে, অন্যের সাথে সমান স্তর তাদের বজায় রাখতে হবে, যতক্ষণ না এটি তাদের কাজ করতে পারে । যারা কাজ করতে সক্ষম, তাদের অহংকারের অধিকার ব্যবহার করার ইচ্ছা, নতুন সমাজ মানুষের এই অধিকার সীমাবদ্ধ করার কোন প্রচেষ্টা করবে না । বিপ্লবী সমাজ কর্ম বিমুখ লোকদেরকে তাদের ক্ষুধায় মারা যাওয়া থেকে  বাঁচানোর জন্য চাপ দিবে না। একটি সমাজ যার মূল ভিত্তি হল কাজ, অবশ্যই এই নীতিটি পালন করতে হবে: "যে নিজের ইচ্ছার কাজ করে না সে খাবে না।"

সমাজের জন্য সামাজিক সংস্থার জন্য বিশেষ নতুন করে প্রতিষ্ঠান তৈরি করার দরকার নেই। যেহেতু এটি সকলের কাজ করার প্রত্যাশা করে, এটি সর্বনিম্ন এবং সর্বাধিক কর্মক্ষম বয়সের সীমা নির্ধারণ করবে, তার আগে এবং পরে সমস্ত লোককে, অন্যদের সাথে সমানভাবে সযোগ প্রদান করতে হবে, নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা এবং জীবনের সুবিধার জন্য কাজ করতে হবে। একইভাবে, সমাজ  নানা ধরনের প্রতিবন্দ্বি এবং অসুস্থদের জন্য সুযোগ প্রদান করবে।

দ্বিতীয় বিভাগঃ রাজনৈতিক পরিমন্ডল

অধ্যায়ঃ ১ । সাধারন রাজনীতি

বুর্জোয়ারা-গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, সকল মানুষের জন্য তার আনুষ্ঠানিক সমতা এবং তার আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার কথা বলে প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষা করে এবং এভাবে অবশ্যই বুর্জোয়াদের একনায়কতন্ত্র এবং কর্মরত জনগণের নিদারুণ শোষণের জন্য একটি সংগঠন হয়ে ওঠে। সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের রূপে নতুন রাস্ট্রবাদের ক্ষেত্রেও এটি সত্য, এমনকি সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্রের ধারণা অনুসারে এটিও পবিত্র। রাষ্ট্র কেবলমাত্র উৎপাদনকারীর সকল উপায়েই নয় বরং প্রতিটি ব্যক্তির জীবনেরও মালিক, প্রত্যেককে দাসের অবস্থান, কথা বলা রোবটগুলির অবস্থান এবং একেবারে যুক্তিযুক্ত  ও যুক্তি দিয়ে বৈধ করা হয়, নতুন শাসক শ্রেণীর শোষণের সৃষ্টি করে। শ্রমিক শ্রেণী - আমলাতন্ত্রের একনায়কতন্ত্র; একটি ক্ষুদ্র চক্র দ্বারা জনগণের বিশাল জনগোষ্ঠীর শোষণ এবং মোট দাসত্বের জন্য রাষ্ট্র একটি দৈত্য মেশিন হয়ে ওঠে।

বিপরীতভাবে, শ্রমিক শ্রেনী দ্বারা সংঘটিত কর্মকাণ্ডের জনগোষ্ঠীগুলিকে নতুন, নিরাজবাদি সমাজের নির্মাণের একমাত্র ভিত্তি হিসাবে রূপান্তরিত করবে, এইভাবে আন্দোলনের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন এবং ব্যাক্তির জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে।

বুর্জোয়া গণতন্ত্র সর্বজনীন মৈত্রী ও জাতীয় সমতার বুলির অধীনে তার শ্রেণী চরিত্রকে লুকিয়ে রাখে। অন্যদিকে, সোভিয়েত গণতন্ত্র, শ্রেণী চরিত্র ও রাস্ট্র ধ্বংসের জন্য সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্রের ধারণাকে অপরিহার্যভাবে বজায় রাখার মাধ্যমে তার শ্রেণির চরিত্রকে দ্রুত জোরদার করে। যাইহোক, রাশিয়ান বিপ্লবের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে যে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্রটি একটি কল্পনা, একটি অগ্রহণযোগ্য কল্পরূপ, এটা যৌক্তিকভাবে এবং অনিবার্যভাবে, এটি  একটি পার্টি একনায়কতন্ত্রের রূপ  ধারন করে এবং পরবর্তীতে আমলাতন্ত্রের একটি নিয়ম হয়ে উঠে, অর্থাৎ সহজ পরমত্ব। সোভিয়েত রাষ্ট্রকে বলতে  বাধ্য করা হয়েছে যে আমলাতন্ত্রের একনায়কতন্ত্র হ'ল সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র, ঠিক যেমন বুর্জোয়ারা তার একনায়কতন্ত্রকে "জনগণের ইচ্ছা" বলে দাবি করে।

অন্যদিকে, শ্রেনী ভিত্তিক কনফেডারেশন সমূহ গঠিত হয় হাজার হাজার স্বাধীন শ্রমিক দল নিয়ে, ফলে তারা প্রচুর সুবিধা ও কাজের স্বাধীনতার জন্ম দেয়। এটা বিশেষ কোন শ্রেনীর প্রাধান্যকে বা একনায়তন্ত্রকে বাধা দেয়, ফলে সেই সকল ক্ষেত্রে একটি সন্ত্রাসী শাসন ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটেতে পারে না। শ্রেনী ভিত্তিক কনফেডারেশনের চরিত্র হলো তারা মানুষের ব্যাপক স্বাধীনতাকে সীমীত করতে চায় না। মানুষের সামগ্রীক অধিকার নিশ্চিত করতে চায়, তাদের কাজের পরিধি বাড়াতে চায়। ফলে সত্যিকার গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃস্টি হয়। বাস্তব জগতে শ্রেনী ভিত্তিক ফেডারেশনই সত্যিকার গণতন্ত্রের ভিত্তিকে মজবুত করে দিতে পারে।

বুর্জোয়া এবং সোভিয়ত উভয়ই নিজেদের আনুস্টানিক সকল কার্যক্রমকে রাজনৈতিক স্বাধীনতার ঘোষনার মধ্যে সীমাবদ্ব রাখতে চায়ঃ বাক স্বাধীনতা, সমাবশের স্বাধীনতা, সংঘ গঠন এবং সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা, ও ধর্মঘট পালনর অধিকার ইত্যাদি। প্রাচীন লোকেরা কবল আনুস্টানিক স্বাধীকার প্রতিস্টায়  আগ্রহী। তাঁরা ও শুধু শ্রমিক শ্রেনী কথা বলেন। কিন্তু প্রশাসনিক গণতন্ত্র, আর্থিক শোষণ মুক্তি অর্জিত না হলে - সত্যিকার স্বাধীকার অর্জিত হবার কোন সম্ভাবনাই নেই। তা বুর্জোয়া রাস্ট্রই হোক বা প্রলেতারিয়েত রাস্ট্রিই হোক। তাই সকল আন্দোলনের লক্ষ্য ই হওয়া দরকার সামগ্রীক স্বাধীনতা অর্জন করা।

নাগরিকদের জন্য পূর্ন অধিকার অর্জন করা অসম্ভ নয়, বাস্তব অবস্থায় বিবেচনা করলে আমরা দেখব যে যেসকল ঘোষণা দেয়া  হয় , তা অর্জনের পদক্ষেপ নেয়া হয় না, অনেক ক্ষেত্রে তা সামাজিক ও রাস্ট্রিয় কাঠামোগত কারনে সম্ভব ও হয়ে উঠেনা। তাই সামাজিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে তা অর্জন করা সম্ভব । তাই দরকার হল ফেডারেশন গঠন করে স্ব স্বাশিত ব্যবস্থার প্রবর্তন করা। পুঁজিবাদ ও রাস্ট্র ব্যবস্থাকে বিতারন করা । আজকের সভ্য দুনিয়ায় এই গুলোই হলো মানুষের বড় শত্রু।

বুর্জোয়া গনতান্ত্রিকগন ও প্রায়স মানুষের অধিকার স্বাধীনতার বানী প্রচার করেন, কিন্তু রাস্ট্র ও পুঁজিবাদের কারনে তা সত্যিকার ভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে না । তাদের সমাজে ক্রমান্বয়ে অসাম্য, শোষণ বাড়তেই থাকে। আজকের সাম্রাজ্যবাদি দুনিয়ায় বুর্জয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জাতিগত ও জাতি শোষণের চূড়ান্ত স্তরে অবস্থান করছে।

সোভিয়েত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ও আনুস্টানিক ভাবে গণতন্ত্রের কথা বলা হয়েছিলো, কিন্তু তাঁরা ও এক জাতির উপর থেকে অন্য জাতির প্রাধান্যকে নির্মূল করতে পারেন নাই। স্বশাসিত ব্যবস্থার কথা বললে ও বাস্তবে সোভিয়েত গুলো স্বসাশিত হয়ে উঠতে পারেনাই। অধিকন্তু, তাঁরা তাদের নিজেদের নাগরিকদেরকে রাষ্ট্রীয় নিপিড়ন থেকে মুক্তি দিতে পারে নাই। জাতীয় স্বাধীনতাকে কেবল স্বাধীন হলেই বা নিজস্ব সরকার গড়ে তোলেই নিশ্চিত করা যায়নি। তাই ব্যাক্তির স্বাধীণতা নিশ্চিত করার ভেতর দিয়েই জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন করা যেতে পারে।

জাতীয় পূর্ন স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য সম্প্রদায়গত কনফেডারেশন গড়ে তোলা যেতে পারে। যা ব্যাক্তিগত স্বাধীনতা অর্জনে সহায়ক হবে। আর সেই ব্যাক্তিগত স্বাধীনতার জন্য দরকার প্রত্যেক জাতির ভেতর  মুক্ত ও স্বেচ্ছাধীন সমিতি গড়ে তোলা।

জেন্ডার বা লৈঙ্গিক স্বাধীনতা ও কেবল ঘোষণা দিয়ে অর্জিত হয় না, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সেই কাজ করেছিলো। কিন্তু বাস্তবে তা খুব কমই অর্জিত হয়। নারীদেরকে গৃহ কর্ম ও শিশু লালন পালনের ভার থেকে মুক্তি দেবার প্রয়াস ছিলো খুবই দুর্বল। কিন্তু প্রকৃতিগত ভাবেই রাস্ট্র হলো মানুষের সত্যিকার স্বাধীকনতার  বিরোধী। তাই সেই ক্ষেত্রে ও রাষ্ট্র এই ইস্যূতে আন্তরিক ছিলো না একেবারেই- বাঁধা দেয়া তার ঐতিহাসিক ঐতিহ্য- চার্চ ও বুর্জোয়া সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করতে পারেনি। ফলে বিবাহ প্রথা আইন বহাল থেকেই গেল। জেন্ডার সমতা সামগ্রীক ভাবে কেবল মাত্র কনফেডারেশন গড়ার মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে। রাস্ট্র, ধর্ম, পুঁজিবাদ কোন কিছুই মানুষের সত্যিকার স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করতে পারবে না ।

রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবের অভিজ্ঞতা আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, নতুন একটি সামাজিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা অসম্ভব নয়। আমরা দেখেছি একটি সামাজিক সংগঠন ফেডারেশনের মাধ্যমে সোভিয়েত ব্যবস্থায় বুর্জোয়া কার্যক্রমের অনেক মন্দ্ব দিক ই বিতারিত করতে পেরেছিলো। তাদের তথাকথিত গণতন্ত্র, পার্লামেন্ট, সাধারন নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি প্রেরন যা সত্যিকার ভাবে মানুষকে সামাজিক প্রতিস্টান থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। তার বিপরিতে ভিন্ন ধারায় রাস্ট্র ও একানয়কত্বকে বিতারনের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। সেখানে সাম্যবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের জায়গায় - সামাজিক সংগঠন সহ সোভিয়েত গুলো সমাজ ও উৎপাদন ব্যবস্থার দায়িত্ব গ্রহন করেছিলো।

বুর্জোয়া রাস্ট্র সেনাবাহিনীকে নিজের স্বার্থে শ্রমিক শ্রেনীকে দমন করে রাখার জন্য ব্যবহার করে থাকে। ক্ষমতাসীন দল কোন কারনে ঝুঁকির লক্ষন দখলেই রাস্ট্রের হেফাজতের নামে সেনা তলব করে বসে। রাশিয়ায় সোভিয়েত ও কেই অপকর্ম করছে। দুনিয়া জোড়ে একই নিয়ম চালু করে বসে আছে বুর্জোয়া চক্র। সাধারন মানুষের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা সুরক্ষার জন্য আমরা মনে করি শ্রমিক শ্রেনীর মিলিশিয়া বাহিনী, গ্রাম সুরক্ষা দল, ও স্বেচ্ছাসেবক কর্মী বাহিনী ই উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। শ্রমিক শ্রেনীর তৈরী মিলিশিয়া বাহিনী রাস্ট্র ও শ্রেনীর বিলুপনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে।

প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর অবস্থা স্বীকার করেই  এনার্কিস্টগন বিশ্বাস করেন যে, বিপ্লবের সূচনা লগ্ন থকেই সকল মানুষের জন্য সমান সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরী। অন্যান্য লোকদের সাথেই শ্রমিক শ্রেনীকে ও একেই ভাবে কাজে লাগানো ও তার বিনিময় ব্যবস্থা সমান রাখতে হবে। তাদেরকে আলাদা ভাবে প্রদর্শন করা ঠিক হবে না । সকল মানুষের সমান অধিকার সুরক্ষার কাজ – বিপ্লবের প্রথম দিন থেকেই মেনে চলতে হবে। এটা সামাজিক ন্যায় বিচারের মৌলিক শর্ত।

অধ্যায়ঃ ২ । জাতীয়তা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কঃ

জাতিগত অধিকার নিজেই কোন নীতি নয়, বরং এটা হলো স্বাধীকারের একটি নীতি মাত্র। কোন জাতী বা জাতীয়তা প্রাকৃতিক সংস্থা নয়, বরং এতে ব্যাক্তিদের সাধারন ভাষা একটি মৌলিক উপাদান হিসাবে কাজ করে, আর এসব বিষয় গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠে পুঁজিবাদ ও রাস্ট্রের বিকশিত হবার প্রয়োজনে। শক্তিশালী জাতি গুলি দুর্বল জাতিসমূহকে পরাজিত করে তাদেরকে আত্মীকরনের চেস্টায় লিপ্ত হয়। জাতীয় গৌরবের প্রচারের আসল মতলবই হলো রাস্ট্র ও পুঁজিবাদের ক্ষেত্রভুমি প্রস্তুত করা। শাসক শ্রেনী সকল সময়েই ভাড়াটে শক্তি ব্যবহার করে জাতিতে জাতিতে ঘৃনা ও দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটায়, দেশ প্রেমের শ্লোগান তোলে মানুষকে মারমূখী করে দেয়- এই সকলের পেছনে ও রাস্ট্র এবং পুঁজিবাদ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অপকর্ম করে যায়।

তথাকথিত জাতীয় স্বার্থ, যা এখন রাস্ট্রীয় দৃষ্টিকোন থেকে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। ফলে জাতি সমূহের মাঝে পারস্পরিক ঘৃনার উদ্রেক হয়ে তা যুদ্বে রূপ নিচ্ছে। পুজিবাদি রাস্ট্র সমাজ সমূহে এখন এই বিষয় সমূহ সাধারন সমস্যার অংশমাত্র হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। যেমন – কোথাও কোথাও  স্বাধীনতার সমস্যা ইত্যাদি। যা কেবল শ্রমিক শ্রেনীর স্বার্থে তা সমাধান করা যাচ্ছে না ।

" একটি জাতির স্ব সিদ্বান্ত গ্রহনের অধিকার" এবং স্বাধীন সার্বভৌম অস্তিত্বের জন্য, জাতীয় বুর্জোয়াদের অধিকার তাকে তার সর্বহারা শ্রেণীর সীমাহীন শোষণের অধিকার ছাড়া কিছুই দেয় না; একটি বহু-জাতীয় দেশে এই অধিকারের প্রকৃতীকরণ যা সামাজিক বিপ্লবের ব্যানারকে  উর্ধে তোলে ধরে এবং এভাবে পুঁজিবাদের দ্বারা নিজেকে ঘিরে ফেলে, আসলে বিপ্লবের বিরুদ্ধে জাতীয় বুর্জোয়াদের আত্মরক্ষার অধিকারের স্বীকৃতি আদায় করা  আন্তর্জাতিক বুর্জোয়াদের অস্ত্র। ১৯১৭ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে রাশিয়ান বিপ্লবের অভিজ্ঞতার দ্বারা এটি দৃঢ়ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। "জাতীয় স্ব-সংকল্পের অধিকার" এর উপলব্ধি থেকেই স্বতন্ত্র স্বাধীনতার উপলব্ধি  আসে- অন্যান্য  জাতীয়তাগুলির মাঝে ও  – এসব কিছু থেকে  যদিও শোষিত শ্রেণীগুলি তাদের জন্য অভিজ্ঞতা লাভ করে খুবই সামান্য ।

অধিকন্তু, “প্রতিটি জাতির স্বীয় স্বাধীকারের অধিকারের সুরক্ষা ”- এই শ্লোগান এবং সেই ভাবে যৌক্তিক ভাবে সিদ্বান্তের দিকে এদিয়ে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়ত প্রজাতন্ত্রের এই বিষয়টি অনেকেই গভীর ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তাঁরা একটি বহুজাতিক রাস্ট্র বিনির্মানের জন্য হাত দেন। আর এসব কিছুর ভেতর দিয়ে প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর স্বার্থ, স্বাধীনতা, ও সামাজিক বিপ্লবের পথকে প্রশস্ত করতে চেয়েছিলেন।

ভুলবুঝার কোন অবকাশ নেই যে এনার্কিস্টগন জাতীয় স্বাধীনতার বিরুধী। এটা স্পস্ট যে এনার্কিস্টগন সকল সময়েই নিপিড়িত নির্যাতিত জাতী সমূহের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করে। তাদের নিকট জাতীয় সমস্যাকে একটি ব্যাক্তির জীবন মরনের মতই গুরুত্বপূর্ন বিষয় বলে বিবেচিত হয়। এটার প্রাকৃতিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক বিষয়ে কথা বলা ও সমর্থন জানানো একটি গুরুত্বপূর্ন নীতি হিসাবে সকলেরই বিবেচিত হওয়া দরকার । একটি জাতি বড় হোক বা ছোট হোক, তার সংস্কৃতি যতই সমৃদ্ব হোক বা  না হোক তার অধিকার আছে এটাকে ধারন করার, চর্চা করার, এটা নিয়ে কথা বলার – তাদের সেই অধিকারে হস্তক্ষেপ করা সমীচীন নয়। আসল কথা হলো জাতীয় অধিকার বলতে- নিজেদের মত চলার অধিকার;  সেই ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পরিবেশের নীতি অনুসারে স্বাধীকার ও সাম্যের নীতি বহাল রাখাকে নিশ্চিত করা বুঝায় ।

জাতিয়তা নিজে কোন নীতি নয় কিন্তু এটা একটি বাস্তবতা। কিন্তু এটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আন্দোলনকারী লোকেরা যখন জাতীয়তার উপর বেশী গুরুত্ব আরোপ করেন তখন তা অপরাধ হিসাবে গন্য হয়। এনার্কিস্টগন কখনই এই সংকির্ন জাতীয়তাবাদি চেতনায় কাজ করবে না। “ যাদের কথাই হলো আমাদের জাতীই শ্রেস্ট, আমরাই দুনিয়ার কেন্দ্রবিন্দু,আমাদের মহানত্ব দিয়ে সকলের উপর প্রভাব বিস্তার করব”- এরূপ বক্তব্যের সাথে  এনার্কিস্টগনের কোন প্রকার সম্পর্ক নেই।  আন্তর্জাতিক স্বাধীণতা এবং সাম্য ও ন্যায় বিচার হলো সকল জাতীয় স্বার্থের চেয়ে গুরুত্বপূর্ন।  তারা অল্প সময়ের জন্য স্বাধীনতার সাধ পাক বা না পাক জাতীয় স্বার্থের বাইরে আসতে চায় না । প্রতিটি রাস্ট্রই হলো স্বাধীনতা ও সাম্যের শত্রু। জাতীয়তাবাদের শ্লোগান দিয়ে যখন দেশ অন্যেদের প্রভাব থেকে মুক্ত করা হয় তখন দেখা যায় রাস্ট্র গঠনের পর পর ই তাঁরা জাতীয় স্বার্থের কথা বেমালুম ভূলে যান। তাঁরা বড় জাতি গুলোর প্রতি ঝুকে পড়ে আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি সমূহের সাথে দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। তাদের ভাষা, সংস্কৃতির উপর প্রভূত্ব কায়েম করে ফেলে। এমন কি রাস্ট্র ও সরকারের ক্ষমতাশীল ব্যাক্তিবর্গ  ক্ষুদ্র জাতি সমূহের কোন কথারই গুরুত্ব দেয় না । স্ব শাসনের ব্যাপারে অন্যান্য সাধারন মানুষের চেয়ে ও শ্রমিক মেহানতী মানুষ বশী উৎসাহিত হয়ে থাকেন। কিন্তু তা তাদের সমস্যার সমাধানে তেমন কোন ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনেনা । এটা রাট্রের জন্য ও বিপদজনক কেননা সেই রাস্ট্র তখন চাইবে তার দূর্বল প্রতিবেশীর উপর নিজের ক্ষমতা খাটিয়ে  তাকে করায়ত্ব করে রাখতে ।

আসল কথা হলো সেই সকল কারনেই এনার্কিস্টগন রাস্ট্রকে অস্বীকার করেন। তারা মনে করেন, রাস্ট্র জাতীগত সমস্যার ও সমাধান করতে সক্ষম নয়; কেবল মাত্র এনার্কিজম কায়েমের মাধ্যমেই জাতীয় সমস্যার সমাধান করা সম্ভব; স্বাধীন সাম্যবাদের বাস্তবায়ন করে ব্যাক্তি স্বাধীনতার নিশ্চয়াতা বিধানের মাধ্যমে স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে –মহাসমিতি গড়ে তুলে সাম্য ও স্বাধীকার বিধান সম্ভব হয়ে উঠবে। আর এভাবে প্রকৃতিক ধারায় জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা যাবে।

ভূবন ভিত্তিক মহাসমিতি গড়ে উঠবে সম্পূর্ন স্বেচ্ছাপ্রনোদিত ভাবে, নিজেদের ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সকল জাতীয় সমস্যার সমাধান করবে, সেখানে পূর্ন স্বাধিণতা ও সাম্য বজায় রাখা হবে। কোণ প্রকারের বুর্জোয়া মানসিকতার প্রশ্রয় থাকবে না । এমন ভাবে সমস্যার সমাধান করা হবে যাতে জাতিসমূহের মধ্যে প্রকাশ্য ও গোপন হিংসা প্রতিহিংসার স্থান না থাকে। কেবল মাত্র সম্প্রদায়গত মহাসমিতি সমূহ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয় ঠিক করবে- যেন পরস্পরের মধ্যে কোণ প্রকার শোষণ, নিপিড়ন, যুদ্ব বা দ্বন্দ্বের উৎপত্তি না হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা চুক্তি সমূহ কোন ভাবেই রাস্ট্র কৃতৃক নির্ধারিত হবে না। এখন যে জাতিসংঘ গড়ে উঠেছে তা কোন ভাবে জাতি সমূহের প্রতিনিধিত্ব করে না। বরং এটি  এখন একটি শোষক শ্রেনীর সমিতি বা সংঘ হিসাবেই কাজ করছে। তাঁরা দুনিয়া জোড়ে সকল প্রলেতারিয়েত শ্রেনী বিপরীতে কাজ করে যাচ্ছে। সেখানে বড় বড় দেশ সমূহ অস্ত্রের জোড়ে নিজদের মতামত অন্যের উপর ছাপিয়ে দিচ্ছে এবং দুনিয়াকে প্রতিনিয়ত যুদ্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মহা সমিতি সমূহ তাদের মহান কর্ম সম্পাদনের জন্য অবশ্যই সাম্যবাদি বিপ্লবের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাবে। তাঁরা প্রথমেই রাস্ট্রের স্থানে কমিউন ও ট্রেড ইউনিয়ন পরিস্থাপন করবেন। যা মানুষকে স্বেচ্ছা প্রনোদিত হবে, একেবারে  নিচে থেকে সামগ্রীকভাবে সুসংগঠিত করবে। সেই ক্ষেত্রে সকলের ই স্ব-শাসনের অধিকার নিশ্চিত করে কমিউন ও প্রভিন্স সমূহের মধ্যে একটি চমৎকার ঐক্য গড়ে তুলবে। তবে সেই ক্ষেত্রে কোন প্রকার ছোট বড় বৈষম্য করবে না । সেই স্ব শাসনের জন্য দুটি বিশেষ শর্তপূরন করা হবেঃ এমন কোন কাঠামো অনুমোদন করা হবে না যাতে পার্শ্ববর্তী কমিউনের স্ব শাসন বিঘ্ন ঘটে। কোন কমিউনেই কাউকে বাধ্যতামূলক ভাবে সদস্য করা হবে না ।

উক্ত কাঠামোর আলোকে এনার্কিস্টগন জাতীয় সমস্যা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বিশ্বময় সকল কৃষক ও প্রলেতারিয়েতদের ঐক্য বিধানে অগ্রনী ভূমিকা পালন করবেন। সেই ক্ষেত্রে সকলের লক্ষ্য হবে ব্যাক্তিগত সম্পত্তির বিলুপ্তি, এবং রাস্ট্র ব্যবস্থার বিতারন করা।  জাতিগত ভাবে সকল প্রকার অন্যায় অবিচার বিদূরিত করা হবে। প্রতিটি জাতীর স্ব শাসন নিশ্চিত করা হবে যেন সকলের জন্য স্বাধীকার ও সাম্যের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা যায়। তাই, আন্তর্জাতিক ওয়ার্কিংম্যান্স এসোসিয়েশন তাদের সামগ্রী কার্যক্রমে সবিশেষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। তাঁরা প্রতিটি এনার্কিস্ট ব্যাক্তি ও সংস্থার সাথে কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন করবে।

স্ব শাসনের  অধিকারের মতই এনার্কিস্টগন জাতীয় বিভক্তিকে ও স্বীকার করে নেয়। মানুষের জাতীয় আকাঙ্ক্ষাকে অস্বীকার করে না । তাঁরা এটাকে ও স্বাধীনতার অংশ হিসাবে মেনে নেন। তাঁরা কেবল প্রলেতারিয়েতদেকে ব্যবহার করে ফায়দা হাসিলের বিরুধীতা করেন, কোন ভাবে স্ব শাসনের বিরোধীতা করেন না, তবে সকল প্রকার রাস্ট্রীয় ধারনার তিব্র বিরোধী । এটা স্বীকৃত বিষয় যে দাসত্বের নিগড়ে বন্দ্বি জাতি সমূহ  দেশপ্রেমের নামে এক ধরনের প্রহেলিকায় ভোগেন। অন্য দিকে প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর প্রতি জাতীয়তাবাদি শাসক চক্রের একধরনের অবিশ্বাস জন্ম হয়। ( কেননা শ্রমিক শ্রেনীর বিশ্বাস ও আদর্শ হলো আন্তর্জাতিকতাবাদ) এনার্কিস্টগন উপনিবেশিক সকল জাতি সত্ত্বার স্বাধীকার ও সাম্যের জন্য লড়াই করেন। তাঁরা শ্রমিক ও কৃষকের সম্মিলিত প্রায়সে জতীয় মুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে চায় ।

অধ্যায়ঃ ৩ - প্রতিরক্ষা সংস্থা

ক) সেনাবাহিনীঃ

সাধারন জনগণের সামগ্রীক অংশগ্রহন ছাড়া কোন সত্যিকার বিপ্লব সম্ভব নয়। যদি কোন বিপ্লবী কাজে তা অনুপস্থিত থাকে তবে তাকে কোন ভাবেই আর বিপ্লব বলা যায় না; তাকে বিদ্রোহ, বা ক্যুদেতা বলা যেতে পারে। তার বেশী কিছু নয় । বিদ্রোহ বা অভ্যুত্থান কৃত্রিম ভাবে সৃজন করতে হয়। তবে বিপ্লবকে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি করতে হয়, সেই বিপ্লবী কার্যক্রম কেবল বিপ্লব সাধনে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। সেই প্রক্রিয়াকে গন অভ্যুত্থান বলা যায় না । একটি বিপ্লবকে সফল করার জন্য দরকার হলো সর্বস্থরের মানুষকে বিপ্লবী আন্দোলনে অংশ গ্রহন করানো। এই পদক্ষেপই কেবল বিপ্লবী কর্মের মাইল ফলক হয়ে থাকে, এমন কি বিপ্লব কোন কারনে ব্যার্থ হলে ও তা সাধারন মানুষকে শতাব্দির পর শাতাব্দি জোড়ে প্রেরণা যুগিয়ে যায় ।  এই ধরনের বিপ্লব পরবর্তী বিপ্লব সমূহকে ও এগিয়ে যেতে অনুপ্রানিত করে থাকে। যেমন- ইংলিশ, ফ্র্যান্স এবং রাশিয়ান বিপ্লব।

বিপ্লব পুরাতন ব্যবস্থা, পুরাতন সামাজিক কাঠামো এবং জীবন যাত্রার ধরন ও প্রকৃতিকে পাল্টে দেয়। এই প্রক্রিয়াগত কারনে বিপ্লবের কালে কিছু অনিয়ম ও বিশৃংখলা দেয়া দিতে পারে। সেই পুরাতন সমাজ ব্যবস্থা ভাঙ্গার সময় কিছু বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে তাকে অবদমন করা ঠিক নয়- যদি পুরাতন ব্যবস্থার অনুসারীরা শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসার চেস্টা চালায় তবে তাকে অবশ্যই কঠিন ভাবে দমন করতে হবে । তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নতুন ব্যবস্থার প্রবর্তন করে সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সময় ক্ষেপন করা সমীচীন নয়। তাই সেই সময় ক্রমাগত অর্থনৈতিক কর্মসূচী হাতে নিয়ে জনগণের চাহিদা পুরন করতে কারপন্য করা যাবে না । বিপ্লবীদেরকে প্রমান করতে হবে যে এরাই হলো সত্যিকার জনগণের বন্দ্বু বা সহায়ক গুষ্টি বা রক্ষক বা বন্দ্বু।

বিপ্লবীদেরকে প্রথমেই নিজদের সামরিক সংস্থার ভিত্তিমূল পাকাপোক্ত করতে হবে। তাই প্রথমেই সামরিক বাহিনীর সকল অস্ত্র সস্ত্র নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে আসতে হবে। পুরাতন সামরিক বাহিনীকে ভেঙ্গে দিতে হবে। নিজেদেরকে সামরিক কায়দায় গড়ে তুলতে হবে। সকল কল কারখানা ও গ্রাম নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসতে হবে। তবে গৃহযুদ্ব শুরু হলে সকল ক্ষেত্রে তা করা কিছুটা কঠিন হতে পারে।  সেই সময়ে অন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদি শক্তি বিপ্লবের বিপক্ষ শক্তিকে সমর্থন ও শক্তি যোগাতে পারে ।  এরা সামাজিক বিপ্লবের মধ্যে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে ।  এই পরিস্থিতিতে সামরিক বিজ্ঞানের আলোকে সামরিক সংস্থা গড়ে তুলতে হবে, তবে অবশ্যই বিপ্লবের লক্ষ্য থেকে সরে যাওয়া যাবে না । বিপ্লবের মৌলিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতেই হবে ।

বিপ্লবের মাধ্যমে কেবল প্রতিরক্ষা বিভাগকে পৃথকি করন করলই হবে না; তাকে বিশেষ ভাবে গড়ে তোলা চাই। প্রতিরক্ষা বাহিনীর লোকেরা ও বিপ্লবীকাজে অংশ নিবেন, তাঁরা বিপ্লবের সূচনা পর্বে খুবই গুরত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করার সুযোগ পাবেন। তবে তাঁরা প্রকৃত যুদ্বের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিজেরা হতাশ  হবেন না। সেই অবস্থায় সকল বিদ্রোহ ও বিশৃংখলাকারীদেরকে যথাযথ ভাবে মোকাবিলা করার জন্য প্রতিরক্ষা কর্মীগন সবিশেষ গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করবেন। সেই ক্ষেত্রে সকল প্রকার আধুনিক যন্ত্রপাতি ও কৌশল ব্যবহার করা হবে। তবে প্রচলিত বুর্জোয়া রাস্ট্রের সেনাবাহিনী, সোভিয়েত লাল ফৌজ বাহিনীর মত রীতিনীতি কোন ভাবেই অনুসরন করা হবে না । বিপ্লবী প্রতিরক্ষা বাহিনীর গঠন ও বিকাশের ক্ষেত্রে দুটি মৌলিক নীতি মেনে চলা হবে। প্রথমতঃ তা কোন ভাবেই স্বাধীনতার জন্য হুমকী হবে না। দ্বিতীয়তঃ প্রতিরক্ষার জন্য অপর্যাপ্ত শক্তির অধিকারী হবে না ।

নিয়মিত সেনাবিহিনীর বদলে এনার্কিস্টগন নতুন ধরনের মিলিশিয়া বাহিনীর প্রস্তাব করতে চায়। একটি আধুনিক মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তোলে রাখার জন্য নিম্ন লিখিত নীতিমালা অনুসরন করা হবেঃ

১) ১৮ থেকে ৪৫ বছরের সকল শ্রমিকগন সামরিক প্রশিক্ষন গ্রহন করবেন। তাঁরা সকলেই অস্ত্র পরিচালনায় সক্ষম হবেন।

২) ১৮ থেকে ৪৫ বছরের সকল নারীদেরকে মেডিক্যাল সেবার জন্য নিয়োগ প্রদান করা হবে, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষন দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। তাঁরা মিলিশিয়া বাহিনীর সাথে সংযুক্ত করা থাকবে।

৩) মিলিশিয়া বাহিনীর ব্যারাকে থাকার জীবনের ও অবসান হবে।

৪) মিলিশিয়া বাহিনীর প্রশিক্ষিন তা হোক সামরিক বা চিকিৎসা সংক্রান্ত সেই গুলো বিশেষ কোন ব্যারাকে হবে না । সকল প্রকার প্রশিক্ষন স্ব স্ব কর্মস্থলে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। শ্রমিকদেরকে কারখানায়, কৃষকদেরকে খামারে এবং ছাত্র/ছাত্রীদেরকে বিদ্যালয়ে সকল সামরিক প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা হবে ।

৫) প্রতি বছর ত্রিশ দিনের জন্য সকলের জন্যই এক প্রকার  প্রশিক্ষন মূলক সামরিক মহড়ার ব্যবস্থা করা হবে।

৬)  শ্রমিক শ্রেনীর মিলিশিয়া বাহিনী তাদের  কমিটিতে সামরিক বিশেষজ্ঞ, মহাসমিতির উৎপাদন কমিটির সংযোগ স্থাপন করা থাকবে। এই কিমিটিতে আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনার ও ব্যবস্থা রাখা হবে। যারা সাম্য ও স্বাধীকার নিশ্চিত করবেন।

৭) সরবরাহ বিভাগ খোলা হবে। এই বিভাগের সাথে সম্পৃক্ত থাকবে মহাসমিতির সদস্যবৃন্দ এবং সামরিক বিভাগের লোকেরা। যাদের কাজ হবে সামগ্রীক ভাবে পন্য সরবরাহ করা ।

8) শ্রমিক শ্রেনীর মিলিশিয়া বাহিনী নির্বাচনের মাধ্যমে গঠন করা হবে। যারা সুদক্ষ ও জনপ্রিয় তাদেরকে নিয়েই গঠিত হবে এই বাহিনী।

৯)  সামরিক বিভাগে যারা নিয়োজিত থাকবে তাদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষন প্রদানের জন্য প্রশিক্ষক ও কন্ডার নিয়োগ দেয়া হবে। তাদের কাজ হবে কল কারখানা ও গ্রামে সামরিক প্রশিক্ষনের ব্যবস্থায় অংশ গ্রহন করা। তাঁরা জনগণকে স্ব স্ব কাজে নিয়োজিত অবস্থায় সময় বেড় করে উৎপাদন মূখী কার্যক্রমের পাশাপাশি সামরিক কর্মকান্ডে ও সুদক্ষ করে গড়ে তোলা । তবে তাঁরা ও গ্রাম এবং কারখানা কমিটির সুপারিশ ক্রমে স্বীয় পদ হারাতে পারেন ।

১০) কোন দেশ সামাজিক বিপ্লব সাধিত হবার পর যদি দেখা যায় যে পার্শ্ববর্তী কোন বুর্জোয়া দেশ আক্রমন করতে পারে তবে  নাগরিকদেরকে সামরিক প্রশিক্ষন দিয়ে যে কোন প্রকার পরিস্থিতি মোকাবিলার ব্যবস্থা গ্রহন  করা হবে। সাবেক সকল সুদক্ষ অফিসার ও জেনারেলদেরকে বিপ্লবী কাজে বিশেষ করে প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত করা হবে। চলমান উৎপাদন মূখী কার্যক্রমের পাশাপাশি তাঁরা সামরিক ক্ষেত্রে ও গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখবেন।

১১) উপরে উল্লখিত শ্রমিক মিলিশিয়াদের সাংগঠনিক কাঠামোর কারনেই সামরিক ও উৎপাদন সংক্রান্ত কার্যক্রমের একটি সমন্বয় হওয়া দরকার। তাই প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সাংগঠনিক দিক গুলোর মাঝে সমন্বয় সাধন করতে হবে।

১২) প্রচলিত সকল কল কারখানা সাধারন সাম্যবাদি অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়া হবে। তাঁরা সাধারন উৎপাদন ব্যবস্থা ও সামরিক উৎপাদন মূখী কার্যক্রমকে সমন্বয় করে পরিচালনা করবেন। শ্রমিকদের মহা সমিতি বা কনফেডারশন সকল কার্যক্রমের পরিচালনায় নেতৃত্ব দিবে।

এই পদ্বতীতে সামরিক বাহিনী ও সামরিক অস্ত্রসস্ত্রকে বিপ্লবী সুরক্ষার জন্য কাজে লাগানো হবে। তবে কোন ভাবেই যেন জনগণের স্বাধীকার ও সাম্যকে নস্ট করতে না পারে সেই দিকে সবিশেষ সতর্ক নজর রাখা হবে। শ্রমিকদের মিলিশিয়া বাহিনী যেন আমলাতন্ত্রের খপ্পরে না পরে বা ভাড়াটে সৈনিকে পরিনত না হয় তার জন্য একটি পৃথক বিভাগ সকল সময় কাজ করে যাবে ।

খ) জনগণের নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ শান্তি বজায় রাখাঃ

এনার্কিস্টগন একটি নতুন সমাজ গড়তে চায়, যেখানে গঠন প্রক্রিয়ার ভেতরই সাধারন মানুষের সার্বজনীন অধিকার স্বীকৃত থাকবে। মানুষের স্বাধীকার ও সাম্য তখনই গড়ে উঠতে পারে যখন পারস্পরিক শ্রদ্বা ও সংহতি বজায় থাকে। কোন ভাবে কারো অধিকারকে অবজ্ঞা করার স্থান থাকবে না – আর তাকেই বলা যায় সত্যিকার প্রাকৃতিক ন্যায় বিচার ।

স্বাধীকার সমতা থেকে অবিচ্ছিন্ন, আবার সমতা ও স্বাধীকার থেকে অবিচ্ছিন্ন। সমতা ছাড়া স্বাধীকার একটি আনুস্টানিক ঘোষনা মাত্র।এটা সত্যিকার অর্থে একটি সংখ্যালঘু মানুষের দ্বারা সংখ্যাগুরু মানুষের উপর ছাপিয়ে দেয়া শাসন ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ধরনের শাসন ব্যবস্থা ও স্বাধীকার মুলত রাস্ট্র ভিত্তিক পুঁজিবাদের নামান্তর। সাম্যবাদ বিহীন সমাজ ব্যবস্থা রাস্ট্র ভিত্তিক সমাজবাদি সমাজেরই অপর নাম । এই সকল ব্যবস্থায় ব্যাক্তির কোন স্বাধীকার ও সাম্য থাকে না । তাই এনার্কিস্টগন একটি প্রাকৃতিক সাম্যবাদি সমাজ কায়েম করতে চায় । যেখানে সাম্য ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে । মানুষের চিন্তার জগত ও আচরনকে মুক্ত করা হবে ।

প্রাকৃতিক কোন অধিকার কোন আইনই অস্বীকার করতে পারেনা, তার কার্যকারিতাকে ও কেহ সীমাবদ্ব করতে চায় না । তাই সম্প্রাদায়গত কোন কাঠামো বা  উন্নত সাম্যবাদি সমাজ এবং এনার্কিস্ট সমাজ ব্যবস্থায় প্রকৃতিক আইনের চর্চা করা হবে ব্যাপক ভাবে । প্রচলিত যে লিখিত আইন আছে তা বাতিল করে দেয়া হবে। তবে কনফেডারেশনের জন্য লিখিত কিছু বিধিবিধান থাকবে। তবে সকল ক্ষেত্রেই প্রাকৃতিক বিষয়বলীকে ভিত্তি করে সিদ্বান্ত গ্রহন করা হবে।

প্রচলিত আধুনিক সমাজে যত অপরাধ হয় তার বেশীর ভাগ অপরাধেরই উৎস হলো ব্যাক্তিগত সম্পত্তি সম্পর্কিত। ফলে মানুষের প্রাকৃতিক যে অধিকার সমূহ আছে তা উপেক্ষা করেই ক্ষমতাসীনদের বিচার আদালতের কাজ করতে হচ্ছে। তবে এনার্কিস্টগন  যে সমাজ কায়েম করতে চায়, সেখানে কোন ব্যাক্তিগত সম্পত্তির অস্থিত্ব থাকবে না বলে অনেক অপরাধ এমনিতেই তিরোহিত হয়ে যাবে। যে সকল অপরাধ হতে পারে বলে ধারনা করা হয় তা হলো মানসিক সমস্যা সংক্রান্ত বা ব্যাক্তির পশ্চাৎপদতা বিষয়ক অপরাধ । আর সেই সকল অপরাধ নিবারনের জন্য থাকবে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত টিম।

অন্তর্বতীকালিন সময়ে আরো কিছু অপরাধ হতে পারে- তা হলো স্বাধীকার ও সাম্য সংক্রান্ত- যা সাধারন মানুষকে ও প্রভাবিত করতে পারে। যখন সাম্যবাদ কায়মের জন্য এনার্কিস্টগন পূর্ন সাম্যবাদ কায়েমের জন্য লড়াই করে তখন হয়ত কিছু লোক গৃহ যুদ্ব বাঁধিয়ে সামাজিক অস্থিরতা সৃজন করার চেস্টা করতে পারে। যে সকল ব্যাক্তিগন স্বাধীকার ও সাম্যের বিরুদ্বে কাজ করবেন তাদেরকে সামায়িক ভাবে সকল মানবিক মর্যাদা দিয়েই কাজ থেকে বিরত রাখা হবে বা অন্তরীন করে দেয়া হবে বা  স্থানান্তরে প্রেরন করা হবে । সকল বন্দ্বীদেরকে স্বাধীকার ও সাম্যের বিরোধী এবং অপরাধী মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করা হবে। এই সকল কার্যক্রম শ্রমিক মিলিশিয়াদের  কাউন্সিলের মাধ্যমে সম্পাদিত হবে ।

সামগ্রীক সমজের শিক্ষার জন্য ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করা হবে যেন মানুষের মন থেকে প্রতিশোধ মূলক চিন্তার অবসান হয়। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিশোধ নয় সংশোধনই হবে আসল উদ্দেশ্য। আর তা নিশ্চিত করতে শিক্ষা, চিকিৎসা প্রদান করা ও সমাজ থেকে অপ্রত্যাশিত কর্মকান্ডকে বিতারন করার ব্যবস্থা থাকবে। তাই প্রচলিত বুর্জোয়া ব্যবস্থায় যেমন আইন আদালত আছে একটি এনার্কিস্ট সমাজে থাকবে না। সকল কিছুই উৎপাদন মূখী হবে। ছোট ছোট অপরাধের জন্য কোন আদালত বা কাউন্সিলের দ্বারস্থ হবার দরকার নেই । তা সধারন সালিশের মাধ্যমে সমাধান করে দেয়া হবে ।

সমাজে যদি এমন কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে, সামাজিক বিধি বিধানের লংগন যেমন- খুন হত্যা বা মানুষের সাম্য ও স্বাধীকারের অধিকার হরন ইত্যাদি ধরনের অপরাধ সংগঠিত হয় তবে তা সম্প্রদায়গত কমিটি তার বিচার করবেন। সেই বিচারিক কমিটিতে থাকবেন- সমবায় সমিতির প্রতিনিধি, কমিউন প্রতিনিধি, মনোবিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক ও স্থানীয় গন্য মান্য ব্যাক্তিবর্গ।  সেই বিচারিক কমিটির সদস্য ও যখন প্রয়োজন রদ বদল করা যাবে। কোন কারাগার থাকবে না । অপরাধীদেরকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও মানসিক কাউন্সিলিং দেয়া হবে। এছাড়া ক্ষেত্র বিশেষে তাদেরকে উৎপাদন কন্দ্রে প্রেরন করা হবে। যেখানে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত থেকে তাঁরা মুক্তি পাবেন ।

এনার্কিস্ট সমাজে ব্যাক্তিগত সম্পত্তি ও রাস্ট্রের সকল অঙ্গ সমূহ  বিলুপ্তি করে দেয়া হবে, সেখানে কোন পলিশ থাকবে না । কমিউন গুলি নিজেদের নিরাপত্তা ও শান্তি রক্ষার দায়িত্ব নিজেদের হাতেই পরিচালনা করবে। সেই ক্ষেত্রে সকল জনগণের অংশগ্রহন নিশ্চিত করা হবে। পাড়া, মহল্লা ও সড়কের নিপত্তার দায়িত্ব পালনের জন্য নির্ধারিত কমিটি থাকবে। ক্রমধারা অবলম্বন করে দায়িত্ব পালন করবেন। ফলে প্রচলিত নিরাপত্তা, শান্তি ও শৃঙ্খলার জন্য সকল কিছুকেই নতুন করে সাজিয়ে তুলা হবে । প্রতিটি কার্যক্রমের যৌক্তিকতা ও স্বনির্ভরতা নিশ্চিত করা হবে। এই আত্মসুরক্ষার পদক্ষেপ সমূহ একটি মুক্ত সাম্যবাদি সমাজ বিনির্মানের উদাহরন হয়ে উঠবে।

অধ্যায়ঃ ৪ - বৈবাহিক এবং পারিবারিক আইন

ব্যাক্তিগত সম্পত্তির বিলুপ্তি এবং রাস্ট্র তার সকল প্রকার প্রতিস্টান সহ সব কিছু বিলিন করে দেয়া হবে। আধুনিক পারিবারিক পরিবশ গড়ে তোলার মাধ্যমে পরিবর্তনশীল সমাজে ক্ষমতা ও সম্পদের যুগ যুগ ধরে বংশ পরম পরায় স্থানান্তরিত হবার যে ঐতিয্য চলে আসছে তা তিরোহিত হবে। সকল প্রকার উত্তারাধিকার আইন বাতিল করে দেয়া হবে। এই কার্যক্রম বিপ্লবের সূচনাতেই গ্রহন করা হবে ।

প্রচলিত বৈবাহিক নিয়মে সরকারের অনুমোদন দরকার হয়, সমাজ ও পিতা মাতার সমর্থন লাগে – এই সকল বিষয় বাতিল করে মুক্ত বিবাহ বা নয়া পারিবারিক সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটানো হবে। এনার্কিজমের প্রাথমিক ধারনাই হলো মানুষের জন্য সাম্য ও স্বাধীকার নিশ্চিত করা । তাই পারিবারিক জীবনে বাধ্যতামূলক পরিবশের অবসয়ান ঘটিয়ে মুক্ত স্বাধীন পারিবারি জীবন গড়ে তোলার জন্য পরিবেশ সৃজন করা হবে।

মাইকেল বাকুনিন বলেছিলন, “ ধর্মকেন্দ্রিক দেওয়ানী প্রকৃতির বিবাহ প্রথা বাতিল করুন”। “ সকলের ই জীবনের সত্যিকার বাস্তবতার আলোকে জীবন যাপনে অভ্যস্থ হওয়া দরকার। একজন নারী ও পুরুষ একে অন্যকে ভালোবাসবে, একসাথে থাকবে তার জন্য কারো অনুমতির দরকার নেই। আবার যখন চাইবেন তখন পৃথক হবার জন্য ও অনুমোদন প্রয়োজন নেই। আবার যদি তাঁরা পুনঃ একত্রিত হতে চায় তবে তার জন্য ও কোন প্রতিস্টান বা ব্যাক্তির অনুমতির দরকার নেই । স্বেচ্ছাকৃত ও স্বাধীন পারিবারিক জীবনেই সত্যিকার ভালোবাসা বিরাজ করে। পারস্পরিক সম্পর্ক ও হয় দৃঢ়”।

পারিবারিক জীবন ও বৈবাহিক সম্পর্কের সাথে আরো একটি প্রশ্ন গভীর ভাবে জড়িত, আর তা হলো শিশুর যত্ন, শিক্ষা ও তাদের গড়ে উঠার বিষয় সমূহ। সমাজ কোন শিশুকে তাদের মাতা-পিতার নিকট থকে দূরে সরিয়ে নিবেনা। তবে ১৮ বছর পর্যন্ত তাঁরা পরিবারের তত্বাবধানে থেকেই শিক্ষা ও সামাজিকি করনের আওতায় থাকবে। সকল শিশুকে সমান সুযোগ সুবিধা দিয়ে সমন্বিত প্রক্রিয়ায় শিক্ষা প্রদান করা হবে। সেই সমন্বিত শিক্ষায় শারিরিক ও মানসিক উভয় শিক্ষাই গ্রহন করবে। আসলে তরুন সমাজ ই হলো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, আর সেই জন্য দরকার হলো তাদেরকে সঠিক ভাবে গড়ে তোলা। শিশুদের মাঝে কোন প্রকার বৈষম্য থাকবে না । সাম্য, সমতা ও স্বাধীকারের শিক্ষা নিয়েই তাঁরা বেড়ে উঠবে।

শিশুদের প্রাকৃতিক অভিভাবক হলেন তাদের পিতা মাতা। তবে তা কোন ভাবেই  নৈতিকতা বিরোধী নয় । শিশুদের বিকাশের সমাজেরও দায়িত্ব রয়েছে। তাদের বুদ্বিবৃত্তিক ভাবে মুক্ত পরিবশে বেড়ে উঠার সুযোগ দিতে হবে। পিতা মাতার কোন বিরোধ বা  সমস্যায় সমাজ শিশুদের বিকাশে দায়িত্ব নিবে।

এনার্কিস্টগন বিপ্লবের প্রথম দিন থেকেই বিবাহ ও পারিবারিক বিষয় গুলো নিয়ে কাজ করবে। ধীরে ধীরে এবং যৌক্তিক ভাবে স্বাধীন ও মুক্ত পরিবার গড়ে তুলার জন্য সবিশেষ কর্মসূচি গ্রহন ও বাস্তবায়ন করা হবে ।

বর্তমানে তথাকথিত, স্বাধীন ও মুক্ত সমাজে অনেক নারী পুরুষ বিবাহ বন্দ্বনে আবদ্ব হয়। সেখানে ধর্মীয় ও সামাজিক বিধি বিধানের কারনে তাঁরা কোন দিনই স্বাধীন মুক্ত জীবনের স্বাদ পায় না । আজীবন দাসত্ব আর পরাধীণতার শিকল পরেই ইহলোক ত্যাগ করে যায় । পরে থাকে তাদের দুঃখ আর কষ্টের দির্ঘ শ্বাস ! তাই, কেবল মাত্র স্বাধীন নর নারীর সমাজ গড়ে উঠতে পারে একটি এনার্কিস্ট সমাজে ।

অধ্যায়ঃ ৫ - সাধারন পর্যবেক্ষন

এনার্কিজমের দৃষ্টিতে আগামী দিনের সমাজ গড়ে উঠবে তিনটি উপাদানের উপর ভিত্তি করে। প্রথমটি হলো উৎপাদকদের জনসমিতি। দ্বিতীয়ত ভোক্তাদের জনসমিতি এবং তৃতীয়তটি হলো অঞ্চল ভিত্তিক জনসমিতি । সাম্য ও স্বাধীকার নিশ্চিত করার জন্য কনফেডারশন বা জাতীয় পর্যায়ের জনমহাসমিতি সমূহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করবেন।

আসল কথা হলো আগেই  এনার্কিস্টগন আগামীদিনের সমাজ ব্যবস্থাকে খুব সহজ সরল ভাবে উপস্থাপন করতে চায় না । তারা মনে করেন সমাজের গতিপ্রকৃতি সরল ভাবে সব সময় এগিয়ে যায় না । অনেক ক্ষেত্রেই তা একেবেকে সর্পিল গতিতে এগিয়ে  চলে । মানব সমাজের সমস্যা যেমন বৈচিত্রময় তেমন তার সমাধান করা ও সহজ পন্থায় সকল সময় সম্ভব হয় না। তাই তেমনি ব্যাক্তি বিশেষের চাহিদা ও সামাজিক পরিস্থিতিকে ও মৌলিক ভাবে বিবেচনায় নিতে হয়।

প্রতিদিনের সংগ্রামঃ

সংগঠন, কৌশল এবং প্রতিদিনের কাজ-

রাস্ট্রীয় পুঁজিবাদের বিরুদ্বে দ্রুত সাফল্য অর্জনের জন্য এনার্কিস্টগন ট্রেড ইউনিয়ন সমূহকে সু সংগঠিত করেন। তাঁরা এতে শিল্প শ্রমিক ও কৃষক সমাজকে সম্পৃক্ত করে থাকেন। বিপ্লবী ট্রেড ইউনিয়ন সমূহে কেবল সাময়িক পরিবর্তনের জন্য কাজ করবে না বরং তাঁরা একটি ভবিষ্যৎ সুন্দর সমাজ গড়ে  তুলার জন্য কাজ করে যাবে ।

বিভিন্ন শিল্প প্রতিস্টানের ট্রেড ইউনিয়নের অংশগ্রহনে ফেডারেশনের মাধ্যমে ফেডারেল কাউন্সিল গড়ে উঠবে। সমগ্র দেশের সকল ফেডারেশন মিলে কনফেডারেশন অব লেবার  গড়ে তোলা হবে। সকল পুঁজিবাদী প্রতিস্টানিক কাঠামোর বিপরিতে গড়ে তোলা হবে সাম্য ও স্বাধীকারের জন্য নয়া সংস্থা ।

যেহতু লেবার অব কনফেডারেশন হলো নতুন সমাজের জন্য একটি বিশেষ সংস্থা, যা আগামী দিনের জন্য সংস্থা ও ব্যাক্তির স্বাধীকার নিশ্চিত করার জন্য কাজ করবে- এবং সংস্থা সমূহের জন্য মহা সমিতি গড়ে তোলবে।

সামগ্রীক ভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লড়াই সংগ্রামকে নিজেদের কর্ম হিসাবে গ্রহন করবে। এনার্কিস্টগন নিজেদের সংস্থার বিশ্লেষণ করে আদর্শগত বাস্তবায়ন কৌশল ঠিক করবেন ।

এনার্কিস্টগন নিজেদের প্রচারনা মূলক কর্মকান্ডে স্থানীয় সংস্থা গুলোকে সম্পৃক্ত করবেন। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের জনগণকে আদর্শের আলোকে জীবন যাপনে অভ্যস্থ করে গড়ে তোলার জন্য সংস্থা ভিত্তিক প্রচারনার সবিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এমন কি রাজনৈতিক দল ও তাদের সমর্থকদের চিন্তা চেতনার পরিবর্তনের জন্য ও প্রচারনা মূলক কাজ অতি গুরুত্বপূর্ন কাজ।

এই ভাবে নিরবিচ্ছিন প্রক্রিয়ায় শ্রেনী সংগ্রাম পরিচালিত হবে । শ্রমিক শ্রেনীর মানুষ ও কৃষক শ্রেনী লড়াইয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন। ফলে মানুষের মাঝে শ্রমিক শ্রেনীর স্বার্থে সামাজিক বিপ্লবের ঐতিহাসিক অনিবার্যতা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। একেই সময়ে প্রতিটি ব্যাক্তি ও পরিবার নিত্য দিনের কাজ কর্মে সাম্যবাদি আদর্শের চর্চা দেখতে পাবেন। তবে, সেই ‘চর্চার নামে প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব নয়” বা রাস্ট্রবাদি সমাজবাদ ও নয়। মানুষ দেখতে পাবে যে, সামাজিক বিপ্লবের ভেতর দিয়ে মানব মুক্তির এক মহাদিশা।

আন্তর্জাতিক শ্রমিক ঐক্যের ভেতর দিয়ে সামাজিক বিপ্লব তরান্বিত হবে- বুর্জোয়া ভাবধারার অবসান হবে মানুষ সংকির্ন জাতীয়তাবাদি চিন্তার বদলে বিশ্ব মানবতার ভাবাধারায় উদ্ভাসিত হবে ।

এনার্কিস্টগন তাদের বিপ্লবী কার্যক্রম কোন ভাবেই কেবল ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে সীমাবদ্ব  করে রাখবে না, তাঁরা সকল বিদ্যালয়, সমবায় সমিতি, গ্রামীন ও শহরের প্রাশাসন সমূহকে তাদের বিপ্লবী কর্মে সম্পৃক্ত করবে। এনার্কিস্টগন শোষিত শ্রেনীর লোকদের সাথে একাকার হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবেন। প্রতিদিনকার সকল সমস্যার সমাধানে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবেন।

এনার্কিস্টগন সকল প্রকার পার্লাম্যান্টারী কার্যক্রম বর্জন করবেন। তাদের কর্মের কৌশল হলো, ডাইরেক্ট একশন, গন বিক্ষোভ, ধর্মঘট, অসহযোগীতা, বর্জন, সাবোট্যাজ, এবং সরাসরি প্রভাব ফেলে এমন সব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা।

পরিশিষ্টঃ ১ । কিভাবে অতীতে উত্পাদনের সমস্যাটি বিবেচনা করা হয়েছিল ।

ক) আন্তর্জাতিকঃ

আন্তর্জাতিক পরিষরে ভাঙ্গনের আগে, জুড়া ফেডারেশনের সদস্যগন ২০শে আগস্ট, ১৮৭০ সাল পর্যন্ত লিখেছেন আগামী দিনে ইউরূপের সংস্থা সমূহ কেমন হবেঃ

“ ভবিষ্যতে ইউরূপের ফেডারেশন সমূহ বিভিন্ন জাতি ভিত্তিক গড়ে উঠবে, তাঁরা রাজনৈতিক ভাবে গনপ্রজাতন্ত্রী হিসাবে বিকশিত হবে। তবে সাধারন শ্রমিক সংগঠন সমূহ জাতীয়তা নির্বিশেষে গঠন করা হবে”।

১৮৭২ সালে হেগ কংগ্রেসে বিভক্তির পরে, এনার্কিস্টগন তাদের কংগ্রেস সেন্ট লিমারে সম্মেলন আহবান করেন। তাঁরা আগামী দিনের সমাজ কেমন হবে তা নিরূপন করার জন্য বলেনঃ

“ প্রলেতারিয়েত সংঠনের সামনে একটি মুক্ত স্বাধীন অর্থনীতির ফেডারেশন ব্যবস্থা গড়ে  তোলার কোন বিকল্প নেই। যার মৌল ভিত্তি হবে আন্তর্জাতিক  সার্বজনীন শ্রম, সাম্য, স্বাধীনতা এবং সকল রাজনৈতিক সরকার থেকে মুক্ত; আর সেই সংগঠন সমূহ হবে প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর সম্পূর্ন স্বনির্ভরশীল ভাব ধারার সংস্থা, তা হবে সর্ববৈ স্বশাসিত”।

খ) মাইক্যাল বাকুনিনঃ

আমাদের সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে, “ স্বেচ্ছা ও স্বপ্রনোদিত সংস্থা সমূহের সম্মিলনে, তা নিচের দিক থেকে উপরের দিকে সমন্বিত হয়ে গড়ে উঠবে, তা কৃষি এবং শিল্প কারখানায় সমভাবে এগিয়ে যাবে-বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পের ক্ষেত্রেও একেই পন্থা অনুসরন করা হবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি সমূহের সমিতি গুলো মিলিত হয়ে প্রদেশ ও জাতীয় ফেডারশন গড়ে তুলবেন। যা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এক সুমধুর ভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠবে”। (বার্তা-১৯৭-৯৮ পৃস্টা)

“ কৃষি কমিউনের গড়ে তোলার পর - যে সকল কৃষক নিজের হাতে যতটুকু জমি চাষ করতে পারবেন কেবল ততটুকুর ই মালিকানা ধারন করতে পারবেন- সকল পুঁজি ও উৎপাদন ক্ষেত্রের মালিকানা ধারন করবেন শ্রমিক শ্রেনীর লোকেরা- তাদের সমিতি সমূহ। কোন প্রকার রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড পরিচালনার অনুমোদন থাকবে না- তবে স্বাধীন শ্রমিক কৃষকদের জন্য সমিতি গঠন করার পূর্ন স্বাধীনতা থাকবে”। (উৎপাদক সমিতি- ৯৭ পৃস্টা।)

বাধ্যতামূলক ভাবে এনার্কিস্ট সমাজে সকলকেই শ্রম দিতে হবে । তা হবে যৌথ ও সমান ভাবে- সেখানে সকলেই কাজ করবেন। তবে সাবেক বুর্জোয়া শ্রেনীর লোকেরা কাজ করতে চাইবে না, তবে তাদেরকে ও কর্মে সম্পৃক্ত করার ব্যবস্থা থাকবে। তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হবেঃ  এই সমাজে  কাজ বিহীন খাবার মিলবে না। অর্থাৎ “যিনি কাজ করবেন না, তিনি খাবার পাবেন না”।

বিপ্লবের পর, গ্রাম ও শহরের মালিক হবেন প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর মানুষেরা- আর তা হবে যৌথবে। প্রতিটি পরিস্থিতিতেই তাদের মালিকানার স্বাক্ষর থাকবে, তবে তা হবে স্থান বিশেষে। বিভিন্ন প্রদেশ, কমিউন ও সামগ্রীক ভাবে সভ্যাতার ধারক ও বাহক হবেন শ্রমিক শ্রেনীর মানুষ। প্রচলিতি ব্যস্থায় যারা যে ভাবে মালিকানা দাবী করছেন, তা বিপ্লবের পর আমূল পাল্টে যাবে – তা হোক পুঁজি বা উৎপাদন যন্ত্র বা ভূমি – সকল কিছুর মালিকানা স্থানান্তরিত হবে শ্রমিক- কৃষকের হাতে।

আর সেই সকল কার্যক্রম বাস্তবায়নে তাড়াহুড়া করা হবে না। তার জন্য হয়ত এক শাতাব্দি ও লেগে যেতে পারে। তবে সেই প্রক্রিয়া বিপ্লবের সূচনাতেই শুরু হবে ।

গ) ক্রপতকিনঃ

এখন আমাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া বা পদ্বতী ভূল ভাবে পরিচালিত হচ্ছে। পুঁজিবাদে শিল্প ভিত্তিক ব্যবসা বানিজ্য সত্যিকার ভাবে সমাজের চাহিদাকে বুঝার চস্টা করে না; তাদের সকল আগ্রহ হলো মধ্যসত্ব ভোগীদেরকে কি করে বেশী পরিমানে লাভবান করা যায় । সামাজিক বিপ্লবের কার্যক্রম সূচনা থেকেই উৎপাদন ব্যবস্থাকে জনগণের চাহিদার আলোকে পুনঃবিন্যাস করা হবে। সকল উৎপাদন পদ্বতী সমূহ সাধারন মানুষের হাতে চলে যাবে। সকলেই সব কিছুর মালিক হবেন। উৎপাদন সংস্থা সমূহ পর্যায়ক্রমে ব্যাক্তিগত মালিকানার বাজেয়াপ্তি শুরু করবে। সমাজকে অবশ্যই এনার্কিস্ট ভাবধারার আলোকে গড়ে তোলার কাজ চলবে। আমাদের প্রথম কাজই হলো সমাজে সাম্যবাদ কায়েম করা। নতুন সমাজ গড়ে তোলার জন্য প্রধান কাজ হবে নিজেদের মধ্যে ও সংস্থা সমূহের ভেতর “স্বেচ্ছা মূলক চুক্তি” সম্পাদন করা । কমিউন গুলোর মৌলিক ভিত্তিই হবে স্বেচ্ছা মূলক সমিতির সম্মিলন। কমিউন সমূহের মধ্যে ফেডারেশন গড়ে তোলা। “রুটি ও স্বাধীনতা”- এই বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন মহান চিন্তাক  পিটার ক্রপতকিন।

পিটার ক্রপতকিন তার জীবনে শেষের দিকে তার মতবাদকে আরো সুনির্দিস্ট করে প্রকাশ করেছিলেন। তার প্যালোস ডি রিভোল্ট (১৯১৯) এর ভূমিকায় তিনি তার “রুটি এবং স্বাধীনতা” বইটির বক্তব্যের চেয়ে ও বেশী স্পস্ট করে তোলে ধরেন।  তিনি বলেন, আমার ধারনা ছিলো আমাদের মনন কেবল আমাদের সমাজ দ্বারাই নির্মিত হয়, তা হয় গ্রামে, নগরে, শহরে, ট্রেড ইউনিয়নে, প্রদেশ ও পুরো জাতিতে- আসলে এই জটিল প্রক্রিয়াটি সমগ্রীক অবস্থার উপরই নির্ভর করে।

ঘ) পোগেট এবং পটাউডের  বিপ্লবী সিন্ডিক্যালিজম

ক্রপতকিন বলেন, এনার্কিজমের আরো একটি ভিন্নরূপ রয়েছ, আমাদের কমরেড পোগেট তার “ সিন্ডিক্যালিজম কি করে অর্জন করা যায়” – নামক গ্রন্থে তার ভাষ্য তোলে ধরেছেন। তার মতামত হলো, এনার্কিস্ট সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন এবং সিন্ডিক্যাট সম্মিলিত ভাবে গনজোয়ার সৃজন করে বিপ্লব সাধন করবে। তার কথা হলো ফ্রান্সে ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্বে একবার বিপ্লব হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে বিনিয়োগ করে যারা ক্ষমতাশালী হতে চায়, তাঁরা কংগ্রেসের মাধ্যমে  পুজিপতিদেরকে সুরক্ষা করতে পারে। আবার চাইলে উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে বা বন্দ্ব করেও দিতে পারে। এটা স্পস্ট যে শ্রমিক শ্রেনীর মানুষের সংগঠনের মাধ্যমেই সামাজিক বিপ্লব সাধন হতে পারে।

আমি পোগেটের মতামতের সাথে ঐক্যমত পোষণ করতে পারছিনা, তবে আমি তার বইটি সকল বিপ্লবী পাঠকদেরকে পড়ার জন্য সুপারিশ করছি। যারা এখোনো বিপ্লবের স্বপ্নদেখেন বা সামাজিক পরিবর্তনের জন্য কাজ করছে।

পরিশিষ্টঃ ২ - আই, ডব্লিউ, এ (IWA) - বিপ্লবী সিন্ডিকালিজমের মূলনীতি

বিপ্লবী সিন্ডিক্যালিজম গড়ে উঠেছে শ্রেনী সংগ্রামের উপর ভিত্তিকরে, এর লক্ষ্য হলো কায়িক ও বুদ্বিবৃত্তিক সকল প্রকার শ্রমিকদের সংস্থা গড়ে তোলা যারা নিজেদের সার্বিক মুক্তির জন্য মজুরী দাসত্বের অবসান ঘটাতে রাস্ট্রীয় নিপিড়নের অবসান ঘটাবেন। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে স্বাধীন সাম্যবাদী এক নয়া সমাজ গড়ে তোলা । তবে শ্রমিক শ্রেনীর লোকেরা নিজেদের বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে সার্বিক লক্ষ্য অর্জন করবে। সেই ক্ষেত্রে আর্থিক সংস্থা সমূহ নিজেদের যোগ্যতায়ই নিজেদের সকল লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে।

বিপ্লবী সিন্ডিক্যালিজম এটা নিশ্চিত করতে চায় যে, বর্তমানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে ধনীক শ্রেনীর যে মালিকানার একচাটিয়াবাদ  চলছে তা বিতারিত করে কারখানা ও খামারে চলমান সকল প্রকার হাইরারকি বা পদসোপানের অবসান ঘটিয়ে একটি সুসম ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। সরকার ও রাজনৈতিক দল সমূহের ক্ষমতার অপব্যবহার দূরী করনের জন্য তার বিকল্প হিসাবে কারখানা ও খামারে শ্রমিক কাউন্সিল গড়ে তোলা হবে। রাজনৈতিক দল ও সরকারের বিপরিতে অর্থনৈতিক সংস্থা গড়ে তোলার চেস্টা করা হবে। সরকারের পরিবর্তে এই সংস্থাই সকল কিছুর ব্যবস্থাপনা করবে। এই উদ্যোগের উদ্দশ্য কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা নয় বরং তার উদ্দেশ্য হলো রাস্ট্রীয় সকল কর্মকান্ডের বিলুপ্তি ঘটানো। এই ক্ষেত্রে বিবেচনার বিষয় হলো সম্পদের উপর একচাটিয়াবাদের অবসান হলে, একটি বিশেষ শ্রেনীর প্রাধান্যের ও অবসান হবে, রাস্ট্রীয় কাঠামোর বিলুপ্তি হবে,এমন কি “সর্বহারার একনাকত্বর” ও অস্থিত্ব মেনে নেয়া হবে না। কেননা প্রভাবক যেকোন কিছুই মানুষের স্বধীকারকে বাঁধা গ্রস্থ করে দেয়।

সামাজিক পরিবর্তনে বিপ্লবী সিন্ডিক্যালিজমের দুটি ভূমিকা থাকেঃ একদিকে মানুষের দৈনিন্দিন জীবনে অর্থনৈতিক, সামাজিক, ও ক্ষেত্রে  বুদ্বিবৃত্তিকভাব শ্রমিক শ্রেনীর উন্নয়ন ঘটনো। অন্যদিকে, মানুষের জন্য মানুষের দ্বারা সকল উৎপাদিত পন্য সামগ্রী স্বাধীনভাবে বিতরন করার জন্য কাজ করবে। প্রচলিত বিতরন ব্যাবস্থার জায়গায় নয়া বিতরন ব্যবস্থা চালু করা হবে। নয়া ব্যবস্থা কোন সরকারের আইন বা আদেশে নয় বরং উৎপাদন কারী সংস্থা সমূহের স্বাধীন চুক্তি মোতাবেক পন্য বন্ঠন করা হবে। এই প্রক্রিয়ায় মেধা ভিত্তিক ও কায়িক শ্রমদানকারী প্রতিটি ব্যাক্তি অংশ গ্রহন করবেন। উৎপাদনের প্রতিটি  স্তরেই সাম্য ও স্বাধীকারের নীতি অনুসরন করবেন।

বিপ্লবী সিন্ডিক্যালিজম সর্বদাই  সাংগঠনিক কেন্দ্রীকতায় অনিহা প্রকাশ করে থাকে। মূলত  রাষ্ট্র ও চার্চ থেকেই সকল কিছুতে একটা কেন্দ্রীকতার প্রবনতার উৎপত্তি হয়েছে। এই প্রবনতার কারনে অনেক সৃজনশীল ও স্বাধীন চিন্তা চেতনার অপমৃত্যু ঘটে থাকে। কেন্দ্রীকতা লালনের কারনেই একটি বিশেষ গুষ্টি ও কতিপয় ব্যাক্তি ফায়দা হাসিলের সুযোগ পেয়ে যায় । এরা সমগ্র সমাজের উপর ছড়ি ঘুরানোর মওকা পেয়ে যায় । ব্যাক্তির গুরুত্ব হ্রাস পায়। উপর থেকে নিচের দিকে হুকুম জারি করতে থাকে। ঐক্যের নামে সংখ্যা গরিস্টের স্বার্থ সঙ্খ্যা লঘূর উপর ছাপিয়ে দেয়া হয়। শৃঙ্খলার নামে প্রানহীন এক পঙ্গু সমাজের জন্ম হয়। মানুষ সত্যিকার শিক্ষা গ্রহন করতে পারেন না । আর সেই জন্যই বিপ্লবী এনার্কিস্টগন একটি ফেডারেশন ভিত্তিক সমাজের জন্য লড়াই সংগ্রাম করছে । আর সেই ফেডারেশন গড়ে উঠবে তৃনমূল থেকে সমাজের সকল স্থরে।

বিপ্লবী সিন্ডিক্যালিজম সকল প্রকার সংসদীয় পদ্বতীর বিরোধিতা করে এবং সকল প্রকার আইন প্রনয়ন কারী সংস্থাকে অস্বীকার করে। স্বার্বজনীন ভোটাধীকারের মাধ্যমে যা হয় তা সত্যিকার ভাবে মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনা। আধুনিক সমাজে ও এটা এক প্রকার প্রহেলিকা। প্রতিটি সরকারের সময়েই দেখা যায় প্রতিটি সংসদ একটি বিশেষ ঝোঁক ও প্রবনতার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। সাধারন মানুষের জন্য ন্যায় বিচার, সাম্য ও স্বাধীকারের জন্য কাজ না করে বিশেষ একটি চক্রের জন্য দাসত্বই চর্চা করে থাকে। মুক্ত ভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সাংসদ্গন হারিয়ে ফেলেন।

বিপ্লবী সিন্ডিক্যালিজম বিশেষ কিছু মহল বা ব্যাক্তির ইচ্ছাকৃত রাজনৈতিক নীতিমালা বা ভৌগলিক সিমান্তকে অস্বীকার করে, এটা কোন প্রকার জাতিয়তাবাদকে স্বীকার করে না কিন্তু তা আজ অনেক আধুনিক রাস্ট্রের ধর্মে পরিনত হয়েছে । এই পরিস্থিতির জন্য ধনিক শ্রেনীর স্বার্থ জড়িত আছে। তবে এটা আঞ্চলিক পার্থক্যকে বিশেষ ভাবে বিবেচনায় নিয়ে থাকে এবং প্রত্যেক পিছিয়ে পড়া অঞ্চল, জাতি ও গৌস্টির চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করেবে।

এই সকল কারনেই বিপ্লবী সিন্ডিক্যালিজম সকল প্রকার সামরিক পথ ও পন্থার বিরোধিতা করে। সামরিক ব্যবস্থার বিরোদ্বে প্রচারনা চালানোর জন্য নিজেরা অংশ গ্রহন করে এবং অন্যান্যদেরকে উৎসাহিত করে থাকে।  এনার্কিস্টগন সামগ্রীকভাবে প্রচলিত ব্যবস্থার উচ্ছদ করতে চায়। প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে কোন প্রকার ব্যাক্তি ভিত্তিক সামরিক সেবাদানের ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটানো হবে। সমূলে সামরিক শিল্পের ও যুদ্বের উপকরন তৈরীর কারখানা উঠিয়ে দেয়া হবে।

বিপ্লবী সিন্ডিক্যালিজম সকল সময়েই ডাইরেক্ট একশনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে সম ভাবধারার সকল প্রকার আন্দোলন সংগ্রামের সমর্থন ও সংহতি জানিয়ে থাকে। অর্থনৈতিক একচাটিয়াবাদ ও রাস্ট্রের যেকোন ধরনের প্রভাব প্রতিপত্তির বিরোদ্বে কাজ করে থাকে। তাদের লড়াইয়ের পদ্বতি হলো- ধর্মঘট, অসহযোগ, স্যাবুটাজ ইত্যাদি। ডাইরেক্ট একশন কর্মসূচির মাধ্যমে সাধারন ধর্মঘট পালনের মাধ্যমে বিপ্লবের পরিবেশ তৈরী হয় তার যথাযথ চর্চার ভেতর দিয়েই সামাজিক বিপ্লবের সূচনা করা যতে পারে।

আমরা সকলেই জানি ক্ষমতাসীন চক্রের ছত্রছায়ায়ই বেশীর ভাগ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটে থাকে, সিন্ডিক্যালিস্টগন ভালো করেই জানেন যে সরকার আশ্রিত পুজিবাদিদের বিরোদ্বে মুক্ত স্বাধীন সমাজবাদের লক্ষ্যে সফল হতে হলে চূড়ান্ত পর্যায়ে লড়াই তো করতেই হবে। এনার্কিস্টগন সহিংসতা করতে তখনই বাধ্য হয় যখন নিজেদের অস্থিত্ব বিপন্ন হতে দেখে। অর্থাৎ কেবল আত্মরক্ষার্তেই সহিংস পথ বেচে নেয় । নইলে শান্তিপূর্ন পথ ই হলো এনার্কিস্টদের বিপ্লবের পথ । বিপ্লবী জনগণ যখনই পুঁজি, জমি, কারখানা সহ সকল উৎপাদন যন্ত্রকে সামাজিক মালিকানায় নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহন করবেন তখনই বর্তমান মালিক পক্ষ এই কাজে বাঁধা দিবে। তখন সেই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রচারনা সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হতে পারে।

১০

এই কর্মকান্ড কেবল মাত্র বিপ্লবী অর্থনৈতিক সংগঠন পরিচালনা করবে। শ্রমিক শ্রেনীর মানুষেরা সেই সংগঠন জন্ম দিবে ও পরিচালনা করবেন। কোন তথাকথিত রাজনৈতিক দল নয়। সৃজনশীল পন্থায় সংগঠিত হয়ে মুক্তসাম্যবাদি বিপ্লব সাধন করবে। যা সমাজের সকল মানুষকে রাষ্ট্র, পুঁজিবাদ, কর্তৃত্ববাদ, পদসোপান সহ সকল প্রকার শোষণ নিপিড়নের হাত থকে মুক্ত করবে।


Share Tweet Send
0 Comments
Loading...
You've successfully subscribed to Bangladesh ASF
Great! Next, complete checkout for full access to Bangladesh ASF
Welcome back! You've successfully signed in
Success! Your account is fully activated, you now have access to all content.