স্বাধীন বাংলাদেশে বাক-স্বাধীনতা

স্বাধীন বাংলাদেশে বাক-স্বাধীনতা

স্বাধীন বাংলাদেশে বাক-স্বাধীনতা

প্রচলিত রাস্ট্র চায় জনগনের পুর্ন আনুগত্য। সেই অনুগত্যে কোন প্রকার কমতি তার কাছে গ্রহন যোগ্য নয়। তাই সে নানা কলা কৌশল, ফন্দি ফিকিরের আশ্রয় নেয়। আনুগত্য আদায়ে প্রয়োগকরে দন্ড ও শাস্তি। প্রদর্শন করে ভয়ভীতি। মক্ত চিন্তা চিন্তা, মুক্তবাক রাষ্ট্র বড়ই মাথাব্যাথার কারন। তাই সে প্রায়সই নাগরিকের বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে। রুদ্বকরে মানুষের কন্ঠস্বর।

মানুষের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এ উক্তিটি উপলব্ধি করে বলা যায়, মানুষের মৌলিক অধিকার থেকে চিন্তার স্বাধীনতাকে আলাদা করা যায় না। কেননা, মানুষ বুদ্ধিদীপ্ত প্রাণী। তার বিচার বিবেচনা করার ক্ষমতা আছে। কোনো মানুষ যখন এই বিচারক্ষমতা হারিয়ে ফেলে বা কোনো সংস্কারের নিকট মাথা নত করে তখন আত্মবিশ্বাসের যূপকাষ্ঠে বিবেককে সে বলি দিয়ে চেতনাকে বন্দী করে গতিহীন অন্ধ কারাগারে। সমাজ, রাষ্ট্রে মানুষের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা যদি রক্ষিত না হয় তাহলে অশুভ শক্তির বিকাশ দৃশ্য-অদৃশ্য সব স্তরে ঘটে। ফলে সহনশীল সংস্কৃতির পরিবর্তে, অসহনশীল দানবীয় সংস্কৃতি জায়গা করে নেয় যা রাষ্ট্র ও সমাজকে আক্রান্ত করে এবং সৃষ্টিশীলতার পথ স্বাভাবিকভাবেই রুদ্ধ হয়ে আত্মবিকাশের প্রশ্ন হয়ে ওঠে সাংঘর্ষিক। এজন্য আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের মূল শর্ত পক্ষ-বিপক্ষের চিন্তার অধিকার রক্ষা করা। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ও সক্রেটিস সম্ভবত প্রথম অধিকারের কথা বলতে শুরু করেন। তৃতীয় শতাব্দীতে সম্রাট অশোকের কিছু পদক্ষেপ চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার বিষয়টা নতুন করে আলোচনায় আনে।

আমাদের কি বাকস্বাদীনতা আছে ? হ্যাঁ ! পুরোটাই আছে। যা খুশী তাই বলতে পারবেন, কেউ কখনও বাধা দেবে না। কিন্তু সমস্যা হল আপনার কথা শুনে অতিউৎসাহী লোকের দল যদি ক্ষেপে যায়, আপনাকে আক্রমণ করে কিংবা গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলে, তাহলে তাদেরও কেউ বাধা দেবে না। আর বর্তমানে স্যোশাল মিডিয়া সম্পূর্ণ ভাবে সরকারী নজরদারির মধ্যে, এর সাথে রয়েছে ফোনকলও। এগুলোতে জাতির পিতা কিংবা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে অশোভন কিছু বললে বা লিখলে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ীই গ্রেফতার হবার সম্ভাবনা প্রবল। এমন ঘটনাও বিরল নয়।

বাকস্বাধীনতা হচ্ছে স্বতন্ত্র্য ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের; নির্ভয়ে, বিনা প্রহরতায় বা কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা, অনুমোদন গ্রহণের বাধ্যতা ব্যতিরেকে নিজেদের মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করার সমর্থিত মুলনীতি। "মত প্রকাশের স্বাধীনতা" শব্দপুঞ্জটিকেও কখনও কখনও বাকস্বাধীনতার স্থলে ব্যবহার করা হয়, তবে এক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতার সাথে মাধ্যম নির্বিশেষে তথ্য বা ধারণার অন্বেষণ, গ্রহণ এবং প্রদান সম্পর্কিত যেকোন কার্যের অধিকারকেও বুঝিয়ে থাকে।

বেসামরিক ও রাজনৈতিক আন্তর্জাতিক চুক্তির (আইসিসিপিয়ার) মানবাধিকার সনদ এর ১৯ নং অনুচ্ছেদ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী অভিব্যক্তির স্বাধীন প্রকাশকে শনাক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে "প্রত্যেকের অধিকার আছে নিজের মতামত এবং অভিব্যক্তি প্রকাশ করার। এই অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে নিজের স্বাধীনচেতায় কোনো বাধা ব্যতীত অটল থাকা; পুরো বিশ্বের যে কোনো মাধ্যম থেকে যে কোনো তথ্য অর্জন করা বা অন্য কোথাও সে তথ্য বা চিন্তা মৌখিক, লিখিত, চিত্রকলা অথবা অন্য কোনো মাধ্যম দ্বারা জ্ঞাপন করার অধিকার"। এই ১৯ নং অনুচ্ছেদ পরবর্তীতে আইসিসিপিয়ার দ্বারা সংশোধিত হয়, উদ্ধৃতিতে বলা হয়; এইসব অধিকারের চর্চা বিশেষায়িত নিয়ম এবং দায়িত্বকে ধারণ করে; তবে যদি এই চর্চার দ্বারা কারো সম্মান হানি হয় বা জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় তবে কিছু ক্ষেত্রে এর অবাধ চর্চা রহিত করা হয়।(১)

এবার তাহলে ‘মৌলিক অধিকার’- সম্পর্কে জানা যাক। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের কিছু অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া থাকে। এ অধিকারগুলো দেশের সংবিধানে বলা থাকে। সংবিধানে উল্লিখিত অধিকারগুলোই একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শর্ত আরোপ করা আছে। বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় পরিচ্ছেদের ২৮ থেকে ৪৪ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারগুলো লিপিবদ্ধ করা আছে এবং সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক মৌলিক অধিকার বলবৎ করার এখতিয়ার সংবিধানের চতুর্থ পরিচ্ছেদের ১০২ অনুচ্ছেদে বিবৃত রয়েছে। অবশ্য কিছু কিছু অধিকার সংবিধানের ১৪১(ক), (খ) ও (গ) অনুচ্ছেদের আওতায় দেশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবনে হুমকির কারণে জরুরি অবস্থায় স্থগিত ঘোষিত হতে পারে।

সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতা কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদটিতে দেখা যায়, কোনো ধরনের বাধানিষেধ ছাড়াই এতে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার উল্লেখ রয়েছে। অপরদিকে বাক্ স্বাধীনতার ক্ষেত্রে দেখা যায় এটি শর্তসাপেক্ষ। আর শর্তগুলো একজন নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করবে যতক্ষণ পর্যন্ত তা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃংখলা, শালীনতা, নৈতিকতা, আদালত অবমাননা, মানহানি, অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা ইত্যাদি বিষয়ে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত যেসব বাধানিষেধ রয়েছে তা অতিক্রম না করে।

প্রসঙ্গত, এ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আইন কি বলে একটু জেনে নেয়া যেতে পারে। ১৯৪৮ সালে মানবাধিকার সনদ এর ১৯নং অনুচ্ছেদ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী অভিব্যক্তির স্বাধীন প্রকাশকে শনাক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে "প্রত্যেকের অধিকার আছে নিজের মতামত এবং অভিব্যক্তি প্রকাশ করার। এই অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে নিজের স্বাধীনচেতায় কোনো বাধা ব্যতীত অটল থাকা; পুরো বিশ্বের যে কোনো মাধ্যম থেকে যে কোনো তথ্য অর্জন করা বা অন্য কোথাও সে তথ্য বা চিন্তা মৌখিক, লিখিত, চিত্রকলা অথবা অন্য কোনো মাধ্যম দ্বারা জ্ঞাপন করার অধিকার"। এই ১৯নং অনুচ্ছেদ পরবর্তীতে বেসামরিক ও রাজনৈতিক আন্তর্জাতিক চুক্তি  দ্বারা সংশোধিত হয়। এতে বলা হয় - এইসব অধিকারের চর্চা বিশেষায়িত নিয়ম এবং দায়িত্বকে ধারণ করে; তবে যদি এই চর্চার দ্বারা কারো সম্মান হানি হয় বা জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় তবে কিছু ক্ষেত্রে এর অবাধ চর্চা রহিত করা হয়।

এবার তাহলে দেখা যাক, সুরক্ষা আইন (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮; যদি সুরক্ষা আইন বলতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-কে বুঝিয়ে থাকেন?) কি বলা আছেঃ

এক) ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জন শৃঙ্খলা ক্ষুণ্ণ করলে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তা ব্লক বা অপসারণের জন্য টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে। এক্ষেত্রে পুলিশ পরোয়ানা বা অনুমোদন ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ এবং গ্রেপ্তার করতে পারবে।  এই আইনে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট যুক্ত করা হয়েছে। ফলে কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করা হয়, বা প্রকাশ করে বা কাউকে করতে সহায়তা করে ওই আইন ভঙ্গ করলে এই আইনে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা হতে পারে, ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

দুই) কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত যদি কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে তা গুপ্তচরবৃত্তি বলে গণ্য হবে এবং এজন্য ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে। আইন অনুযায়ী ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার নামে প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা চালালে বা মদদ দিলে অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।

তিন) ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা, ভীতি প্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ঘৃণা প্রকাশ, অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ বা ব্যবহার করলে জেল জরিমানার বিধান রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে তিন থেকে সাত সাত বছরের কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। দ্বিতীয়বার এরকম অপরাধ করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণা করলে অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড, ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড হতে পারে।

চার) কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের বিষয়েও বিধান রয়েছে এই আইনে। সেখানে ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, কম্পিউটার, কম্পিউটার প্রোগ্রাম. কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা ডিভাইস, ডিজিটাল সিস্টেম বা ডিজিটাল নেটওয়ার্কে প্রবেশাধিকার ব্যাহত করে, এমন ডিজিটাল সন্ত্রাসী কাজের জন্য অপরাধী হবেন এবং এজন্য অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড অথবা এনধিক এক কোটি অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। ছবি বিকৃতি বা অসৎ উদ্দেশ্যে ইচ্ছেকৃতভাবে বা অজ্ঞাতসারে কারো ব্যক্তিগত ছবি তোলা, প্রকাশ করা বা বিকৃত করা বা ধারণ করার মতো অপরাধ করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। ইন্টারনেটে পর্নগ্রাফি ও শিশু পর্নগ্রাফির অপরাধে সাত বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

পাঁচ) কোন ব্যাংক, বীমা বা আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান থেকে কোন ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আইনানুগ কর্তৃত্ব ছাড়া অনলাইন লেনদেন করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। বাংলাদেশ বা বিশ্বের যেকোনো বসে বাংলাদেশের কোন নাগরিক যদি এই আইন লঙ্ঘন করেন, তাহলেই তার বিরুদ্ধে এই আইনে বিচার করা যাবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিচার হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। অভিযোগ গঠনের ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি করতে হবে। তবে এর মধ্যে করা সম্ভব না হলে সর্বোচ্চ ৯০ কার্যদিবস পর্যন্ত বাড়ানো যাবে।

সংবিধানে আরও যেসব মৌলিক অধিকার আছে তা সংক্ষেপে এমন –

এক) আইনের দৃষ্টিতে সমতা এবং আইনের আশ্রয়লাভ: আইনের দৃষ্টিতে প্রত্যেক নাগরিক সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী। রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিকের আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার আছে। কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। বৈষম্য করা যাবে না এবং সমান সুযোগ: ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বাসস্থান বা পেশাগত কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করা যাবে না। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ এবং পদ লাভের ক্ষেত্রে সবার সমান সুযোগ থাকবে এবং বৈষম্য করা যাবে না। জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার: আইন অনুযায়ী ব্যতীত কাউকে জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।

দুই) গ্রেপ্তার ও আটকে রক্ষাকবচ: কোনো কারণে কাউকে আটক করা হলে, সেটির কারণ জানিয়ে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। কোনো অবস্থায় কাউকে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় হাজতে রাখা যাবে না। আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পার্শ্ববর্তী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আটক ব্যক্তিকে হাজির করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। জবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধ: ফৌজদারি অপরাধের সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছাড়া কাউকে জোর-জবরদস্তি করে কোনো কাজ করানো যাবে না।

তিন) বিচার ও দণ্ড: কেউ কোনো অপরাধ করলে তাঁর বিচার অবশ্যই ওই সময়ে প্রচলিত আইনে করতে হবে। এক অপরাধের জন্য একাধিকবার শাস্তি দেওয়া যাবে না। প্রত্যেক নাগরিকের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারের অধিকার রয়েছে। কাউকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না। কোনোভাবেই নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না। চলাফেরার স্বাধীনতা: দেশের যেকোনো স্থানে অবাধ চলাফেরা, যেকোনো স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন এবং দেশত্যাগের পর পুনঃপ্রবেশের স্বাধীনতা রয়েছে নাগরিকদের। তবে এ স্বাধীনতা হবে জনস্বার্থে যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা: যেকোনো সমাবেশ বা সংগঠনের অধিকার দেওয়া হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রেও জনশৃঙ্খলা, জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতার স্বার্থ আইন দ্বারা বাধানিষেধ সাপেক্ষে অধিকার ভোগ করতে পারবে।

চার) পেশা ও ধর্মের স্বাধীনতা: যেকোনো নাগরিক আইন দ্বারা বাধানিষেধ সাপেক্ষে যেকোনো কাজকে নিজের পেশা হিসেবে বাছাই করতে পারবেন। আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা থাকবে। সম্পত্তির অধিকার: আইনের মাধ্যমে আরোপিত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিক সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর করতে পারবেন। গৃহ ও যোগাযোগের অধিকার: রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলার স্বার্থে আইনের মাধ্যমে আরোপিত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের নিজ গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকবে। চিঠিপত্র ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকবে।

এবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ নিয়ে  প্রথম থেকে সর্বস্তরের মহলে তীব্র সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছে। সম্পাদক পরিষদ এ আইনটি প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা আইনের বেশ কয়েকটি ধারা নিয়ে (৮,২১,২৫,২৮,২৯,৩১,৩২ ও ৪৩) আপত্তি জানায়। সাংবাদিক ইউনিয়নও আইনটি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। যদিও আইনমন্ত্রী এ আপত্তিগুলোকে যৌক্তিক বলে জানিয়ে তা সংশোধনের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু সংসদে কন্ঠভোটে পাস করা এ আইনে কার্যত কোনো পরিবর্তনই আসে নি।

তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ অনুযায়ী, দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত তথ্য জানার আইনী অধিকার থাকলেও ডিজিটাল আইন পাসের ফলে এ সুবিধা সর্বোতভাবে রহিত হয়ে যাবে এবং এর ফলে দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন সুরক্ষিত হয়ে এরূপ অপরাধের অধিকতর বিস্তার ঘটবে বলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান অভিমত প্রকাশ করেন। তিনি আরো বলেন, বিতর্কিত ৩২ ধারার ডিজিটাল গুপ্তচর বৃত্তির ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক আমলের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩ অনুসরণের সুপারিশ করার দৃষ্টান্ত অত্যন্ত হতাশা ও দুঃখজনক। এই আইনকে সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী আখ্যা দিয়ে টিআইবি আইনটি পাস না করতে অনুরোধ জানান। ১ ফেব্রুয়ারী ২০১৮ এ আইনের খসড়া মন্ত্রীসভায় উঠার পরপরই আমি গুপ্তচরহ্যাশট্যাগ দিয়ে অসংখ্য সাংবাদিক সামাজিক গণমাধ্যমে প্রতিবাদ করেন।

দশম জাতীয় সংসদের ২২তম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন এই আইনের বিরোধিতা শুধুমাত্র ব্যক্তিস্বার্থেই করা হচ্ছে। তিনি জানান, এই আইনের ফলে সাংবাদিকদের কন্ঠ রোধ হবে না। ২০ সেপ্টেম্বর বিলটি পাসের আগে জনমত যাচাই-বাছাই প্রসঙ্গে ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এই বিলটি পাসের জন্য নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছেন বলে সংসদে বলেন। তার মতে পৃথিবীর বহু দেশ এই আইনটি অনুসরণ করবে।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক এ আইনকে মধ্যযুগে ফিরে যাওয়ার আইন বলে অভিহিত করেন। তার মতে এ আইন বাকস্বাধীনতা বিরোধী। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলে সই না করার জন্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে আহ্বান জানিয়েছে সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। সেই চিঠিতে এই বিলটিকে পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদে ফেরত পাঠানোরও আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি। সংস্থাটির মতে আইনটি বলবত হয়ে গেলে বাংলাদেশের সংবিধানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার যে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে তা বিঘ্নিত হবে।

১০টি পশ্চিমা দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকরা আইনের ২১, ২৫, ২৮ ও ৩২ ধারা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ আইনের কারণে বাক স্বাধীনতা ওপর বিরুপ প্রভাব ও তথ্য জানার অধিকার বিঘ্নিত হবে বলে সুলতানা কামাল অভিমত প্রকাশ করেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে কালো আইন বলে আখ্যায়িত করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। সংবাদ সম্মেলনে এ দলের প্রতিনিধি রিজভী আহমেদ, এ আইনকে বাকস্বাধীনতা বিরোধী বলে আখ্যায়িত করে।(২)

বেসামরিক ও রাজনৈতিক আন্তর্জাতিক চুক্তির (আইসিসিপিয়ার) মানবাধিকার সনদ এর ১৯ নং অনুচ্ছেদ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী অভিব্যক্তির স্বাধীন প্রকাশকে শনাক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে "প্রত্যেকের অধিকার আছে নিজের মতামত এবং অভিব্যক্তি প্রকাশ করার। এই অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে নিজের স্বাধীনচেতায় কোনো বাধা ব্যতীত অটল থাকা; পুরো বিশ্বের যে কোনো মাধ্যম থেকে যে কোনো তথ্য অর্জন করা বা অন্য কোথাও সে তথ্য বা চিন্তা মৌখিক, লিখিত, চিত্রকলা অথবা অন্য কোনো মাধ্যম দ্বারা জ্ঞাপন করার অধিকার"। এই ১৯ নং অনুচ্ছেদ পরবর্তীতে আইসিসিপিয়ার দ্বারা সংশোধিত হয়, উদ্ধৃতিতে বলা হয়; এইসব অধিকারের চর্চা বিশেষায়িত নিয়ম এবং দায়িত্বকে ধারণ করে; তবে যদি এই চর্চার দ্বারা কারো সম্মান হানি হয় বা জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় তবে কিছু ক্ষেত্রে এর অবাধ চর্চা রহিত করা হয়।

বাকস্বাধীনতাকে চূড়ান্ত হিসেবে স্বীকার নাও করা হতে পারে। মর্যাদাহানি, কুৎসা রটানো, পর্নোগ্রাফি, অশ্লীলতা, আক্রমণাত্মক শব্দ এবং মেধাসম্পদ, বাণিজ্যিক গোপনীয়তা, জননিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতা যদি অন্য কারও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে বা কারও অপকার করে তবে অপকার নীতির মাধ্যমে বাকস্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে। এই অপকার নীতির ধারণাটি প্রণয়ন করেছিলেন জন স্টুয়ার্ট মিল তার অন লিবার্টি নামক গ্রন্থে। সেখানে তিনি বলেন, "একটি সভ্য সমাজে কোন ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তার উপর তখনই ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার করা যায়, যখন তা অন্য কোন ব্যক্তির উপর সংঘটিত অপকারকে বাঁধা দেয়ার জন্য করা হয়।"অবমাননা নীতির ধারণাও বাকসীমাবদ্ধতার ন্যায্যতা প্রতিপাদনে ব্যবহৃত হয়, এক্ষেত্রে যেসব কথায় সমাজে অবমাননার সৃষ্টি করে সেগুলোর প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এক্ষেত্রে বক্তব্যের পরিমাণ, সময়, বক্তার উদ্দেশ্য, কতটা সহজে এড়িয়ে যাওয়া যায় - এসব বিবেচনায় আনা হয়। ডিজিটাল যুগের বিবর্তনের সাথে সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার নতুন উপায় আবিষ্কৃত হওয়ায় বাকস্বাধীনতার প্রয়োগ ও এর বিধিনিষেধ ব্যবস্থার বিতর্ক আরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন চীন সরকারের উদ্যোগে নেয়া গোল্ডেন শিল্ড প্রোজেক্টে জননিরাপত্তা মন্ত্রণালয় সাম্ভাব্য অসন্তোষজনক তথ্যকে দেশের বাইরে যেতে বাঁধা দান করে। (৩)

পরিশেষে উল্লেখ্য,সক্রেটিস, দস্তয়ভস্কি, বোবিসপাস্তারনাক, আঁন্দ্রে শাখারভ, হাওয়ার্ড ফাস্ট, চার্লি চ্যাপলিন, নজরুল ইসলাম প্রমুখ ব্যক্তিত্বকে স্বাধীন চিন্তা  মত প্রকাশের জন্য কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। পৃথিবীর কোনো শাসকগোষ্ঠি কিংবা রাজশক্তি বাক ও চিন্তার স্বাধীনতাকে কেড়ে নিয়ে সত্যকে বেশিদিন দাবিয়ে রাখতে পারেনি। এ ব্যাপারে যারা যত বেশি কঠোর হয়েছে তারা তত বেশি জনরোষে পতিত হয়েছে। এমনকি দেখা গেছে অনেক প্রজ্ঞাবান-বিচক্ষণ শাসক দেশের জ্ঞানী-গুণী, শিল্পী, সাহিত্যিক, উকিল, ডাক্তার দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের বিশেষ সমাদর করে তাঁদের একান্ত সান্নিধ্যে এসে চিন্তার ফসলকে কাজে লাগিয়ে জনগণের নিকট অমর হয়ে আছেন। আমরা আশা করি নতুন প্রজন্মের মধ্য থেকেই বাক স্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার আন্দোলনে প্রমিথিউসরা বের হয়ে সমাজ, দেশ ও জাতিকে নিয়ে যাবে আগামীর পথে।

-এ কে এম শিহাব

সূত্রঃ

১।https://bn.wikipedia.org/wiki

২। https://bn.quora.com

৩। https://bn.wikipedia.org/wiki


Share Tweet Send
0 Comments
Loading...
You've successfully subscribed to Bangladesh ASF
Great! Next, complete checkout for full access to Bangladesh ASF
Welcome back! You've successfully signed in
Success! Your account is fully activated, you now have access to all content.