তৃতীয় অধ্যায়ঃ সিন্ডিক্যালিজমের অগ্রদূতগন
প্রাথমিক স্তরের সমাজবাদি ভাবধারায় গড়ে উঠা শ্রমিক আন্দোলনের সাথে আমাদের বর্তমান বিপ্লবী সিন্ডিক্যালিজম আন্দোলনের একটি গভীর যোগসূত্র আছে। এই ভাবধারাটি প্রথমিক ভাবে বিরাট শিল্পের মাতৃভূমি ইংল্যান্ডে সূত্রপাত হয়, এবং পরে ইংলিশ শ্রমিক শ্রেনীর নানা বিভাগের মাঝে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। কম্বিনেশন আইন বাতিলের পর শ্রমিক শ্রেনী বৃহত্তর পরিসরে তাঁদের ট্রেড ইউনিয়ন গুলো শক্তিশালী করার সুযোগ পায়, এত কাল তাঁদের স্থানীয় বা স্ব স্ব কর্ম ক্ষেত্রে কাজ করার যে অভিজ্ঞতা তাঁরা অর্জন করেছে তা এখন বৃহত্তর পরিসরে কাজে লাগাবার সুযোগ পায় । প্রথমিক আন্দোলনের মধ্যে সামাজিক রাজনৈতিক বিষয় গুলো গভীর ভাবে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। তবে সেই সময়ে শ্রমিকগন রাজনৈতিক সংস্কার মুলক কাজের সাথে কিছু কিছু পরিচিত ছিলেন। তবে তাঁদের আর্থ সামাজিক আমূল পরিবর্তনের কোন লক্ষ্য স্থির করা হয়নি। এমন কি ত্রিশের দশকের আগে পর্যন্ত সমাজবাদি ভাবধারা সত্যিকার অর্থে প্রভাবিত করতে পারে নাই । সেই সময় কাল পর্যন্ত ব্যাপক অংশের শ্রমিক জন গুষ্টি রবার্ট ওয়েনের মতবাদেই আস্থাশীল ছিলেন।
পার্লামেন্টে জাতীয় শ্রমিক ইউনিয়ন সংক্রান্ত তথাকথিত সংস্কার আইন পাশের আগে পর্যন্ত, কেবল বস্ত্র শিল্পের শ্রমিকগনের মধ্যে একটি অগ্রসর অংশ বৈপ্লবিক ভাবধারা পোষন করতেন। সেই পরিস্থিতে তাঁরা মাত্র চারটি উল্লেখযোগ্য দাবী মালিক পক্ষের সামনে উত্থাপন করেনঃ
১। একজন শ্রমিককে তার প্রকৃত শ্রমের মূল্যদিতে হবে;
২। শ্রমিকদেরকে সামগ্রীকভাবে তাঁদের কাজের সূরক্ষা দিতে হবে, যেন নিয়োগ কর্তা কোন ভাবেই তাদের সাথে অন্যায় আচরন করতে না পারে;
৩। পার্লামেন্ট সংস্কারের মাধ্যমে সকল নারী পুরুষের কষ্ট লাগবের ব্যবস্থা নিতে হবে; এবং
৪। অর্থনৈতিক সমস্যার উপর শ্রমিকদেরকে শিক্ষা দিতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কারের কথা তুলে ধরে বলা হয়, সকল স্বৈরাচারী ব্যস্থার অবসান ঘটিয়ে সমগ্র দেশকে একেই বিধি বিধানের আওতায় আনতে হবেঃ এই কথার মাধ্যমে এটা প্রকাশ পায় যে শ্রমিক শ্রেনীর লোকেরা তখনো রবার্ট ওয়েনের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আছেন ।
১৮৩২ সালের সংস্কার বিল, ও চলমান রাজনৈতিক ধোঁয়াশা ইংলিশ শ্রমিক শ্রেনীর একটি বিরাট জোটকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছিলো। যখন বিলটি আইনে পরিণত হল তখন দেখা গেল মধ্যবিত্ত শ্রেনী ভূমি মালিকদের উপর বেশ কিছু সবিধা পেলে ও শ্রমিক মজুরদের সাথে আবারো বিশ্বাস ঘাতকতা করা হয়েছে । বুর্জোয়া শ্রেনীর লোকেরা তাদেরকে এক অগ্নি গহব্বরের দিকে টেনে নিয়ে গেছে । ফলে এটা তখন আরো দিবালকের মত স্পষ্ট হলো যে, শ্রমিক শ্রেনী বুর্জোয়া শ্রেনীর জোটের নিকট থেকে কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা নেই । এর আগে স্বতস্ফুর্ত ভাবে শ্রমিক শ্রেনীর আন্দোলন ব্যাপক রূপ ধারন করেছিলো, সেই আন্দোলনে অনেক ধনী গরীব,মালিক শ্রমিক নানা শ্রেনীর মানুষ যুক্ত হয়, কিন্তু এই ঘটনার পর শ্রমিক শ্রেনীর মনে নতুন ভাবনার সৃষ্টি হয়। তাঁরা তখন বুঝে গেল শ্রমিক শ্রেনীর মানুষ ছাড়া তাঁদের স্বার্থ অন্য কেউ দেখবে না । তাঁরা তাঁদের সত্যিকার শক্তি ও দূর্বলতা চিহ্নিত করার প্রায়স চালায়। শ্রমিক শ্রেনীর লোকেরা তখন সংস্কার মূলক আন্দোলনে অংশ গ্রহনের ক্ষেত্রে আরো বেশী সচেতন হয়, নিজেদের অধিকার আদায়ের লড়াই সংগ্রামের ক্ষেত্রে ও আর্থ-সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্বি পায়।
রবার্ট ওয়েনের প্রচারনার উপর তাঁদের বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়, যার সংগঠিত শ্রমিক শ্রেনীর উপর প্রতিনিয়ত প্রভাব বৃদ্বি পেতে থাকে । ওয়েন স্বীকার করেন যে সরল ভাবে যে সকল শ্রমিক সংগঠন গড়ে উঠছে, তাদেরকে অর্থনৈতিক ভিত্তি উপর দাঁড় করতে হবে এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতির মৌলিক নীতিমালা সংশোধনের জন্য জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে । তিনি ব্যাক্তিগত ভাবে এই বিশ্বাসের উপর খুব জোর দিতেন । তিনি দেখান যে, পুঁজি ও শ্রমের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব বিদ্যমান আছে তা কোন সাধারন আন্দোলন সংগ্রাম দিয়ে সমাধান হবে না, তাই তিনি কোন ভাবেই আমূল পরিবর্তনকামী লড়াই সংগ্রামের বিষয়কে কম গুরুত্বদেননি । অন্য দিকে তিনি শ্রমিকদেরকে বলেছেন আইনগত ভাবে খুব বেশী কিছু পাওয়া যাবে এমন আশা করে কোন লাভ নেই । সামগ্রীক মুক্তি তখনই মিলবে যখন শ্রমিক সকল কিছুর দায়িত্ব নিজদের হাতে নিতে পারবেন । এই ধারনাটি ইংরেজ প্রাগ্রসর শ্রমিক শ্রেনীর অনেকেই গ্রহন করেন, আর সেই ধারনাই তাঁদের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ের প্রেরনা যোগায় । নির্মান শ্রমিকদের ইউনিয়ন স্থানীয় ভাবে ও কম শক্তিশালী ছিলো না, তাঁদের সংগঠন সমূহ ও কোন ভাবেই পিছিয়ে থাকেনি। তাঁদের শক্তি সামর্থ নিয়োগ কর্তাদের কাঁপিয়ে দেবার মত অবস্থায় ছিলো। ১৮৩১ সালে ওয়েন ম্যানচেস্টারের এক সভায় উপস্থিত সদস্যদের সামনে একটি সমাজ পূর্গঠন মূলক পরিকল্পনা পেশ করেন। সেই পরিকল্পনায় তিনি সমাজবাদি কাউন্সিলের প্রস্তাব করেন, যেখানে তিনি উৎপাদক শ্রেনীর সমবায় সমিতি গঠনের প্রাস্তাব করেন যা নিয়ন্ত্রিত হবে ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে । তার সেই প্রস্তাব সভায় গৃহিত হয়, এবং নির্মান শ্রমিকগন কিছু দিনের মধ্যেই মালিক পক্ষের সাথে দির্ঘ সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে, সেই সময়ের অসন্তোষ এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যে শ্রমিকদের সংগঠন হুমকির মুখে চলে যায় এবং ফলে ওয়েন বাধ্য হয়ে আন্দোলনের রাশ টেনে ধরেন। ফলে পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠে।
রবার্ট ওয়েন এই পরিস্তিতিতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন নাই, কিন্তু তিনি নিজের হতাশা কাটিয়ে নয়া উদ্যমে পুনরায় কাজ চালিয়ে যান। ১৮৩৩ সালে লন্ডনে তিনি এক সম্মেলনের ডাকদেন, এতে ট্রেড ইউনিয়ন ও সমাবায় সমিতি সমূহকে যোগদানের আহবান জানান। সেই সম্মেলনে তিনি তার নয়া পরিকল্পনা সকলের সামনে উপস্থাপন করে যেখানে ছিলো সামাজিক সংস্কারের বা পুনর্গঠনের নয়া নক্সা । সেই সম্মেলনের প্রতিনিধিদের প্রতিবেদন সমূহ পাঠ করলে সহজেই একজন লোক বুঝতে পারবেন যে, ইংরেজ অগ্রসর শ্রমিকদের উপর ওয়েনের চিন্তার প্রভাব কত তিব্রতর ছিলো । দি ফোর ম্যানস গার্ডিয়ান পত্রিকা সংক্ষিপ্ত আকারে সম্মেলনের প্রতিবেদন গুলো তুলে ধরেন এই ভাবেঃ
“ সাবেক কম্বিনেশন আইনের সাথে এই সম্মেলনের প্রতিনিধিদের বক্তব্যে উঠে আসা উদ্দেশ্য সমূহের লক্ষ্যের কিছু পার্থক্য স্পস্টভাবে দেখা যাচ্ছে। তাদের প্রতিবেদন সমূহ সামগ্রীক সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের কথা বলছে – তাঁরা বিশ্বব্যাপী প্রচলিত বিশ্ব ব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবী করছে- আর তা করতে হবে শ্রমিক শ্রেনীকেই । তাঁরা সমাজের উঁচু তলার মানুষের জন্য তা করবেন না, করা হবে নিচু তলার সাধারন মানুষের জন্য – বা উঁচু নিচু নয় সকলের জন্য সামাজিক পরিবর্তন করতে হবে”।
এই সম্মেলনের ফলে ১৮৩৪ সালের প্রারম্ভেই গ্র্যান্ড ন্যাশনাল কনসোলিডেটেড ট্রেড ইউনিয়ন অব গ্রেট ব্রিটেন এন্ড আইয়ারলয়ান্ড গঠিত হয়। সেটা ছিলো উৎসাহ ও উদ্দীপনার সময়। সেই সময় সমগ্র দেশ অসংখ্য ধর্মঘট, লক আউট ও হরতালে ছিলো উত্থাল। এবং বিপুল পরিমাণ শ্রমিক সেই সময়ে ইউনিয়নের সদস্য পদ গ্রহন করতে এগিয়ে আসেন, অল্প কিছু দিনের মধ্যেই প্রায় ৮০০,০০০ শ্রমিক সদস্য ভূক্ত হন। জি,এন,সি প্রতিস্টার পর পর ই তাঁরা উদ্যোগী হয়ে ছোট বড় নানা স্থানে গঠিত সংগঠন সমূহকে নিয়ে একটি ফেডারেশন গঠন করেন। যা শ্রমিক শ্রেনীর শক্তি সামর্থ বাড়িয়ে দেয় ফলে তাঁরা যে কোন কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়ে উঠেন । কিন্তু তাঁদের এই বিশাল সংগঠন সত্যিকার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন নাই, এমন কি শ্রমিকদের সত্যিকার সংহতি, ইউনিয়নিজম, বা পারস্পরিক সহযোগীতার ক্ষেত্র ও প্রস্তুত করতে, এবং রাজনৈতিক সংস্কার মূলক কিছুই করতে পারে নাই । দি জি, এন, সি স্ব স্ব দেশে শ্রমিকদের জীবন যাত্রার মান বাড়ানোর জন্য নিজেকে একটি লড়াকু সংগঠন হিসাবে গড়ে তুল, সাথে এই কথা ও ঘোষনা করে যে তাঁরা পুঁজিবাদের শিকর উপড়ে ফেলতে চায়, আর সেই খানে তাঁরা উৎপাদক শ্রমিকদের সমবায় ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে চায়, যেখানে কোন ব্যাক্তি নিজের জন্য কোন মুনাফা করার সুযোগ পাবেন না, উৎপাদন হবে সকলের চাহিদা পুরনের জন্য । জি এন সি সেই সময় ঘোষণা দেয় তাঁরা তাঁদের লক্ষ্য বাসতবায়নের জন্য যা যা করনীয় তা করতে কিছুতেই পিছপা হবেন না ।
ফেডারেশন গড়ে তুলার উদ্যোক্তাগন চাইছিলেন শিল্পকারখানা, কৃষি উৎপাদনকারী প্রতিস্টান সমূহকে একটি ছাতার আওতায় এনে প্রতিটি উৎপাদন সংক্রান্ত বিশেষ বিভাগ খোলে সামগ্রীক উৎপাদন ও বন্ঠন প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করবেন । প্রতিটি শিল্প কারখানা বিশেষ বিভাগের আওতায় তাঁদের উৎপাদন কাজ চালিয়ে যাবে। এবং যেখানে যেখানে সম্ভব সেখান থেকে শ্রমিকগনকে নিয়ে এসে সমবায় সমিতিটি পরিচালনা করবে, যারা পরিচালনাগত খরচ সহ প্রকৃত উৎপাদন খরচ অনুসারে পন্য সমূহ ভোক্তাদের নিকট বিক্রি করবেন। সার্বজনীন সংগঠন সমূহ কোন একটি শিল্প কারখানার সাথে যুক্ত হবে এবং তাঁদের কার্যক্রম সকলের স্বার্থে পরিচালিত হবে । পন্য বিনিময় করার ক্ষেত্রে তথাকথিত শ্রমবাজার হয়ত কিছু সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে –সেই ক্ষেত্রে বিশেষ অর্থ বা শ্রম টিকেটের ব্যবস্থা থাকতে পারে। স্থির প্রতিস্টানিক সম্প্রসারনের জন্য তাঁদের মধ্যে আশঙ্কা ছিলো যে, সেই ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের সাথে প্রতিযোগীতায় সামাজিক পুনগঠনের দরকার হতে পারে ।
সাথে সাথে তাঁরা এই কথা ও বুঝতে পারছিলেন যে, কৃষি খামার ও শিল্প কারখানায় শ্রমিকগন সহজেই দৈনিন্দিন লড়াইয়ে পুজিবাদকে পরাস্ত করে দিতে পারবেন। এই বিষয়ে তাঁরা তাঁদের সাত দফার মধ্যে তিন দফাতেই বক্তব্য রেখেছেন। জি এন সি তার জন্ম লগ্নেই এই বিষয়ে বক্তব্য জনতার সামনে হাজির করেছিলোঃ
“ জমিই হলো জীবন প্রবাহ ঠিকিয়ে রাখার প্রথমিক ও প্রধান সহায়ক উৎস, সুতরাং এর মালিকানা অর্জন করা ছাড়া, উৎপাদক শ্রেনীর লোকেরা পুঁজিবাদী শ্রেনীর সাথে প্রতিযোগীতায় ঠিকতে পারবে না, ব্যবসা বানিজ্যে সকল সময়েই উঠা নামা আছে, তাই কমিটি এই প্রস্তাব করছে যে জমি লিজ নিয়ে ইউনিয়নের কার্যক্রমের ভিত্তিকে মজবুত করতে হবে, সেই জন্য কর্মে নিয়োগকৃত একটি অংশ সকল সময়েই উৎপাদনে জড়িত থাকতে হবে, যদি তা না করা হয় তবে কৃষি ক্ষেত্রে যেমন ভূমি লিজের শর্ত ভঙ্গ হবে অন্য দিকে পন্যের দাম বেড়ে যেতে পারে, কেন না উৎপাদন, সরবরাহ এবং ভোগের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতেই হবে”।
“ কমিটি অত্যন্ত দৃঢ় চিত্যে ঘোষনা করছে যে, দাবী দাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে প্রচলিত ব্যবস্থার আওতায় ধর্মঘট করতে হবে, লোকেরা কাজ করছে, উৎপাদন করছে, পন্য তৈরি করছে সকলের জন্য, তাঁদের জন্য তৈরি করেছে একটি জোট তা হল ইউনিয়নঃ তাঁরা তাঁদের ভাই বোনদের জন্য আন্ত্রিক ভাবে পন্য তৈরি করছে। তাঁরা যদি সমস্যায় পড়েন, কর্ম ক্ষেত্রে, বিক্রয় কেন্দ্রে যদি অব্যবস্থাপনার শিকার হন তবে অবশ্যই তাঁদের ও উৎপাদনে বাঁধা দেবার, সরবরাহে সমস্যা সৃষ্টি করার অধিকার আছে । উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাস্তব সম্মত ও ব্যাপক আকারে বিকেন্দ্রীকরনের ও কাঁচামাল এবং পন্য দ্রব্য সরবরাহের ব্যবস্থা করবে।
“ যখন যেখানে সম্ভব , প্রতিটি জেলায় এক এক টি করে সংরক্ষনকারী গুদাম ঘর নির্মান করা হবে, গৃহস্থালী পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য সেই গুদামে মালামাল সংরক্ষিত থাকবেঃ আর সেখান থেকেই উৎপাদন খরচের উপর ভিত্তিকরে মালামাল বিক্রি করা হবে”।
জি এন সি ও তার প্রতিস্টাতাগন ট্রেড ইউনিয়ন এবং সমবায় বলতে সকলের জন্য কল্যাণ বুঝতেন। বাস্তবে সমাবায় ও ট্রেড ইউনিয়ন পরিচালনায় অংশগ্রহন করে শ্রমিক শ্রেনীর লোকেরা জ্ঞান অর্জন করবে কেমন করে শিল্প কলকারখানা পরিচালনা করতে হবে, উৎপাদন ব্যবস্থা যঝন তাঁদের নিয়ন্ত্রনে আসবে তখন কেমন করে পরিচালনা করতে হবে তা শিখবে এবং সত্যিকার শোষন প্রক্রিয়া গুলো সম্পর্কে হাতে কলমে শিখে ও বুঝে নিবেন উৎপাদক শ্রমিক শ্রেনী। এই ধারনা গুলো শ্রমিক সভা সমাবেশে ও প্রেসের সামনে দৃঢ় ভাবে তুলে ধরা হবে । উদাহরন হিসাবে বলা যায় যে, দি পায়নিয়ার হিসাবে জি এন সি পরিচালিত জেমস মরিসনের পুনঃ পুনঃ বক্তব্য উপস্থাপন ও প্রতিউত্তর বাস্তব আধুনিক জ্ঞানকে সমৃদ্ব করেছে। রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য এই ধরনের আলোচনা খুবই কার্যকরী ও প্রয়োজনীয় বিষয়। বিরুধী পক্ষের বক্তব্য ছিলো অর্থনৈতিক পরিবর্তনে শ্রমিক শ্রেনীর কোন ভূমিকা নেই, এতে তাঁদের কোন স্বার্থ ও নেই- সমাজবাদের সূত্র উল্লেখ করে তাঁরা হাউজ অব কমন্সে এই ধরনের বক্তব্যই দিচ্ছিলো । এই ধরনের হাউজের পরিবর্তে ফেডারেশন গড়ে তুলা হবে, এই গুলো জনসাধারনের স্বার্থকে ধারন করেনা , এঁরা হাজারো সমস্যার জন্মদাতা । এঁরা যেমন উৎপাদনের শত্রু এঁরা ভোগের ও শত্রু । এই সংগঠন সমূহ বর্তমান প্রচলিত ব্যবসা বানিজ্যে হাল ধরবে; আর অন্যান্য সকল সাধারন সম্পত্তির অধিকার নিজেদের হাতে নিয়ে নিবে । তখন কোন রাজনৈতিক দল বা রাষ্ট্রের দরকারই হবে না । জাতীয় সম্পদ তখন আর পরিমাণ দিয়ে নির্ধারন করা হবে না । বরং মানুষ কত টুকু সন্তুষ্ট আছে তা দিয়ে নির্ধারিত হবে । এখন যে হাউস অব কমন্স আছে তা হাউজ অব ট্রেড হিসাবে গন্য হবে।
জি এন সি গঠিত হবার পরই ব্যাপক সারা পায় শ্রমিক শ্রেনীর পক্ষ থেকে। কয়েক মাসের মধ্যেই প্রায় অর্ধ মিলিয়ন মানুষ এর সদস্য হিসাবে নাম লিখায়, যদি এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য প্রাথমিক ভাবে শ্রমিক ও বুদ্বিজীবী মহলের অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন, তবে তাঁরা এর বাহিরে থাকতে পারছিলেন না, কম পক্ষে সকলের এর উত্থাপিত দাবী ও বক্তব্যের সাথে ঐক্যমত পোষণ করে চলছিলেন। দশ ঘন্টার হরতাল পালনে তাঁদের শক্তি পরিক্ষা হয় এবং সকল শ্রমিকের মধ্যে এর সারা জাগে। জিএন সি তাঁদের দাবী আদায়ের জন্য সর্ব শক্তি নিয়োগ করে মাঠে নামে । ওয়েন নিজে এবং তার গনিস্ট বন্দ্বু ডরতি, ফিল্ডেন ও গ্রান্ট আন্দোলনের পুরোভাগে থেকে নেতৃত্ব প্রদান করেন। তবে জি এন সি র কার্যক্রমে যে জংগীপনা দেখা গেল তা দেখে পার্লামেন্ট সদস্যরা ও কিছু নমনিয় হয়ে পড়েন। তবে তাঁরা শ্রমিক শ্রেনীর লোকদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করে, তাঁরা বলেন, এই দশ ঘন্টার হরতাল সামগ্রীক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর প্রভাব ফেলবে। “ তাঁরা বলেন, পুর্নবয়স্ক লোকদেরকে নিয়ে ইউনিয়ন গঠিত হবে এই মর্মে স্বল্প সময়ের মধ্যেই বিল পাশ করা হবে”। এটাই পরে স্লোগানে পরিণত হয়।
ধর্মঘটের ধারনাটি নানা ভাবে বিভক্ত শ্রমিকদেরকে এক ছাতার নিচে ঐক্যবদ্ব করে, তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক দৃঢ় হয়। ১৮৩২ সালে, ইউলিয়াম বেনবো, সেই নয়া আন্দোলনের একজন অত্যন্ত সফল প্রচারক একজন ব্যাক্তি, তিনি একটি চমৎকার পুস্তিকা প্রকাশ করেন, যার শিরোনাম ছিলো গ্যান্ড ন্যাশনাল হলিডে এবং কংগ্রেস অব দি প্রোডাক্টিভ ক্লাসেস, পুস্তিকাটি ব্যাপক ভাবে প্রচার ও করা হয়।সাধারন ধর্মঘটের ধারনার উদ্ভাবন ও চর্চা শ্রমিক শ্রেনীর গুরুত্ব সর্বমহলে নাড়া দেয়। বেনবো বলেন, যদি শ্রমিকদেরকে শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য করা হয় তবে তা হবে দাসত্বের নামান্তর, তাই তাঁদের নিজেদেরকে সংগঠিত করে নিজেদের স্বাধীকার নষ্ট এমন কোন কাজে জড়িত হওয়া যাবে না । এই ধরনের লড়াইয়ের অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে শারিরীক শক্তির দরকার হয় না, অনেক ক্ষেত্রে কোন কাজ না করে ও উন্নত সৈনিকের লড়াইয়ের চেয়ে ও বেশী উপকার পাওয়া যায় । প্রচলিত ব্যবস্থার পতন ঘটাতে, শ্রমিকদেরকে সংগঠিত করতে, এই পদ্বতি একটি বুদ্বিবৃত্তিক পথ ও পন্থা । বেনবো আরো অগ্রসর প্রস্তাব পেশ করেন, এই ধরনের ধর্মঘট জাতীয় কর্মসূচী পালনের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে সমগ্রদেশে পরিকল্পনা করতে হবে । যা সকল দেশকে অচল করে দেয়া যায়, এই কর্ম সূচী পালিত হবে শ্রমজীবী কর্মজীবী মানুষের হ্রদয় থেকে উৎসারিত হয়ে, তা কোন ভাবেই চাপিয়ে দেয়া হবে না ।
জি এন সি এর দ্রুত সম্প্রসারন এবং এর চেতনা শ্রমজীবী মানুষের মাঝে যুগ যুগ ধরে চলে আসা মালিক ও নিয়োগকারীদের প্রতি ঘৃনা ও ভীতি দূরীভূত হতে লাগল । তাঁরা অনুভব করলেন তাঁদের আন্দোলনকে আরো আগ্রসর করে সকল স্থানে প্রতিস্টা করতে হবে, বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠন কায়েম করে এগিয়ে যেতে হবে । এই অবস্থা অবলোকন করে সমস্ত বুর্জোয়া গণমাধ্যম জি এন সি র কার্যক্রমকে একটি “অপরাধ মূলক” কাজ বলে প্রচার করতে শুরু করে, তাঁরা বলতে থাকে এই কার্যক্রমের ফলে সমস্ত দেশে উৎপাদন মারত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে, উৎপাদনে বিপর্যয় নেমে আসবে। তাই সকল শিল্প কারখানার মালিকেরা পার্লামেন্টের নিকট এই মর্মে লিখিত দাবী করল যে, তাঁরা যেন শ্রমিকদের এই ধরনের কাজের বিরুদ্বে আইন প্রনয়ন করে, শ্রমিকদের চলমান কার্যক্রমকে বেয়াইনী ঘোষণা করে দেয়। অনেক কারখানার মালিক শ্রমিকদেরকে ব্যাক্তিগত ভাবে ডেকে নিয়ে তাদেরকে ইউনিয়নের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে বলে, নইলে তাদেরকে চাকুরীচ্যুত করা সহ কারখানা বন্দ্বকরে তাদেরকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলার হুমকী দমকী দিতে থাকে ।
পার্লামেন্ট তখন কিন্তু মালিক পক্ষের কথা শোনে নাই, তাঁরা সমন্বয় আইন পুনস্থাপনের জোরদেয়, কিন্তু সরকার বিচারকদের কে শ্রমিকদের বিরুদ্বে আইনের আওতায় সকল প্রকার কঠোর শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দেয়। বিচার বিভাগ সেই রকম ব্যবস্থা নিতে থাকে, তাই অনেক শ্রমিককে আত্মগোপন করে কাজ চালাতে হয়। কিন্ত সেই সমন্নয় আইনের আওতায় বহু শ্রমিককে গ্রেফতার করে বিচারে সম্মোখিন করা হয় । আইনের শাসনের নামে হাজার হাজার শ্রমিককে ছোট ছোট অপরাধের জন্য ভয়ঙ্কর শাস্তির কথা ঘোষনা করে আদালত সমূহ। নিরিহ শ্রমিকদেরকে সন্ত্রাসী বানিয়ে তাঁদের উপর অসংখ্য কল্পকাহিনী তৈরী করে শাস্তি দিয়ে মালিক ও সরকার পক্ষ তাঁদের মনের জ্বাল মিটাতে থাকে। জে এন সি র গৃহিত উদ্যোগে অনুপ্রানীত হয়ে ডোরচেস্টার গ্রামের একজন মাঠ পর্যায়ের শ্রমিক একটি সংগঠন করেন তার নাম টুলপডলে। তিনি তাঁদের সাথীদের নিয়ে সাপ্তাহে তাঁদের বেতন সাত সিলিং থেকে বাড়িয়ে আট সিলিং মজুরী বৃদ্বি করার জন্য দাবী করে। দাবী উত্থাপন কারীদেরকে তাৎক্ষনিক ভাবে গ্রেফতার করে ভয়ঙ্কর শাস্তি দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার কোলোনীতে সাত বছরের জন্য নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তাঁদের একমাত্র অপরাধ হলো তাঁরা ইউনিয়নের সদস্য।
জি এন সি প্রথম থেকেই দির্ঘকাল মজুরী বৃদ্বির লড়াই সংগ্রাম চালিয়েছে, এবং ক্রমাগত ভাবে নানা প্রকার বিচার আচারের সম্মোখিন হয়েছে। এই ভাবেই তারা নানা প্রকার চড়াই উৎরাই পার হবার মধ্য দিয়ে জনগণকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলার চেষ্টা করেছে। হয়ত এমন অনেক কাজ করতে হয়েছে যা সেই সময়ের জন্য উপযুক্ত ছিলো না । কোন কোন শ্রমিক সচেতন ভাবেই এসেছে, কেহ কেহ তার তাৎক্ষনিক চাহিদা মেটাতে এসেছে, এঁদের অনেকে ধর্মঘটের পক্ষে খোলাখোলী ভাবে প্রচারনায় অংশ নিয়েছেন । ফলে ১৮৪২ সালে ল্যাংকশায়ার, ইয়র্কশায়ার, স্টেফোর্ডশায়ার, পার্থ এবং স্কটল্যান্ড জেলার ওয়েলসের কয়লা খনিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সত্যিকার আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্থ হয়, কেন না সেই সময়ে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক ওয়েনের প্রভাবে চার্টিস্টবাদের দিকে ঝুকে পড়ে, কারন তাঁদের মধ্যে সত্যিকার অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে জ্ঞান ছিলো না । তাঁরা আমূল পরিবর্তনের পরিবর্তে সংস্কারের দিকে বেশী মননিবেশ করে। ১৮৪৮-৪৯ সালের অস্থির বিপ্লব চার্টিস্ট আন্দোলনে রূপ নেয়। এবং মাঠ পর্যায়ে ইউনিয়নিজম ইংলিশ শ্রমিক আন্দোলনের কবলে চলে যায়, ছিলো সত্যিকে মুক্তিপরায়নতার বিপরীত ধারা ।
ফ্রান্সে সমাজবাদিদের সাথে শ্রমিক আন্দোলনের একটা জোটবদ্বতা ছিলো, তাঁদের একটা লক্ষ্য স্থির ছিলো যে অবশ্যই পুঁজিবাদকে বিতাড়িত করতে হবে, গড়ে তুলতে হবে একটি নয়া সমাজ ব্যবস্থা । শ্রমিকশ্রেনী ও বুর্জোয়াদের মধ্যে একটি প্রচণ্ড বিরুধ বিদ্যমান, তাই তাঁরা চাইছিল একটি বিপ্লবের মাধ্যমের এর ফয়সালা করতে। বিপ্লবের পূর্বে তথাকথিত কম্পাগঞ্জোনাগেজ এর প্রচারনায় ঐক্যবদ্ব হয়, যাদের সম্পর্কে পনর শত শতকের দিকে কিছু তথ্য জানা যায় । এটা ছিলো অনেকটা দিনমজুর ও কুটির শিল্পীদের একটি সংস্থা বা সমিতি। তাঁরা সেই সমিতি গড়ে তুলেন নিজেদের দাবী দাওয়া আদায় ও সমসাময়িক সমস্যা সমূহের চাহিদা পুরনের জন্য, তাঁরা হরতাল ধর্মঘট করত তাৎক্ষনিক আর্থিক ইস্যুতে। জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ, বড় শিল্পের বিকাশের জন্য তাঁদের তেমন আগ্রহ ছিলো না, অনেক ক্ষেত্রে সেই সময়ে তাঁদের আর্থিক ও সামাজিক গুরুত্ব কমে যাচ্ছিলো । তখন নয়া ধরনের প্রলেতারিয়েতের উত্থান পর্ব চলছিলো ফ্রান্সে।
১৭৯০ সালের, ২১শে আগস্টে পাশ করা আইন জন সাধারন প্রচলিত আইনের মত করেই মেনে নিয়েছিলো, সেই আইনের আওতায় শ্রমিক শ্রেনীর মানুষেরা ও নিয়োগ কর্তাদের নিকট থেকে নিজেদের স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখতে পারবেন বলে মনে করতেন। তবে সেই সময়ে অনেক স্থানীয় ধর্মঘট হয়, বিশেষ করে বিল্ডিং শিল্পের মধ্যে। নিয়োগ কর্তাগন অনেক ক্ষেত্রে চিন্তিত হয়ে পড়েন, চারিদিকে তখন শ্রমিক সংগঠন গড়ে উঠে, কেবল প্যারিসেই ৮০,০০০ শ্রমিক সদস্য সমিতি ভুক্ত হন ।
সরকার একটি পরিপত্রের মাধ্যমে নিয়োগ কর্তাদের নিপীড়ন মূলক কাজের নিন্দা করে, নিয়োগ কৃত শ্রমিকদের জন্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলে, এবং নিয়োগকর্তা ও শ্রমিকদের মধ্য মুক্ত স্বাধীন চুক্তি করার পরামর্শ প্রদান করে। সরকার অত্যন্ত সদয়ভাবে পরিস্থিতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে, এবং শ্রমিকদের জন্য কর্মের একটি সন্দর পরিবেশ বজায় রাখার আহবান জানায়, যেকোন ধরনের ক্ষতিকর কর্মকে নিষিদ্ব করে দেয়, কারন সরকারের দৃষ্টি এই ধরনে অবস্থা চলতে দেয়ার অর্থ হলো একটি সরকারের ভেতর আরো একটি সরকাকে চলতে দেয়া । ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত এই ধরনের সরকারী আদেশ চালু ছিলো। সেই সময় অনুভূত হচ্ছিলো যে পরিস্থিতি যেন আইনের চেয়ে ও অধিকতর শক্তি শালী। ইংরেজ শ্রমিকদের মত ফ্রান্সের শ্রমিকদের মাঝে ও গোপন সংগঠন গড়ে উঠে, কেননা তখন প্রচলিত আইন শ্রমিকদের দাবী দাওয়া সমূহ প্রকাশ্যে আমলে নেবার মত অবস্থা ছিলো না । বরং প্রকাশ্যেই শ্রমিকদের দাবীকে অবজ্ঞা করে অস্বীকার করত।
তথাকথিত মিউচুয়ালিটি ছিলো একটি অনাকাঙ্ক্ষিত সামাজিক মিউচুয়ালিটি, যা প্রায়স প্রকাশ্য কাজ করে যেত, এটা সামাজিক ভাবে একটি আইনী বাতাবরন প্রদান করত, এবং গোপন শ্রমিকদের প্রতিরোধ সংগঠন সমূহের বৈধতা দান করত। এটা সত্য যে তাঁরা ছিলো, নানা ভাবে মামলা মোকদ্দমা মোকাবিলা করত, এবং বিভিন্ন ভাবে ত্যাগ ও স্বীকার করতে হত, তবে কোন আইনই তাদেরকে নির্মূল করে দেবার মত শক্তি ছিলো না । তাঁদের প্রতিরোধ অব্যাহত ছিলো। লুই ফিলিফের অধীনে শ্রমিকদের আইন আরো শক্ত ও কঠিন হয়ে উঠে, কিন্তু প্রতিরোধ সংঠনের কার্যক্রম থামে নাই বরং দিনে দিনে বাড়তেই থাকে, এমনকি গোপনে বড় ধরনের ধর্মঘট পালনের মত কার্যক্রম ব্যাপক ভেবে এগিয়ে চলছিলো। লিয়নসের যুদ্বের মত একটি গুরুত্বপূর্ন ঘটনা ১৮৩১ সালে ইউরূপে ব্যাপক নাড়া দেয়। শ্রমজীবী শ্রমিক শ্রেনীর লোকেরা নিয়োগ কর্তাদের নিপীড়ন থেকে বেপরোয়া ভাবে বেড়িয়ে আসে। সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর লোকেরা বাঁধা প্রদান করলে ও সেই দ্রুহকে থামানো যায়নি । শ্রমিকগন সাহসের সাথে অত্যন্ত দৃড়ভাবে নিজেদের ব্যানার বহন করে দ্রুত এগিয়ে যায়, তাতে লিখা হয়ঃ “লড়াই করে মর বা কাজ করে বাঁচ!”
ত্রিশের দশকের প্রথম দিকে বেশ কিছু শ্রমিক সংগঠন সমাজবাদি ধারনার সাথে পরিচিত হয়, ১৮৪৮ সালে ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের পর ফ্রান্সের শ্রমিক সমিতি সমবায় আন্দোলনের সাথে ট্রেড ইউনিয়ন ও সামাজিক পুর্গঠনের জন্য প্রচেষ্টা চালায়। এস ইংল্যান্ডার আন্দোলনের ইতিহাসে এই সমিতির আন্দোলনকে দুইহাজার নামে অবিহিত করে। তবে, লুই বোনাপার্টের অভ্যুত্থান অনেক ভালো কাজ বাঁধগ্রস্থ করার মত এই আশা আকাংখাকে ও মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে ফেলে ।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক সমিতি গঠনের পর থেকে গঠন মূলক ও বিপ্লবী সমাজবাদের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়, এবং সেই চেতনা দুনিয়ার সকল স্থানে ছড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা জোরদার হয় । আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সেই আন্দোলনের প্রভাব শ্রমিকদের বুদ্বিবৃত্তিক বিকাশকে শক্তিশালী করে, যার চম্বুক শক্তি এখনো ল্যাতিন আমেরিকায় বিদ্যমান আছে, ১৮৬৪ সালে সেই আন্দোলনের দানা বেঁধে ছিলো ইংরেজ ও ফরাসী শ্রমিকদের যৌথ প্রচেস্টায়। আর সেটাই ছিলো আন্তর্জাতিক শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ব করা প্রথম উদ্যোগ, যা শ্রমিক শ্রেনীর মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির পথকে প্রসস্ত করে দেয়। এটাই ছিলো বুর্জোয়া সংগঠন ও পার্টির বাহিরে শ্রমজীবী মানুষের নিজস্ব মুক্তির প্রচেষ্টা, কারখানার কাঁচা মাল ও যন্ত্র হিসাবে যে শ্রমিককে ব্যবহার করা হত যা ছিলো তাঁদের জন্য দাসত্বের বড় কারন, সেই সময়ে বুদ্বিজীবীদের অধপতন হয়, ও রাজনৈতিক নিপীড়নের তিব্রতা বৃদ্বি পায়। সেই কারনেই এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির কথা রাজনীতিতে প্রধান হয়ে উঠে ।
যেহেতু খুবই গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয় বস্তুকে কেন্দ্র করে ইউরূপের নানা ধরনের সামাজিক আন্দোলন সংগ্রাম গুলোকে একত্রিত করতে উদ্যোগ নেয়া হলো, বিপুল সংখ্যক শ্রমিকদেরকে ঐক্যবদ্ব করতে সংগঠনের কাঠামো ফেডারেটিভ আকারে তৈরী করা হয়, প্রতিটি দল ও গ্রুপের স্ব স্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও আলাদা আলাদা নীতির চর্চা ছিলো কিন্তু সকলকে একত্রিত করার জন্য কিছু সাধারন নীতি প্রনয়ন করা হয়। স্ব স্ব দেশের অঞ্চলের ধ্যান ধারনার সাথে সংগতি রেখে কার্যক্রম গ্রহনের প্রতি গুরুত্বারূপ করা হয়। আন্তর্জাতিক কোন একটি নির্দিস্ট সংজ্ঞার আওতায় দাড়ায়নি; বরং এটা এমন একটি আন্দোলনে পরিণত হয় যা কেবল তাত্ত্বিক বিষয় নয় এটা একটি ব্যবহারিক বিষয় হিসাবে মানুষের দৈনিন্দিন জীবনের সাথে একাকার হয়ে যায় । এই আন্দোলন অত্যন্ত দ্রুত সম্প্রসারিত হতে থাকে। এটার কাজ ছিলো দুনিয়ার সকল শ্রমিকদেরকে পরস্পরের নিকটবর্তী করার ব্যবস্থা করা, তাদেরকে পরস্পরের মধ্যে বুঝাপড়া ও একেই পথে হাটার জন্য প্রস্তুত করার উদ্যোগ নেয়া হয়, কেননা এটাই যে শ্রম জীবী কর্মজীবী মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্তির পথ । সারা দুনিয়ার শ্রমজীবীরা তো একেই ব্যবস্থার শিকার । এই পরিস্থতে তাঁদের মধ্য ঐক্য সংহতি জোরদার করে দেশীয় সিমান্ত অতিক্রম করে নিজেদের ঐক্য গড়ার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য কাজ করা হয়, এর পিছনে কোন জাতীয় স্বার্থ কাজ করবে না, তবে তা তাঁদের শ্রেনীর জন্য বিশাল ভূমিকা রাখবে।
শিল্প লড়াইয়ের জন্য শ্রমিকদের ঐক্য ও সংহতি জোরদার করার জন্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শ্রমিক শ্রেনীকে প্রতিবাদি করে আমদানী রপ্তানীর ক্ষেত্রে ধর্মঘট ও হরতাল পালনের মত কার্যক্রম গ্রহন করে সরকার ও শিল্প মালিকদেরকে চাপে ফেলতেই হবে, এই প্রক্রিয়া সকল লভিস্ট ও দালাল চক্রকে হার মানাতে সহায়তা করবে । শ্রমিকদেরকে সামাজিক দর্শনের প্রায়োগিক দিক গুলো শিক্ষা দিতে হবে। এটা সত্য যে, আন্তর্জাতিক পরিসরে ধর্মঘট পালন করা একটি বিরাট শক্তিশালী ও শানিত অস্ত্র। একটি দাঁড়ালো তলোয়ার যা শ্রমিক দুষমন দমনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে । এটা জাতীয় সহানুভূতি বৃদ্বি, একাত্মত্বতা প্রাকাশ ও ঐক্য দিনে দিনে বৃদ্বি করবে ।
এই আন্তর্জাতিক মহান উদ্যোগ সমূহ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সমূহের সাথে একাত্ম হয়, পরে তা পুঁজিবাদের মুখোমুখি হয় এবং দুনিয়ার নানা দেশের শ্রমজীবী মানুষের সাথে নিজেরকে সম্পৃক্ত করে রাখে। প্রথম দুটি আন্তর্জাতিক, ১৮৬৬ সালে জেনেভায়, এবং ১৮৬৭ সালে লাউসানে অনুষ্ঠিত হয়, সেই সম্মেলন গুলোতে সংযমী মনোভাব প্রকাশ করা হয়। সেই গুলো ছিলো তাঁদের আন্দোলনের সম্ভাব্য কাজের সূত্রপাত যা পরবর্তীতে বিস্তারিত ভাবে প্রকাশ পায়। তবে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশ সমূহে বিশাল আকারে ঘর্মঘট পালন শ্রমজিবী মানুষের শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে, শ্রমিকদের বিপ্লবী মনোভাব গড়ে উঠে। সেই সময়ে সকল স্তরে একটি বিরাট পরিবর্তন ও লক্ষ্য করা যায় তা হলো মানুষের মাঝে গনতান্ত্রিক ভাব ধারার সঞ্চালন হতে থাকে। তবে ১৮৪৮-৮৯ সালের বিপ্লবে বিপর্যয় সামগ্রীক ভাবে একটি রাশ টেনে ধরে, কিন্তু তা একেবারে থেমে যায়নি।
ব্রাসেসের সম্মেলনে, ১৮৬৮ সালে সম্পূর্ন এক ভিন্ন ধারার পূর্বসূরীদের চেতনার আলোকে নিজেদের অভিপ্রকাশ ঘটায়। সেই সময়ে এমন একটি কথা সর্বত্রই চালু হয় যে, শ্রমজীবী মানুষ জেগে উঠেছে, তাঁরা এখন অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশী প্রাণবন্ত। এই সম্মেলন বিপুল সংখ্যা গরিস্ট ও স্পষ্ট ভাবে ঘোষনা করে জমির যৌথকরন, এবং অন্যান্য উৎপাদন পন্থার একত্রি করনের উপর । তাঁরা সকল দেশের বিভাগ সমূহের উপর এই মর্মে আহবান জানান যে, স্ব স্ব দেশে এই সর্বাত্ম কাজ অব্যাহত রেখে আগামী সম্মেলনে আরো অধিকতর স্পস্ট ঘোষনা প্রদান করা হবে । সেই আন্তর্জাতিক ছিলো সত্যিকার ভাবেই একটি মুক্তিপরায়ন সমাজতান্ত্রিক বৈশিষ্ট মণ্ডিত। সেই মুক্তিপরায়ন চিন্তাধারা ও বক্তব্য লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে। একটি প্রস্তাবনা তৈরী করা হয়েছিলো যুদ্বের বিরুধিতা করার জন্য। সরকার গুলোকে সাধারন ধর্মঘটের চাপে ফেলে মানুষ খুন, হত্যা, লুন্ঠন থেকে বিরত রাখার জন্য। কেন না কেবল শ্রমিক শ্রেনীর লোকেরাই হলো সমাজের সব থেকে সক্রিয় অংশ যারা সকল প্রকার গন হত্যা রোধ করতে পারে। সেই আন্তর্জাতিক তার দির্ঘ গবেষণা ও পরিক্ষা নিরিক্ষা থেকে সেই কথা ঘোষণা করেছিলো।
১৮৬৯ সালের ব্রাসেলসের কংগ্রেসে শ্রমিকদের জোট সমূহকে ঐক্যবদ্ব করার বিষয়ে প্রায় সকলেই চূড়ান্ত সিদ্বান্তে উপনিত হতে যাচ্ছিল। কংগ্রেসের সামনে একটি বড় প্রশ্ন ছিলো যে, শ্রমিক শ্রেনী প্রচলিত ব্যবস্থায় নানা প্রকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যায় আক্রান্ত। ব্রাসেলসের এই কংগ্রেসে কিছু সংশোধনী আনা হয় যে, যৌথ মালিকানা ও উৎপাদন পন্থার উপর নিয়ন্ত্রন কায়েমের বিষয়টি উন্মুক্ত রাখা হয়। এমন কি শ্রমিকদের সংগঠন স্বেচ্ছায় ত্যাগের প্রশ্নটি ও বিবেচনায় রাখা হয়। ব্রাসেলস কংগ্রেসে এই সকল বিষয়ে খুবই আকর্ষনীয় বিতর্ক হয়, সব শেষে সকলেই ইতিবাচক সিদ্বান্তে উপনিত হতে সক্ষম হয়। তবে এই প্রসঙ্গে শ্রমিক শ্রেনীর সংগঠনের গুরত্বের কথা স্পষ্ট করে দেয়া হয়। ইউজিন হিন্স কংগ্রেসে বেলজিয়ামের ফেডারেশনের পক্ষ থেকে যে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন, উপর্যুক্ত বিষয়ে নয়া ধারনা উপর আলোকপাত করা হয়, ত্রিশের দশকে ওয়েন ইংল্যান্ডের আন্দোলনের কিছু চিত্র ও তুলে ধরেন।
একটি বিষয় সকলেরই মনে রাখা দরকার যে, রাস্ট্রবাদি সমাজতন্ত্রে শ্রমিক সংগঠনের কোন প্রকার গুরুত্ব দেয় নাই। তাঁরা এদেরকে নিজেদের অনুগত সংস্থা বানিয়ে রেখেছে। ফ্রান্সের ব্লেঙ্কাইস্টস ট্রেড ইউনিয়নের লোকেরা কেবল সংস্কার আন্দোলনের জন্য কাজ করত, অন্য কিছু করার জন্য তাঁরা প্রস্তুত ছিলেন না, তাঁরা চাইত কেবল সমাতান্ত্রিক একানায়কতন্ত্র। ফার্দিন্যান্দ লাসাল চাইতেন শ্রমিক শ্রেনীর সকল প্রকার কার্যক্রম একটি পার্টির আওতায় এনে পরিচালনা করতে, তিনি ট্রেড ইউনিয়নের সম্পূর্ন বিরুধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, ট্রেড ইউনিয়ন একটি শ্রমিক শ্রেনীর রাজনৈতিক দলের জন্য অন্তরায় হতে পারে। মার্কস ও তার সময়ের সব চেয়ে জার্মানীর ঘনিস্টতম এই বন্দ্বু মনে করতেন, পুঁজিবাদী সমাজের সাথে সাথে এই ট্রেড ইউনিয়ন গুলো ও হারিয়ে যাবে।তাদের ধারনা ছিলো সমাজতান্ত্রিক সমাজে এই ধরনের সংগঠনের দরকারই পড়বে না । তাঁদের ধারনা ছিলো, প্রলেতারিয়ান একনাকত্ব কায়েম হলে এরাই সকল কিছুর নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবেন।
এই ধারনা সমূহ বাসেলে বিশেষ ভাবে পরিক্ষা নিরিক্ষা করার জন্য গৃহিত হয়। ইউজিন হিন্স বেলজিয়াম প্রতিবেদনে এই বিষয় গুলো কংগ্রেসের সামনে উপস্থাপন করে, স্পেনের প্রতিনিধিগন এইসকল বিষয়ে বিশেষ ভাবে আলোচনায় অংশ গ্রহন করেন। সুইজারল্যান্ডের ও ফ্রান্সের ফেডারেশন সমূহ এই মর্মে বক্তব্য রাখেন যে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন সমূহ কেবল তাৎক্ষনিক বিষয় নয় আগামী বিশ্বের জন্য সয়াজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মানের মত গুরুত্বপূর্ন কাজ সমূহ করার জন্য নিজেদেরকে নিয়োজিত করবে। তাঁরা কেবল দেশীয় বিষয় নয় আন্তর্জাতিক বিষয়ে ও শিক্ষা গ্রহন করে ইতিবাচক ভূমিকা পালনের জন্য প্রস্তুত নিবেন। এই কথা গুলোর প্রেক্ষিতে কংগ্রেস নয়া কার্যবিবরনী প্রনয়ন করেঃ
“ কংগ্রেস এই মর্মে ঘোষনা করে যে সকল শ্রমিকদের উচিৎ তাঁদের স্ব স্ব কর্ম ক্ষেত্রে সংগঠন গড়ে তুলে প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্ব স্ব কর্ম ক্ষেত্রে ইউনিয়ন গড়ে তুলে জাতীয় পর্যায়ের ইউনিয়নকে অবহিত করা । যাতে ইউনিয়ন সমূহের মধ্যে একটি কার্যকরী জোট গড়ে উঠে। এই জোট সকল কল কারাখানা সম্পর্কিত পন্য দ্রব্য সংগ্রহ করবে, সকলের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিবে, করনীয় কি কি তা বাৎলে দিবে, এবং সামগ্রীকভাবে শ্রমিকদের জন্য উপযুক্ত মজুরীর আন্দোলন করে, প্রচলিত মজুরী ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একটি ফেডারেশনের আওতায় মুক্ত পরিবেশ তৈরী করবে। কংগ্রেস সকল দেশের সকল সাধারন কাউন্সিলকে এই আহবান জানায়”।
কংগ্রেসের এই ঘোষনা পত্রে হিনস বিষয় গুলো ব্যাখ্যা করেন এই ভাবে যে, “ স্থানীয় কর্মীগন দুটি সংগঠনের জন্য কাজ করবেন, একটি হলো নিজেদের সংগঠনের অন্যটি হলো জোটের জন্য কাজ। প্রতিটি কারখানায় ও এলাকায় এই রকমেই কারযক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। অন্য দিকে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তারাই প্রতিনিধিত্ব করবেন । শিল্প ও বানিজ্যের কাউন্সিল সমূহ সরকারের স্থান দখল করবে, যা আগের সকল পুরতান ব্যবস্থার সাথে চিরদিনের জন্য সম্পর্ক ছিন্ন করবে”।
এই নতুন ধারনার একটি ফলপ্রসু স্বীকৃতি এসেছে, নয়া অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে, এটা কেবল রাজনৈতিক মতামত ব্যাক্ত করতে পারছে। তাই, সমাজবাদ একটি বিশেষ রাজনৈতিক নয়া প্রকাশ ভঙ্গী ও বটে। এটার মধ্য আছে এক ধরনের প্রাণবন্ত ব্যবস্থা, তাঁরা মনে করেন শ্রমিকদের কাউন্সিল হলো একটি কার্যকরি ব্যবস্থা যা শ্রমিক শ্রেনীর আশা আকাঙ্ক্ষাকে ধারন করে । ল্যাটিন আমেরিকার শ্রমিক শ্রেনীর লোকেরা আরো আগে থেকেই তাঁদের নিজস্ব অর্থনৈতিক লড়াই সংগ্রামকে জোরদার করার এবং সমাজবাদি প্রচার চালাবার জন্য, এবং বেসেলের ঘোষণার আলোকে কাজ করার জন্য আন্তর্জাতিকের সমর্থন পেয়ে আসছে।
তাঁরা রাষ্ট্র, রাজনৈতিক প্রতিনিধি এবং মালিক পক্ষের নিকট থেকে স্বীকৃতি পেয়ে আসছিলেন, তাঁদের কার্যক্রমের লক্ষ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল কারা ছিলো না, তবে তাদের লক্ষ্য ছিলো রাষ্ট্রের বিলয় ও রাজনৈতিক শক্তির বিতারন করা। আর সেই লক্ষ্যে প্রাথমিক ভাবে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা ও শোষণের বিরুদ্বে কথা বলছিলো। তাঁরা সেই সময়ে কেবল বুর্জোয়াদেরকে আক্রমনের লক্ষ্যে পরিণত করেন নাই, এমন কি কোন রাজনৈতিক দল ও সৃষ্টি করে নাই। তাঁরা সেই তথাকথিত পেশাদারী রাজনৈতিক ব্যাক্তি সৃষ্টি করেন নাই যাদের কেবল লক্ষ্য ই হলো রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা । তাঁরা বুঝতে পেরে ছিলেন যে, একক ক্ষমতা দখল, একক ভাবে সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রন নয়া সমাজ ব্যবস্থাকে বিনাশ করে ফেলতে পারে। সেই প্রক্রিয়া সমাজে মানুষের উপর মানুষের প্রভূত্ব কায়েম করে দিতে পারে। তাঁরা তাই একটি চমৎকার প্রশাসনিক ব্যবস্থার উদ্ভাবন করেন। এই জন্যই শ্রমিক শ্রেনী রাষ্ট্র ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের বিরুধিতা করেন। তাঁরা বুঝতে পারেন সামাজিক সংগঠন গুলো হবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার এক একটি ইউনিট, যা নানা শিল্প কারখানায় ও কৃষি বিভাগে বিস্তৃত হবে ক্রমশঃ এই ধারনা থেকেই তৈরী হয় শ্রমিক কাউন্সিলের ।
এই ধরনের চিন্তা চেতনা রাশিয়ান বিপ্লবের সময় ব্যাপক ভূমিকা রাখে, এই চিন্তাধারা শ্রমিক ও কৃষকদের মাঝে বেশ শক্তিশালী ছিলো, কিন্তু প্রথম আন্তর্জাতিকের একটি সেকশন হিসাবে রাশিয়া এই চিন্তার পরিস্কার লালন কারী ছিলো না । বরং উপেক্ষাই করেছে । রাশিয়ায় জারের অধীনে শ্রমিক শ্রেনীর বুদ্বিজিবিদের মধ্যে ও এই চিন্তার অভাব ছিলো। কিন্তু বলশেভিকবাদ এই ফলদায়ক ধারনাটির মৃত্যু ঘটায়। একনায়কতন্ত্রের ধারনা শ্রমিক কাউন্সিল ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ফেলে, এবং পন্য পয়দাকারী লোকদের দ্বারা একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মানের পথ রুদ্ব করে দেয় কমিউনিস্ট পার্টির লোকেরা। দুটি শক্তির মানুষে একত্রিত করে দেবার জন্য তাঁদের মধ্যে মারাতক্মক আমলাতন্ত্র ঝেঁকে বসে। যারা পরবর্তী পরিস্থিতিতে রাশিয়ান বিপ্লবের বারটা বাজিয়ে দেয়। শ্রমিক কাউন্সিল ব্যবস্থা একনায়কতন্ত্রকে প্রশ্রয় দেয় না । এটা এক ভিন্ন ধরনের পরিচালন ব্যবস্থা। যার নির্দেশনা আসে একেবারে সমাজের তলা থেকে। সৃজনশীল শ্রমজীবী মানুষের ভেতরে এর উৎস মূল। অন্য দিকে একনায়কতন্ত্রের মধ্যে সৃজনশীলতা নেই, এটা এক ধরনের মরুভূমি। সেখানে প্রান নেই। চিন্তায় নেই কোন বৈচিত্রতা। সকলেই সেখানে উচ্চতর পদাধিকারীদের মনোরঞ্জনে ব্যাস্ত থাকেন । আর এটাই সেখানে নিয়ম। সেখানে দুইটি ধারার কোন জায়গা নেই। ভিন্ন চিন্তার জন্য খড়গ ঝুলতে থাকে। রাশিয়ায় একনায়কত্ব বিজয়ী হয়েছিলো। প্রমানিত হয়েছে – একনায়কত্ব একটি প্রানহীণ মতবাদ। এটা মরে যায়। পচে যায়। সেখানে সৌভিয়েত তুলে দেয়া হয়। তাঁরা যে নামেই ডাকুক নাকেন সকল কিছুই তার প্রকৃত অর্থ হারিয়ে ফেলে । রূপ নেয় ভিন্ন এক দানবে।
কাউন্সিল পদ্বতীটি শ্রমিক শ্রেনীর লোকেরা ব্যাপক ভাবে গ্রহন করেছিলো, অর্থনৈতিক ভাবে সমাজবাদি সমাজ নির্মানের জন্য এটা ছিলো তাঁদের জন্য উপযুক্ত একটি পদ্বতী। একটি ফলদায়ক উন্নয়ন ব্যবস্থা হিসাবে সমাজবাদি ব্যবস্থায় ও শ্রমিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এর উৎপত্তি হয়েছে । এই ব্যবস্থাটি একটি দক্ষ লোকের জন্য অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। কিন্তু একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে বুর্জোয়া সমাজ থেকে। ঐতিহ্য গত দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে ফ্রান্সের জেকবিনবাদিরা বাবুভিস্ট সম্প্রাদায়ের লোকদের নিকট থেকে এটা ধার নিয়েছিলো, পরে এই ধারনাটি মার্ক্স ও তার অনুসারীগন অনুকরন করতে থাকেন। শ্রমিক কাউন্সিলের ধারনাটি সমাজবাদি ধারনার সাথে নিবির ভাবে জড়িত; একনায়কতন্ত্র সমাজবাদের সাথে কোন ভাবেই সংগতিপূর্ন নয় বরং এটা পুঁজিবাদী রাস্ট্রীয় ব্যবস্থার সাথেই বেশী সামঞ্জস্যশীল।
একনায়কতান্ত্রিকতা হলো একটি স্পষ্ট রাস্ট্রবাদি ধারনাঃ রাষ্ট্র জিনিসটি ই হলো দখল করার মত একটি বিষয়। রাষ্ট্র ধারনার যারাই প্রবর্তক তারাই বলতে চেয়েছেন, একনায়কতান্ত্রিকতার মত একটি অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় চলে আসতে পারে, তাই তাঁরা সকল সময় ই জনগণ ক্ষমতার উৎস, জনগণ ক্ষমতার মালিক, জনগণের ইচ্ছাই হবে আইন এমন অনেক কথাই তাঁরা বলেছেন । কিন্তু একনায়কতন্ত্রের ধারনাই বার বার ফিরে এসেছে রাস্ট্রীয় ব্যবস্থায়, এটা স্বাভাবিক সামাজিক পরিবর্তনে বাঁধা দিয়েছে, মানুষের নিজস্ব চিন্তার জগতে বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে, ফলে কোন কোন সময়ে দরকার হয়ে পড়েছে সহিংস বিপ্লবের। একনায়কতন্ত্র সত্যিকার সামাজিক বিপ্লবের প্রধান বাঁধা, এটা নিচের মানুষের কথার কোন গুরুত্ব দেয় না, শ্রমজিবী মানুষের জন্য তাঁদের কোন অনুভূতি নেই, এঁরা একটি ক্ষুদ্র জনগৌস্টির স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে থাকে। এই মতবাদের অনুসারীরা যদি ভালো লক্ষ্য নিয়ে ও তা কায়েম করেন, তবু এঁরা তাঁদের বিরুধী যুক্তি বা বক্তব্য শ্রবণে ইতিবাচক হয় না। বরং এঁরা বিরুধীদের বিরুদ্বে চরম পন্থার আশ্রয় নিয়ে থাকে। রাশিয়ায় এই কথার উদাহরন দেখা যাবে অগণিত। এর পর ও অন্দ্বমতবাদের অনুসারী কিছু লোক বলেন, সর্বহারাদের একনায়কত্ব কোন ব্যাক্তির একনায়কত্ব নয় এটা হলো একটি শ্রেনীর একনায়কত্ব, এই প্রক্রিয়ার সাথে আমরা নিজেরাই যুক্ত আছি। গঠন মূলক সমালোকনাকে আমরা মূল্য দিয়ে থাকি । আসলে এই ধরনের কথা হলো সহজ মানুষকে বোকা বানানোর আধুনিক কৌশল মাত্র। আসলে শ্রেনী ভিত্তিক একনায়কত্বের ধারনাটি একেবারেই একটি অবাস্তব কথা, তাঁরা আসলে কায়েম করে একটি বিশেষ দলের একনাকত্ব, আর সেই পার্টি চলে শ্রেনীর নাম করে, যেমন বুর্জোয়ারা জনগণের নামে নিজেদের একনাকত্বকে জায়েজ করে নেয় । বাস্তবে এদের মধ্যে কোন ফারাক নেই ।
শ্রমিক শ্রেনীর এই কাউন্সিলের ধারনাটির লক্ষ্যই ছিলো রাষ্ট্র ভিত্তিক ধারনার মূলচ্ছেদ করা; তাই সর্বাত্মক সংগ্রাম আর লড়াই হলো সকল প্রকার একনায়কত্বের অবসান ঘটিয়ে তাঁদের ক্ষমতার আঁধার রাষ্ট্রের বিলয় সাধন করা । এই ধরনার মৌল উৎস হলো প্রথম আন্তর্জাতিক, সেখানে বলা হয়েছিলো অর্থনৈতিক সাম্য কায়েম করতে চাইলে অবশ্যই রাজনৈতি সাম্য চাই। তাই তাঁরা সেখানে প্রস্তাব করেছিলেন, সকল প্রকার রাজনৈতিক প্রতিস্টানাদির বিলুপ্তি সাধনের আহবান করেছিলেন । সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে এই কর্ম সম্পাদন করতে না পারলে শোষণ নিপীড়ন বন্দ্ব করা যাবে না । তাঁরা গভীর ভাবে বিশ্বাস করেছিলেন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সকল শ্রেনীর শ্রমিক একেই পতাকাতলে সমবেত হবেন, এবং মালিক পক্ষ, রাষ্ট্র, ও রাজনৈতিক নিপিড়নের অবসান ঘটিয়ে নয়া সামাজিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করবেন। এই ঘোষণা এসেছিলো স্বাধীন শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক বিভাগ থেকে। মাইকেল বাকুনিন তার নিম্নের বক্তব্যে বিষয় তুলে ধরেন এই ভাবেঃ
“ প্রতিটি সংগঠন আন্তর্জাতিকের আদর্শকে নিজেদের লক্ষ্য হিসাবে স্বাক্ষর দেয়, নয়া রাষ্ট্র বা কোন স্বৈরশাসক প্রতিস্টা করা নয়, বরং প্রতিটি সার্বভৌম শক্তির বিলয় সাধন করে, একটি ভিন্ন ধারার সংস্থা বা সংগঠন কায়েম করবে, যা অবশ্যই হবে রাষ্ট্রের বিপরীত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। তা কর্তৃত্বপরায়ন হবে না, কৃর্তৃত্বপরায়ন হবে না, কৃত্রিম বা সহিংস হবে না, উপর থেকে চেপে বসা বা প্রাকৃতিক উন্নয়ন ও মানব স্বার্থ বিরোধী হবে না। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে হবে উন্মূক্ত ও মানুষের প্রতি হবে মর্যাদাপূর্ন এবং সম্মানজনক। কিন্তু জনগনের জন্য সত্যিকার ভাবে কেমন একটি সংগঠন হতে পারে? এটা হতে পারে মানুষের দৈনিন্দিন পেশাগত কাজের সাথে সংগতি রেখে, যিনি যেমন কর্মের সাথে জড়িত এমন পেশা ভিত্তিক সংগঠন। যখন সকল শিল্প ও বানিজ্য প্রতিস্টান, এমন কি সকল কৃষি ক্ষেত্রে কর্মরত প্রতিনিধি ও তার সংগঠন আন্তর্জাতিকে প্রতিনিধিত্ব করবেন, এটা হবে সাধারন মানুষের সংগঠন বা সকলের মিলন ক্ষেত্র”।
এই ধরনের চিন্তা ধারা এর বিপরিতে ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে, যেমন বুর্জোয়াদের পার্লিয়াম্যান্ট, শ্রমিক ও ব্যবসায়ী সমিতি যা বেলজিয়ামে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে। সেই শ্রমিক চেম্বার তাঁদের বিভিন্ন কল কারখানায় শিল্প ও বানিজ্য সংস্থায় গড়ে তুলা হয়েছে, তাঁরা ও অর্থনৈতিক প্রশ্ন ও পেশাগত দিকের উপর গুরুত্বারোপ করেছে, সাম্যবাদি কিছু রীতিনীতি অনুসরনের কথা বলছেন, তাঁরা ও উৎপাদন পদ্বতীর উপর নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েমের কথা বলছেন। তাঁরা এই চেতনার আলোকে আন্তর্জাতিক পরিসরে নানা প্রকার প্রশিক্ষন প্রদান করছেন। এই সংস্থা সমূহ বুর্জোয়া পার্লাম্যেন্টের নানা কর্মকান্ড নিয়ে নিজেদের মতামত ব্যাক্ত করতে শুরু করে। তাঁরা ও বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার সমালোচনা ও তাঁদের নানা বিধি বিধানের সমালোচনা করে শ্রমিক শ্রেনীর দৃস্টিভঙ্গী তুলে ধরে বক্তব্য প্রদান করেন। ম্যাক্স ন্যাটালো তার গ্রন্থে জনগণের সামনে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। তার গ্রন্থের মধ্যে ছিলো ডার এনার্কিসজম ভন প্রুদোয়ান জো ক্রোপথকিন এবং বাকুনিনের পান্ডোলিপি থেকে বিশেষ ভাবে ভাষ্য তুলে ধরনেঃ
“ সমাজ বিজ্ঞানের সকল গুরুত্বপূর্ন প্রায়োগিক অধ্যয়ন ও গবেষণায় দেখা গেছে, তাঁদের ট্রেড ইউনিয়ন সমূহ ইতিমধ্যে শ্রমিক স্বার্থে লড়াই সংগ্রামে যুক্ত হয়েছেন। সেটা কেবল তত্ত্বগত দিকে নয় তা প্রায়োগিক ভাবে ও বিস্তৃত হয়েছে। তাঁরা শ্রমজীবী মানুষের সত্যিকার স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য কয়েকটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছে। তার মধ্যে, পুঁজি ও কাঁচা মাল এবং এর মধ্য গুরুত্ব পূর্ন উপাদান হলো শ্রমিকের শ্রমী সবের মধ্য অধিক গুরুত্বপূর্ন হলো- শ্রমিকগনের কায়িক শ্রম ও ভূমি উল্লেখযোগ্য । ট্রেড ইউনিয়নের সকল সংগঠন ও ফেডারেশন সমূহ ও তাঁদের শ্রমিক চেম্বারের প্রতিনিধিগন কেবল একাডেমিক কার্যক্রমই গ্রহন করেন নাই তাঁরা তাঁদের তত্ত্ব ও প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তাঁদের সামগ্রীক কার্যক্রমে । তাঁদের অর্থনৈতিক বিজ্ঞান অধ্যয়ন তাঁদের মাঝে বিপ্লবের বীজ বপন করেছে, নয়া দুইয়া গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে। এঁরা বুর্জোয়া বিশ্বের জায়গায় একটি শ্রমিক বিশ্ব গড়ে তুলার শপথে এগিয়ে যাচ্ছেন”।
এই ধারনাগুলি সাধারণভাবে বেলজিয়াম, হল্যান্ড, সুইস জুরা, ফ্রান্স ও স্পেনের আন্তর্জাতিক বিভাগগুলিতে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় এবং শ্রমিকদের জোটের গড়ে তুলা সমাজবাদকে একটি অদ্ভুত সামাজিক চরিত্র প্রদান করে, যা রাজনৈতিক শ্রমজীবনের উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইউরোপে দলগুলিতে প্রায় পুরোপুরি ভুলে যাওয়ার উপক্রম ছিল, এবং শুধুমাত্র স্পেনেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জয়ী হওয়ার জন্য তার শক্তি নিঃশেষ করা যায়নি, আর সেটাই সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে এই দেশে পরিষ্কারভাবে দেখানো হয়েছে। তারা জেমস গুইলোওম, আর্মার স্কুইৎসজিয়াল, ইউজিন ওয়ারলিন, লুই পিনডি, সিয়ার দে পায়েপ, ইউজিন হিইন, হেক্টর ডেনিস, গুইলেমো ডি জিইফ, ভিক্টর আর্নল্ড, আর। ফার্গা পেলিকার, জি। সেন্টিজন, এনেসেলো লোরেঞ্জো মত পুরুষদের সক্রিয় সক্রিয় সমর্থন সেখানে পাওয়া যায়। এখানে এঁরা ব্যাপক পরিচিত নাম। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এঁরা শ্রেষ্ঠ চমৎকার সব মানুষ হিসাবে এবং উন্নত মানের সমগ্র বুদ্ধিজীবী বিকাশে এই উদারবাদী উপাদানগুলির উত্সাহের সাথে যুক্ত হয়েছিলো, এবং ইংল্যান্ডে সুইজারল্যান্ড বা বিশুদ্ধ ট্রেড ইউনিয়ন ভুক্ত রাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক দলসমূহ থেকে কোন উদ্দীপক পাওয়া যায়নি।
তাই যতদিন আন্তর্জাতিক এই সাধারণ লাইনগুলি অনুসরণ করে, এবং স্বতন্ত্র ফেডারেশনের সিদ্ধান্তের অধিকারকে সম্মান করে, তার বিধিমালা হিসাবে দেওয়া হয়, সংগঠিত শ্রমিকদের উপর এটি অসীম প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু এটি পরিবর্তিত হয়ে যায় যখন লন্ডন জেনারেল কাউন্সিলে মার্কস ও এঙ্গেলস তাদের জাতীয় সংসদীয় কার্যক্রমের জন্য পৃথক জাতীয় ফেডারেশনের দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন। ১৮৭১ সালের অনাকাংখীত লন্ডন কনফারেন্সে এটি প্রথম ঘটেছিল। এই আচরণটি কেবল আন্দোলনের আত্মা নয় বরং আন্তর্জাতিক আইনের বিধিসমূহেরও কঠোর লঙ্ঘন ছিল। এটা হয়তো আন্তর্জাতিক মানের সব উদারবাদী উপাদানগুলির একক প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে থাকে, যাতে আরও বেশি প্রশ্ন আসে যা কংগ্রেসে আগে বিবেচনা করা হয়নি।
লন্ডন কনফারেন্সের কিছুদিন পরে জুরা ফেডারেশন সোয়ানভিয়ারের উপর ঐতিহাসিক পরিমাপ প্রকাশ করে, যা্তে লন্ডন জেনারেল কাউন্সিলের অহংকারী অনুমানের বিরুদ্ধে নির্ধারিত এবং অস্পষ্ট শব্দগুলিতে প্রতিবাদ জানানো হয়। কিন্তু ১৮৭২ সালে হেগের কংগ্রেসে, যার মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলগত এবং সবচেয়ে নিন্দনীয় পদ্ধতির কর্মকান্ডের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে সংকট তৈরি করা হয়েছিল, যা লন্ডন সম্মেলনে একটি নির্বাচনী মেশিনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রূপান্তরের কাজ শুরু হয়েছিল। ব্ল্যানকাইস্ট, এডউয়ার্ড ভ্যালেন্ট, এর মধ্যে সৃষ্ট ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটানোর জন্য জেনারেল কাউন্সিলের প্রস্তাবিত প্রস্তাবের জন্য তার যুক্তি অনুযায়ী শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক ক্ষমতার বিজয়কে ব্যাখ্যা করে যে, "খুব তাড়াতাড়ি এই প্রস্তাবটি কংগ্রেস কর্তৃক গ্রহণ করা হয়েছে এবং তা ই ইন্টারন্যাশনাল দলিলের অন্তর্গত হয়েছে, প্রতিটি সদস্যকে বহিষ্কারের শাস্তি প্রদানের দায়িত্ব প্রদান করা হবে। " মার্কস ও তার অনুসারীরা সরাসরি আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী আন্দোলন বিকাশের পথে বাঁধা দেবার জন্য তার সমস্ত বিপজ্জনক পরিণতির দিকে এগিয়ে যান বিভক্ত হয়ে পড়েন। আন্দোলন, এবং সংসদীয় রাজনীতির সময়কালের উদ্বোধন যা প্রাকৃতিক চাহিদা যা বুদ্ধিবৃত্তিক স্থিরতা ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে নৈতিক অধঃপতনের দিকে পরিচালিত করে, যা আজ আমরা বেশির ভাগ দেশে এর নজির দেখতে পাই ।
হেগ কংগ্রেসের পর শীঘ্রই আন্তর্জাতিক কৃতৃত্ববাদ বিরুধী ফেডারেশনের প্রতিনিধিবৃন্দ সেন্টম এমিয়ারে সহ-কর্তৃত্ববাদী কংগ্রেসের সাথে সাক্ষাৎ করেন, যা হেগ এ নিষ্ক্রিয় ও বাতিলকৃত সমস্ত সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করে। তারপর থেকে সরাসরি বিপ্লবী কর্মের সমর্থক এবং সংসদীয় রাজনীতির মুখপাত্রদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ক্যাম্পে বিভাজনের তারিখগুলি, যা সময় শেষ হওয়ার সাথে সাথে ক্রমবর্ধমান এবং আরও অযৌক্তিক হয়ে উঠে। মার্কস ও বাকুনিন সমাজতন্ত্রের মূলনীতির দুটি ভিন্ন ধারণার মধ্যে এই সংগ্রামে বিরোধিতাকারী দলগুলোর মধ্যে নিছক বিশিষ্ট প্রতিনিধি ছিলেন। কিন্তু এই সংগ্রামকে ব্যাখ্যা করার জন্য এটি একটি বড় ভুল হবে যে, কেবল দুটি ব্যক্তিত্বের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব; এটি দুইটি ধারার ধারণার মধ্যে বিরোধিতা ছিল যা এই সংগ্রামকে তার প্রকৃত গুরুত্ব দিয়েছে এবং আজও তা দেয়। মার্কস এবং এঙ্গেলসদের বিরোধিতা এই ধরনের একটি হিংসাত্মক এবং ব্যক্তিগত চরিত্র দিয়েছেন যা সত্যি একটি বিপর্যয় ছিল। ইন্টারন্যাশনাল প্রতিটি দলের জন্য সুযোগ ছিল, এবং বিভিন্ন মতামত একটি ক্রমাগত আলোচনা শুধুমাত্র তাদের স্পষ্টীকরনে যাতে অবদান রাখতে পারে। কিন্তু একটি বিশেষ ধারার চিন্তার অবদানকারীর সমস্ত বিভাগ তৈরির প্রচেষ্টার ফলে একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের একটি সংখ্যালঘুকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, তবে একটি বিচ্যুতি হতে পারে এবং শ্রমিকদের মহান জোটের পতন হতে পারে, তবে সেই প্রতিশ্রুতিশীল জীবাণুগুলি ধ্বংস করতে পারে যা প্রত্যেক দেশের শ্রম আন্দোলনে খুব গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখতে পারে ।
ফ্রাঙ্কো-প্রুশীয় যুদ্ধ, যার ফলে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় বিন্দুটি জার্মানিতে স্থানান্তরিত হয়, যেখান কার শ্রমিকরা বিপ্লবী ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না । যেমন পশ্চিমের সমাজতান্ত্রিকদের অর্জিত অভিজ্ঞতা দ্বারা সমৃদ্ধ নয়, এই পতন ব্যাপকভাবে অবদান রাখে। প্যারিস কমিউনিুনের পরাজয় এবং ফ্রান্সে প্রারম্ভিক প্রতিক্রিয়া, যা কয়েক বছর স্পেন ও ইতালি জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, এই পটভূমিতে শ্রমের জন্য একটি কাউন্সিল পদ্ধতির ফলপ্রসূ ধারণাটির উৎপত্তি হয়ে অব্যাহত ছিল। ঐসব দেশের আন্তর্জাতিক অংশগুলি কেবল একটি গোপন অস্তিত্ব বহন করে ঠিকে ছিলেন এবং এর প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তাদের সমস্ত শক্তিকে মনোনিবেশ করতে বাধ্য ছিলেন। ফ্রান্সে বিপ্লবী সিনডিসিলিজমের সৃজনশীল ধারণাগুলি জন জাগরণের সাথেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিস্মৃতি থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল, আবার সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক আন্দোলনকে প্রাধান্য দেবার জন্য।
ভাষান্তরঃ এ কে এম শিহাব