রুডলফ রকারের এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমঃ তত্ত্ব ও অনুশীলন (দ্বিতীয় অধ্যায়)

দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ আধুনিক শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা ও প্রলেতারিয়েতের সংগ্রাম

সমাজের চলমান আভ্যন্তরীণ নানা প্রকার দ্বন্দ্ব ও অসঙ্গতি দূরকরার জন্য যখন মানুষের প্রয়োজন তিব্রতর হয়, তখনই সমাজবাদের উদ্ভব হয়, যা মানুষকে নয়া পরিবেশে নয়া সামাজিক সম্পর্কের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এটা প্রথমিক ভাবে একটি ক্ষদ্র বুদ্বিজীবী মহলকে প্রভাবিত করে যারা শ্রমিক নয়, বরং সমাজের সুবিধা প্রাপ্ত শ্রেনীর লোক। তাঁরা প্রভাবিত হয়েছিলেন মূলত একটি মহৎ ভাবনা ও মানুষের প্রতি তিব্র ভালোবাসা থেকে। সাধারন মানুষের মুক্তি, সামাজিক দ্বন্দ্বের নিরসন, ও সুন্দর ভবিষ্যত গড়ার জন্য সমাজবাদের প্রবর্তন হয়। উল্লেখ্য যে, সেই সুবিধা প্রাপ্ত শ্রেনীর নিকট সমাজবাদ ছিলো একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন; তাই তাঁরা এই আন্দোলনের বার্তা সেই সমাজের লোকদের নিকট সরল, সরাসরি ও নৈতিক আবেদন হিসাবে প্রচার করতে থাকেন। তাঁদের প্রত্যাশা ছিলো সমাজ সহজেই এটা গ্রহন করবে।

কিন্তু সেই ধারনা বা প্রচার কোন আন্দোলন সৃজন করতে পারে নাই; তাঁরা কেবল তাঁদের চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কাজে নামেন, তাঁরা তাঁদের জীবনের বিশেষ অবস্থার কথা চিন্তা করে বুদ্বিবৃত্তিক উদ্যোগ নেন। আন্দোলন মানুষে সামাজিক জীবনের তাতক্ষনিক ও অতি প্রয়োজনীয় বিষয় গুলোকে সামনে রেখে এগোয়। তা এগিয়ে যাবার শক্তি, বিজয়ী হবার যৌক্তি,  এবং বুদ্বিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্র কামনা করে। সমাজবাদের জন্য তাঁরা শ্রমিক আন্দোলনকে যুক্ত করে, এবং মেধা ও যুক্তি দিয়ে তাঁর একটি আকৃতি দেয়া হয়। সমাজবাদি আন্দোলন শ্রমিক আন্দোলনের ভেতর থেকে সৃষ্টি করা হয়নি; বরং এটা সৃজন হয়েছে তাঁর বাহির থেকে। বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজের ভেতর সামাজিক পুর্গঠনের লক্ষ্যে এই আন্দোলনের সূচনা হয়। এই আন্দোলনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিলো মানুষের রুটির ব্যবস্থা ও শ্রমজীবী  মানুষের জীবন যাত্রার সুরক্ষা নিশ্চিত করা ।

আজকের শ্রমিক আন্দোলন ইংল্যান্ডের অষ্টাদশ শতাব্দির শিল্প বিপ্লবের নিকট ঋণী। এই আন্দোলন সেখানে উৎপত্তি হলে ও পরবর্তীতে প্রায় সকল মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সেই যে “ম্যানুফ্যাক্সারিং” পদ্বতীর উদ্ভব হলো যা পরবর্তী সময়ে শ্রমিকের কাজের দক্ষতাকে নানা ভাবে বিভক্ত করে উৎপাদন ব্যবস্থায় এক আমূল পরিবর্তন সাধন করে দেয়। সাধারন ভাবে তখন মানুষের চেয়ে যন্ত্র অধিকতর গুরুত্ব পেতে থাকে। কাপড় ও সুতা তৈরীর জন্য যে মেশিন উদ্ভাবন হয় যা শ্রমিকদের জন্য এক অভাবনীয় বিপ্লবের সূচনা করে । এই স্বয়ংক্রিয় মেশিন অনেক শ্রমিকের কাজ একাই করে দিতে পারে, ফলে শ্রমিকদের কাজ হারাবার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

জেমস ওয়াট উদ্ভাবিত ষ্টীম ইঞ্জিন আবিস্কার, উৎপাদন কারীদেরকে বাতাস, পানি, ও ঘোড়ার শক্তির উপর নির্ভরতা কমিয়ে দেয়। সেই সময় থেকেই উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এক ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে। এটা নয়া নয়া উৎপাদনের ক্ষেত্র ও তৈরি করে দেয়। আধুনিক ফ্যাক্টরি, প্রদর্শনী দোকান, উন্নত বিক্রয় কেন্দ্রের উন্মেষ ঘটে সেই সময়ে। বিশেষ করে বস্ত্র উৎপাদন খাতে ও অন্যান্য খাতে অল্প সময়ের মধ্যেই একটা প্রচণ্ড বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে ফেলে  উন্নত ইউরূপীয় দেশ সমূহে। শক্তির ব্যবহার করে লোহা ও কয়লার ব্যবহারে এক বৈপ্লবিক অগ্রগতি সাধন করে তাঁরা। শ্রমিকদের কর্মপরিবেশে আসে এক নয়া আবহ। ক্রমে বড় বড় শিল্প কারখানের জন্ম হতে থাকে, আর তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে নানা স্থানে শহর নগর । ১৮০১ সালে বার্মিং হামের লোক ছিলো মাত্র ৭৩,০০০ এবং ১৮৪৪ সালে এসে দাঁড়ায় ২০০,০০০ আর সেফিল্ডে ৪৬,০০০ হাজার থেকে উন্নিত হয় ১১০,০০০ তে। এই ভাবে সমগ্র দুনিয়ার শিল্পের সাথে সাথে শহর নগরের আকার ও অধিবাসিদের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্বি পেতে থাকে।

প্রতিটি ফ্যাক্টরিতেই দরকার হয় কাজের জন্য মানব খাদ্যের । গ্রামীন অঞ্চল দরিদ্র হতে থাকে, পানির শ্রুতের মত মানুষ নগর মূখী শহর মূখী হতে থাকে।  মানুষের উপর অভিশাপ হয়ে নেমে আসে ‘এনক্লোজার আইন’ । সেই আইনের বলে কারখানার জন্য কৃষকের জমি অধিগ্রহন চলতে থাকল আর সাধারন মানুষকে ভিক্ষুকের স্তরে নামিয়ে দিল শিল্পায়নের উদ্যোগ। ১৭০২-১৭১৪ সালে রানী এনের সময় কাল থেকে পদ্বতীগত ভাবে মানষের সম্পদ চুরির বন্দবস্ত করা হয়। ১৮৪৪ সালে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের এক তৃতীয়াংশ কৃষি জমি অধিগ্রহন করে নেয়া হয়েছিল। ১৭৮৬ সালে যেখানে স্বাধীন ভূমি মালিক ছিলেন প্রায় ২৫০,০০০ জন, তা মাত্র ত্রিশ বছরে কমে এসে দাঁড়ায় ৩২,০০০ জনে।

নয়া ধরনের যন্ত্রপাতি উৎপাদনে অকল্পনীয় ভাবে তথাকথিত জাতীয় সম্পদ বৃদ্বি করে দেয়। কিন্তু সেই সম্পদের মালিক হয়ে বসে স্বল্প কিছু সুবিধা প্রাপ্ত জন গুষ্টি। অন্যদিকে, চলতে থাকল  শ্রমজীবী মানুষের উপর সীমাহীন শ্রম শোষণ। দ্রুত তাঁদের জীবন যাত্রা নিচের দিকে নামতে থাকে, গ্রাস করতে থাকে চরম দারিদ্রতা, দেখা দেয় নানা ভাবে বিদ্রোহ। সে সময়ের কারখানা সমূহের শ্রমিক ও কাজের পরিবেশ সংক্রান্ত  রিপোর্ট পড়লে মানুষ হতাশায় ও বিষাদে পরিপূর্ন হয়ে যাবে। যা কার্ল মার্ক্স তাঁর পুঁজি গ্রন্থে; ইউজিন তাঁর ডি লা মিজারি দেস ক্লাসেস লেভুরিয়াসেস এন এংলিটারি এট ফ্রান্স, এবং এঙ্গেলস তাঁর ইংল্যান্ডের শ্রমিকদের অবস্থা নামক গ্রন্থে এই বিষয় বিশ্লেষণ মূলক আলোচনা করেছেন। এ ছাড়া ইংক্যান্ডের অন্যান্য লিখকদের লিখায় ও তৎকালীন চিত্র ফোটে উঠেছে। যা সত্যি মানব জাতির ইতিহাসে অত্যন্ত মর্মান্তিক চিত্র।

মহান ফ্রান্স বিপ্লবের মাত্র কিছু দিন আগে স্বনাম ধন্য লিখক আর্থার ইউং ফ্রান্সে ভ্রমন করেন, তিনি তাঁর ভ্রনম কাহিনীতে লিখেন, ফ্রান্সের পল্লী এলাকার মানুষেরা প্রায় পশুরমত জীবন যাপন করছে, তাঁরা তাঁদের চরম দারিদ্রতার কারনে সকল মানবীয় গুনাবলী হারিয়ে ফেলছে। পুঁজিবাদের এই উষা লগ্নে শিল্প শ্রমিকগন তাঁদের জ্ঞান বুদ্বি হারিয়ে অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে।

অগনিত শ্রমিক অত্যন্ত নোংরা পরিবেশে প্রায় অন্দ্বকার ঘরে যেখানে জানালানেই এমন কি আলো আসার মত গ্লাস ও লাগানো নেই, সেখানে শ্রমিকগন বস্ত্র কারখানায় চৌদ্দ পনর ঘণ্টা এক নাগারে কাজ করতে বাধ্য হয়। তাঁদের জন্য স্বাস্থ্য ও জীবনের  সুরক্ষার কোন যন্ত্রপাতি বা ঔষধপত্র কিছুই রাখা নেই। আর যে পরিমান বেতন দেয়া হয় তা একেবারেই পর্যাপ্ত নয় এমনকি তাতে তাঁদের খাওয়া পড়ার ব্যবস্থাও হয়না বললেই চলে। সপ্তাহ শেষে এই কারখানা নামক জাহান্নাম থেকে কয়েক ঘন্টার জন্য তাঁরা যে ছুটি পায় তাতে এই দুঃখের অবস্থা থেকে ভুলে থাকার জন্য অস্বাস্থ্যকর মধ্যপান করে থাকে।  এই পরিস্থির কারনে স্বাভাবিক ভাবেই সরকারী অনুমোদনেই নানা জায়গায় বেশ্যালয় ও পানশালা গড়ে উঠে । তাঁর সাথে সাথে অপরাধ ও বাড়ে। মানুষের যখন নৈতিক অধঃপতন হয়, তখন সে সকল কিছুই করতে পারে, এমনকি নিকৃষ্ট ধরনের কাজ করতে ও তাঁর কোন প্রকার লজ্জা হয়না ।

কারখানায় দাসত্বের জীবন যাপন ও নিকৃস্টতম পরিস্থিতিতে মালিকেরা ততাকথিত ট্র্যাক ব্যবস্থার প্রবর্তন করে তাদেরকে দৈনিন্দিন জীবন যাপনের জন্য  অতি নিম্নমানের পন্য কিনতে বাধ্য করা হয়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছিলো যে, শ্রমিকগন তাঁদের অনেক অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে ও তাঁদের কঠোর শ্রমের মজুরী থেকে মূল্য পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছিলো। যেমন, ডাক্তার, ঔষধ, ও অন্যান্য পন্য কিনার জন্য তাদেরকে টাকা দিতে বাধ্য করা হত। সেই সময়ের লিখকগন লিখেছেন যে, একজন মাকে তাঁর মৃত সন্তান কবর দিতে হলে ও রক্ষী এবং কবর খননকারী কে টাকা প্রদান করতে হত ।

সেই সময়ের আইনী শোষন ও মানুষের শ্রম শক্তির শোষণ কেবল পূর্ন বয়সী নারী পুরুষের মাঝে সিমাবদ্ব ছিলো না । তখন এমন কিছু মেশিন পত্র আবিস্কার হয় যা চালনা করার জন্য তেমন শক্তির দরকার পরত না । অল্প কিছু নড়াচড়া করলেই কাজ হয়ে যেত। তাই পুঁজিবাদীদের লক্ষ্য পরিণত হল প্রলেতারিয়েত শিশু সন্তানেরা, তিন চার বছরের শিশুদেরকে ও শিল্প কারখানার অন্দ্বকার প্রকোষ্ঠে নিয়ে আসা হয় কাজের জন্য, ব্যবসায়ের জন্য এবং উৎপাদনের জন্য ।  শিশু শ্রমিকদের ইতিহাস, এর আগে এত নির্মম কোথাও ছিলো না, আর এটা ছিলো পুঁজিবাদের ইতিহাসে একটি গভীর অন্দ্বকার যুগ। এটা স্পষ্ট করে দেয় খৃস্টীয় ব্যবস্থাপকগন কত নির্মম ছিলো। এঁরা মুনাফার জন্য, ব্যবসায়ের জন্য, জনগণকে শোষণ করার জন্য কত নিচে নামতে পারে । সিমাহীন কষ্টের পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে অগণিত শিশুর মৃত্যু হতে থাকে, তা দেখে রিচার্ড কার্লাইল খুবই দুঃখিত হয়ে উক্তি করেন, “ বেথেলহামের নিরাপরাধ শিশুদের হত্যা করার রেওয়াজ আবার ফিরে এসেছে”। পার্লামেন্টে আইন হবার পর ও ফ্যাক্টরি মালিকগন সেই বাস্তবায়নে প্রচুর সময় নেয় ।

রাষ্ট্র  ফ্যাক্টরি মালিকদেরকে শোষণ করার জন্য ও নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ব্যবস্থাপনা বিভাগকে ব্যাপক সুযোগ দিয়েছে । রাষ্ট্রের লক্ষ্যই ছিলো কম বেতনের শ্রমিক সর্বরাহ করা। উদাহরন হিসাবে বলা যায়, ১৮৩৬ সালে যে কাল আইন টি প্রনয়ন করা হয় তাতে ইংরেজ শ্রমিক সহ  শ্রমিকের মাঝেই অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। সকল পুরাতন আইন কানুন ই প্রনয়ন করা হয়েছিলো রানী এলিজাবেথের সময় কালে, যার লক্ষ্য ছিলো মানুষের উপর ইংল্যান্ডের ধানবীয় চরিত্রটি বুঝিয়ে দেয়া । এই ধানবীয় আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে প্রায় গরীবের সম্পদের তিন ভাবের এক ভাগ খরচ করতে হত। কিন্তু যারা ভালো মনের অধিকারী মালিক তাঁরা তাঁদের আয়ের এক তৃতীয়াংশ দিয়ে দিতে চায়নি। তাঁরা মানবেতর জীবন যাপন কারী লোকদের জন্য কিছু সুবিধা প্রদানের চিন্তা করতে থাকেন, এবং আইনগত পরিবর্তনের জন্য প্রস্তাব করেন । পরিস্থিতিগত কারনে বেশ কিছু আইন কানুন  নতুন করে প্রনয়ন করা হয় এবং অনেক পুরাতন আইনের সংশোধন করা হয় ।

নয়া আইনে দারিদ্রতাকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, এবং কেহ যেন নিজের স্বতঃস্ফুর্ততার কারনে পিছিয়ে না পড়েন সেই দিকে তাকিদ করা হয়েছে। নয়া আইন কানুনে ম্যালতাসিয়ান ভাবধারাকে নানাভাবে জনগনের সামনে হাজির করার চেষ্টা করা হয়েছে, মালিক পক্ষকে দিয়ে এর প্রশংসা করা হয়ে, বলা হয়েছে এই পদ্বতী একটি বিশাল উদ্ভাবন। ম্যাথিউ, যিনি জন সংখ্যা তত্ব নিয়ে কাজ করার জন্য খুবই প্রশংসিত তিনি গডউনের রাজনৈতিক বিচার নামক গ্রন্থে এই ব্যবস্থার জবাব দিয়েছেন। তিনি এই ব্যবস্থাকে খুনের নামান্তর বলে অভিহিত করে বলেছেন, দরিদ্রদের পরিবারে নয়া মুখের আগমনকে বারিত করার অধিকার কারো থাকা উচিৎ নয়। ‘জন্ম নিয়ন্ত্রনের মত’ এই ধরনের দৃষ্টি ভংগী, অবশ্যই, শিল্প কারখানার মালিকদের জন্য মিলিত ভাবে সীমাহীন শোষণের পথ করে দেয়াই ছিলো নয়া আইনের প্রধান লক্ষ্য ।

নয়া আইন দরিদ্র জনগণের জন্য আলাদা ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য প্যারিস কর্তৃপক্ষের বাহিরে রাষ্ট্র পক্ষের নিয়োজিত একটি আলাদা কমিটি গঠন করা হয়। শ্রমিকদেরকে আর্থিক সহায়তা দান বা বর্তমান কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ উন্নয়নের জন্য  পদক্ষেপ নেয়া হয়, সেই ব্যবস্থাটি ও ছিলো গনমানুষের জন্য ভয়ঙ্কর, তাই লোকেরা সেই নয়া আইনকে বলতে থাকল “ গরীবের ব্যাস্টাইল আইন”। মানুষের মধ্যে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, তাঁরা ভাবতে থাকেন, যাদের ভাগ্য খারাপ তারাই বাধ্য হয়ে সেই কলখানায় বন্দ্বির মত আত্মসমর্পন করে। যেখানে তাঁদেরকে অত্যাচার ও শাস্তি ভোগ করতে হয় । অর্থাৎ কর্ম ক্ষেত্র হয়ে পড়ল বন্দ্বিশালা । সেই কর্মক্ষেত্র সমূহ ছিলো প্রচণ্ড নিয়ম শৃংখলায় পরিপূর্ন, কেহ নূন্যতম নিয়ম ভঙ্গ করলেই নেমে আসত সীমাহীন শাস্তির খড়গ।  প্রতিটি ব্যাক্তির জন্য নির্ধারিত থাকত তাঁর কাজ; যদি সে তাঁর কাজটি কোন কারনে করতে ব্যার্থ হত হবে তাঁর ভাগ্যে খাদ্য জোটত না, দেয়া হত ব্যাপক শাস্তি। জেল খানার বন্দ্বিদের জন্য খুবই নিম্নমানের ও স্বল্প পরিমান খাবার শ্রমিকদের জন্য বরাদ্ব করা হত । চিকিতসার জন্য তেমন কোন ব্যবস্থা ছিলো না। তাঁদের শিশুরা পর্যন্ত অত্মহত্যার পথ বেচে নিত । শ্রমিকদের অবস্থা এমন ভাবে তৈরি করা হয় যে শ্রমিকদেরকে তাঁদের পরিবার পরিজন থেকে পৃথক করে দেয়া হয়।  তাঁদের আপনজন ও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দেখা করতে পারত না । দেখা করলে ও তাঁদের পর্যবেক্ষকদের সামনে দেখা করতে হত । মালিক পক্ষের প্রতিটি নির্দেশনা ও পদক্ষেপই ছিলো শ্রমিকদেরকে সন্ত্রস্ত্র করা রাখা, যেন সকলেই নিজেদেরকে উদ্বাস্তুদের মত শিকরহীন ভাবতে থাকে। আর এটাই ছিলো নয়া আইন কানুনের আসল মতলব। বৃহৎ শিল্প কারখানা ও যান্ত্রিক ব্যবস্থার ফলে হাজার হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়ে, যারা বস্ত্র শিল্পের উপর নির্ভরশীল ছিল নিজেদের জীবন জীবিকা নির্বাহের জন্য। সেই সময়ে প্রায় ৮০,০০০ হস্তচালিত শ্রমিক ছিলেন যারা প্রায় ভিক্ষুকে পরিণত হন। তখন শ্রমের বাজেরে মারাত্মক মন্দ্বা দেখা দেয়, মালিক পক্ষ শ্রমিকদের মজুরী ব্যাপক হারে কমিয়ে দেয় ।

সেই যন্ত্রনাদায়ক পরিস্থিতিতে সামাজিক ভাবে এক নয়া শ্রেনীর জন্ম হল, ঐতিহাসিক ভাবে যাদের তেমন কোন উল্লেখ নেইঃ এঁরা হলো আধুনিক শিল্প প্রলেতারিয়েতঃ এত দিন যারা ছিলেন ক্ষুদ্র কুটির শিল্প শ্রমিক, স্থানীয় ভাবে মানুষের চাহিদা মেটাতেন, এবং তুলনা মূলক ভাবে সুন্দর ও সুখী জীবন যাপন করতেন, তাঁদের জীবন যাত্রায় তেমন কোন বার্তি ঝামেলা বা উপদ্রপ ছিলো না । সে তাঁর শিক্ষানবিসি হিসাবে সেবা দিত, একজন ভ্রমণকারীর মত ছিলো তাঁর জীবন। কিন্তু পড়ে পুজির করাল গ্রাস এসে সকল কিছু বদল করে দেয়। মানুষ মেশিনের সাথে সাথে পুজির কারায়ত্বে চলে চায় –আর হারিয়ে ফেলে স্বীয় স্বাধীনতা। সেই যুগটাকে বলা হয়ে থাকে মেশিনের যুগ। মানুষ মানুষের জন্য কাজ করত, এবং প্রকৃতিক বৈচিত্রময় পরিবেশে নিজের ইচ্ছায় অন্যের খুশির জন্য নিজেকে নিবেদন করত, কিন্তু মেশিনের যাঁতাকলে সকল কিছুতে এক আমূল পরিবর্তন এসে হাজির হয়।

পুঁজিবাদ বিকাশের সূচনা লগ্নে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্পের মালিকেরা নিজেদের উৎপাদিত পন্য শহরের বড় বড় পুঁজিপতি ব্যবায়ীদের নিকট বিক্রি করে দিতে থাকে, যা সত্যিকার ভাবে প্রলেতারিয়েতের নাগালের বাইরে ছিলো। শিল্প, বিশেষ করে বস্ত্র শিল্প, যাদের উৎপাদন কেন্দ্র ছিলো গ্রামীন জেলা শহর সমূহ, আগের ক্ষুদ্র শিল্প সমূহ ছিলো ছোট জায়গা নিয়ে যার ব্যবস্থাপনা ও ছিলো সহজতর। কিন্তু বৃহৎ শিল্প বিশাল জায়গা নিয়ে গড়ে উঠার কারনে ব্যস্থাপনায় ও আসে ব্যাপক পরিবর্তন ও জটিলতা । ফলে পন্যের চাহিদার সাথে সংগতি রেখে সর্বরাহ একটি বড় বিষয় হয়ে দেখা দেয় । তা করতে গিয়ে ও শ্রমিকদের সুরক্ষার নিয়ম অনেক ক্ষেত্রেই সংকটের সৃষ্টি করে ।

আধুনিক যন্ত্রপতির উৎপাদন শুরুর পর থেকেই চারিপাশের সব কিছুতে একটা ব্যাপক পরিবর্তন চলে আসছিলো, সাধারন বাজারে পণ্যের চাহিদা ও দিনে দিনে বাড়তে থাকে, এবং বিদেশী বাজার দখলের প্রবনতা ও লক্ষ্য করা যায় প্রবল ভাবে । প্রতিটি নয়া আবিস্কার, উৎপাদনে নয়া মাত্রা যুক্ত হয়, বাড়তে থাকে উৎপাদনের পরিমাণ, অন্যদিকে ঝামেলা মুক্ত কল কারখানার মালিকদের শিল্প পুঁজির পরিমাণ বৃদ্বি পায় ব্যাপক ভাবে, আয় বৃদ্বি পায় ব্যবসা বানিজ্যের ও সকল  ক্ষেত্রে। বাজারে মুক্ত প্রতিযোগিতার সময় থেকেই অর্থনীতির তাত্ত্বিকগণ সকল প্রকার নিয়ন্ত্রন প্রয়োগ করা থেকে বিরত ছিলেন, তাঁর জন্য স্বল্প মেয়াদি বা দির্ঘ মেয়াদি কোন প্রকার উৎপাদন নিয়ন্ত্রনের কথা বলে নাই। তাঁরা বাজারের চাহিদার আলোকে সরর্বরাহকে সকল সময় কর্মরত রাখতে  গুরত্ব দিয়ে এসেছেন। এই প্রক্রিয়া্য উৎপাদনে এক সময় নেমে আসে বিপর্যয়, তৈরি হয় তথাকথিত সঙ্কটের, যার ক্ষতিকর প্রভাব পতিত হয় প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর উপর, মালিক পক্ষ সকল কিছুর জন্য দায়ীকরে শ্রমিকদেরকে, ফলে তাঁদের জীবন যাত্রার মান আরো কমিয়ে দেয়া হয়। আর সেই পরিস্থিতিটি সৃষ্টি হয়েছিলো তথাকথিত “অতি উৎপাদন” হবার কারনে, এটা ছিলো আধুনিক পুঁজিবাদের একটি কুৎসিত চিত্র, সেই সময়ে গুদাম গুলো মালামালে পরিপূর্ন হয়ে উঠেছিলো, সেই বিশাল উৎপাদনের  পরিনামে উৎপাদন কারিদের জন্য নেমে এলো সীমাহীন দূর্ভোগ। এটা পরিস্কার যে, এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানুষের কোন মূল্য নেই, এবং প্রাণহীন সম্পদের মালিকানাই সব কিছুর উপরে।

অর্থনৈতিক পরিমন্ডল বৃদ্বির পাশাপাশি প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর মানুষের সংখ্যা ক্রমশ ও বাড়তে থাকে, এই বৃদ্বির ক্ষেত্রে আসলে সেই পরিস্থিতি ও প্রচলিত ব্যবস্থায় কারো পক্ষেই কিছু করা সম্ভব ছিলো না । ফলে মানুষের মাঝে যে হাজার হাজার বছর ধরে একটি বন্দ্বন ছিলো তা শ্রমিক ও মালিকে ভাগ হয়ে গেল তিব্রভাবে।  এই পরিস্থিতি সৃষ্টির ফলে যে বিভাজন হয় তা নিয়ে, আধুনিক একজন সাধারন শ্রমিকের কোন অনুভূতিই ছিলো না । সে হয়ে উঠলো একজন শোষণের বস্তু, একটি বিশেষ শ্রেনীর মানুষ, পূর্বেকার সেই লোকদের সাথে তার আর কোন স্বাভাবিক সামাজিক সম্পর্কই থাকল না ।  একজন কারখানার মালিক হয়ে গেলেন একজন প্রভূ, তিনি আর মানুষ রূপে গন্য হতে চাইলেন না । সেই শ্রমিক হয়ত বলবেন, নগর আর শহরে শিল্প কারখানার বিপ্লব হয়েছে, তাই আমরা ও আমাদের সামাজিক সম্পর্ক হারিয়ে ফেলেছি। সামাজিক ভাবে উদ্ভাস্ত মানুষ গুলো বলবে, আমরা সকলেই হয়ত একেই জাহাজের যাত্রী ছিলাম এখন সকলের ভাগ্যেই একেই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একজন আধুনিক শ্রনিকের পরিচয় হলো তিনি একজন সাধারন মানুষ নন, তিনি এখ  একটি যন্ত্রের অংশ, রক্তে মাংশে মিশে গেছে যান্ত্রিক আচরন । তিনি এখন একটি মেশিনের মতই ঘোড়পাক খান। তিনি এখন অন্যের জন্য পন্য তৈরি করেন, এই পন্য আর সম্পদ তৈরি করতে করতেই তাঁর জীবনের সারা সময় কেটে যায়।

তিনি এখন এমন সব বন্দ্বুদের সাথে বসবাস করেন, শিল্প কারখানায় তাঁর মত নানা স্থান থেকে এসেছে, তাঁদের আচার আচরন কথা বার্তার সাথে তিনি নতুন ভাবে পরিচিত হন, চিন্তায় ভাবনায় দেখা দেয় পরিবর্তন, ক্রমশ বদলে যায় তাঁদের জীবন প্রবাহ। পরিবর্তিত এই দুনিয়ায় তিনি একটি মেশিনে পন্ডিংপ্যাড চিমনিতে স্থাপন করতে গিয়ে নিজেকে এই বিশাল শক্তিশালী মেশিনের একটি চাকার একজন চালক হিসাবে চিন্তা করতে গিয়ে অসহায় ভাবে ভাবতে থাকেন। তিনি ভাবতে থাকেন যেখানে এসেছি সেখান থেকে হয়ত আর ফেরা হবে না কোন দিন। ফিরে যাওয়ার পথ চার দিক থেকে বন্দ্ব হয়ে গেছে । তিনি কেবল একা নন এমন আরো অনেকের ভাগ্যেই ঘঠেছে এই অসহনীয় অবস্থার। সামাজিক যে বিচ্ছিন্নতা ঘটেছে, ব্যাক্তিগত ভাবে এর বিপরীতে তাঁর কিছুই করার ছিলো না । তাই নতুন কিছু করতে চাইলে, ভাগ্যের পরিবর্তন করতে চাইলে, একেই পরিস্থিতির শিকার যারা তাঁদের সকলকে নিয়ে ভালো কিছু করতে হবে। তা হলেই মেশিনের চাকা, গাড়ির ইঞ্জিন, বন্দরের মালামাল উঠানো নামানো সব বন্দ্বকরে দেয়া যাবে নিমিশে । এই ধরনের চিন্তা গুলো যেন তাদেরকে বিপন্ন না করে তুলে, সকল কিছু বিনষ্ট না হয় সেই জন্য তাঁরা জোট বাধতে থাকে নিজেদের মধ্যে নেতৃত্ব গড়ে তুলে । এই ভাবে সৃজন হয় শ্রম জীবী কর্মজীবী মানুষের আন্দোলন।

এটা কোন এমন “আন্দোলন” নয় যা সাধারন মানুষের জীবন বিপদাপন্ন করে দেয়, মনস্তাত্ত্বিকভাবে সংকির্ন মানসিকতা নয় সাহসী উচ্চারনে কথা বলার সুযোগ তৈরি করার প্রায়সঃ এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলা যাবে, নিজেদের দাবী দাওয়া নিয়ে আলোচনা করা যাবে । শ্রমিক শ্রেনীর জীবন ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে তার জীবন যাত্রা আরো উন্নত করতে, আরো মানবিক করে তুলতে সকলেই জোট বাঁধার উদ্যোগ নেয়া হয়। মজুরী দাসত্বের অবসানের প্রস্তাব আসে আঠার শতকের মাঝামাঝিতে, পরবর্তীতে পুঁজিবাদের সমূল বিলুপ্তির প্রস্তাব ও দাবী জোরদার করা হয়, লক্ষ্যই ছিলো সকলের জীবন যাত্রার মান উন্নত করা একটি সাম্যবাদি নয়া সমাজ বিনির্মান করা।

১৩৫০ সালে ইংল্যান্ডে আইন অনুসারে শিক্ষানবিশদের মজুরী রাষ্ট্র  ঘণ্টা অনুসারে নির্ধারন করে দিত। সেই সময়ে কুটির শিল্পের যে সম্মিলিত সমিতি ছিলো তা উৎপাদন বা কাজের পরিমাণ নির্ধারন করে বেতন দিত। কিন্তু যখন পুঁজিবাদের বিকাশ হলো এবং ম্যানুফ্যাকচারিং ব্যবস্থার উন্নয়ন হলো তখন শ্রমিক সংগঠন সমূহের জন্ম হতে থাকায় নয়া পরিস্থিতি অনুসারে সিদ্বান্ত  নিতে হয় । নয়া সময়ে উদ্ভাবিত শ্রমিক সংগঠন সমূহের নানা পশ্চাতপদ সিদ্বান্ত ও মালিকদের প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্বিতা করে পরিস্থিতি বদল করার জন্য উদ্যোগী হয় উঠে । ১৭৯৯-১৮০০ সালে তথাকথিত সম্মিলিত সমন্বয় আইন পাশ করে পার্লামেন্ট।  এটা সকল প্রকার সমন্বয়ের পথ বন্দ্ব করে দেয়, মুজুরীর পরিবর্ধন, কর্ম পরিবেশ উন্নয়ন এবং শ্রমিকদের উপর যখন তখন যে শাস্তির বিধান ছিলো তা পরিবর্তনের সরল পথটি রুদ্ব করে দেয় সেই কালো আইন।

এই ভাবে শর্তহীন ভাবে শ্রম শোষণের জন্য পুঁজিবাদকে সুযোগ করে দেয়া হয় । শ্রমিকদের সামনে তখন একমাত্র পথ হল হয় আইন মেনে চলবেন, নয়ত এই আইন অমান্য করে দাসত্বের পথ পরিহার করে মুক্ত মানুষের পথে এগিয়ে যাবেন। এই ধরনের দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি একজন সাহসী শ্রমিকের জন্য কঠিন কাজ নয়, তার অভাব ও দারিদ্রতা এর জন্য কোন সমস্যা নয়। তাঁরা মানুষকে অপমান করে বেইজ্জতী করে এমন আইনকে উপেক্ষা করতে কুন্ঠিত হয়না । শ্রমিক শ্রেনী তাঁদের লক্ষ্য অর্জনে সকল প্রকার চেষ্টা করতে থাকে। আধুনিক শ্রমিক সংগঠন সমূহ স্থানীয় ভাবে কাজ শুরু করে, প্রাথমিকভাবে এঁরা স্ব স্ব কারখানায় নিজেদের সংগঠন তৈরি করে। তাঁরা প্রচলিত নিপিড়ক আইন কানুনের বিরুদ্বে কথা বলা শুরু করে, তাঁরা তাঁদের মত আরো যারা নিপীড়ন ও শোষণের শিকার তাঁদের সাথে যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপন করে, তাঁদের সকলকে নিয়ে সামগ্রীকভাবে মানব মুক্তির পথকে প্রসারিত করতে প্রলেতারিয়েত আন্দোলনকে জোরদার করে।

শ্রমিক আন্দোলনের ভেতরে আরো একটি ভিন্ন শ্রুত গোপনে ঘনিভূত হতে থাকে, যারা ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসীমূলক কাজে জড়িত ছিলো, ছোট বড় গ্রুপে এঁরা গোপনে প্রতিজ্ঞা করে পরস্পরকে সহায়তা করবে। ইংল্যান্ডের স্কটল্যান্ডের নানা স্থানে তাঁদের গোপন শাখা প্রশাখা চড়িয়ে পড়ে, এই গ্রুপটি নিয়োগ কারীদের উপর  এবং যারা শ্রমিকদের উপর নানা ভাবে নিপীড়ন নির্যাতন করে তাঁদের উপর ছড়াও হতে থাকে।  এই সকল কর্ম কান্ডের কারনে শ্রমিক আন্দোলন একটি সন্ত্রাসী রূপ পেতে থাকে। ফলে উৎপাদনে ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক আস্থিরতা দেখা দেয়, তখন একদিকে চলে আইনের আশ্রয়ে বিচার আচার অন্যদিকে কতিপয় শ্রমিকের জীবন যাত্রার উন্নয়নের জন্য মালিক পক্ষ্য উদ্যোগী হয়। আইনের এমন কড়াকড়ি আরূপ করা হলে যে কোন আইনের বিধান একটু এদিক সেদিক হলেই শ্রমিকদের উপর নেমে আসে কঠিন শাস্তির খড়গ। সেই সময়েই অর্থাৎ ১৮২৪ সালে ট্রেড ইউনিয়ন সমূহ আইনী স্বীকৃতি পায়। শ্রমিকদের পক্ষে কোন প্রকার মামলা গ্রহন করা হত না, সচেতন ভাবেই শ্রেনী স্বার্থে বিচারকগন মালিক পক্ষে কাজ করতে থাকেন সেই সময়ে, ছোট ছোট আপরাধে শ্রমিকদেরকে বিপুল  পরিমানে  এমন কি শত শত বছর পর্যন্ত সাজা দিতে থাকে আদালত সমূহ। যা ছিলো মানব ইতিহাসে শিক্ষিত মানুষের জন্য কলঙ্কজন অধ্যায়।

১৮১২ সালে গ্লাসগোতে গোপন শ্রমিক সংগঠন একটি সাধারন ধর্মঘট পালনের ডাক দেয়। পরের বছরে ও উত্তর ইংল্যান্ডে হরতাল ও  অস্থিরতা বৃদ্বি পায়, এবং চূরান্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য শ্রমিকগন ১৮১৮ সালে ল্যাংকশায়ারে একটি ব্যাপক ধর্মঘটের ডাকদেয়। তাদের দাবি ছিলো শ্রমিকদের বেতন বৃদ্বি, ফ্যাক্টরী সমূহে কাজের সুন্দর পরিবেশ, নারী ও শিশুদের জন্য ভালো পরিবেশ এবং সুরক্ষার ব্যবস্থার করা। একেই বছরে স্কটল্যান্ডের শ্রমিকগন ও একটি বিশাল ধর্মঘটের ডাকদেয় যার পেছনে ছিলো গোপন শ্রমিক সংগঠন।  একেই সময়ে স্কটল্যান্ডের  বস্ত্র শ্রমিক সংগঠন গুলো বিভিন্ন সময়ে তাঁদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কারখানা বন্দ্ব রেখেছেন। সেই ধর্মঘট গুলো কোন কোন সময় সহিংস রূপ ও ধারন করেছে, ভেঙ্গে ফেলেছে সম্পদ ও সরকারী অফিস আদালত। এর প্রধান কারন ছিলো সরকার যখন তখন শ্রমিকদের দমনের জন্য সেনাবাহিনী বা আদা সামরিক বাহিনী প্রেরন করে শ্রমিক শ্রেনীর উপর অকথ্য নিপীড়ন চালাত।

ইংল্যান্ডের মত, পরবর্তীতে দুনিয়ার অন্যান্য দেশে ও শ্রমিকগন তাঁদের স্বার্থে আন্দোলন সংগ্রামের পথ বেচে নেয়, তাঁরা ও সকল ক্ষেত্রে নিজেদের স্বীকৃতি দাবি করে, যদি ও এখনো তাঁদের দাবীর অনেক কিছুই  পুরন হয় নাই। ১৯৬৯ সালের সূচনা লগ্নে যন্ত্রপাতির সুরক্ষার জন্য অনেক আইন করা হয়েছে; কিন্তু পরবর্তীতে, যখন স্টীম ইঞ্জিন আবিস্কার হয় তখন নয়া আইনের দরকার হয়, আর তৈরি হতে থাকে নয়া নয়া মেশিন পত্র, বিশেষ করে বস্ত্র শিল্পের মেশিনে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। তার ক্ষতিকর প্রভাব ও পরে শ্রমিকদের উপর অনেকেই তখন কাজ হারাতে থাকেন, মেশিন তাঁদের দৈনিন্দিন জীবন প্রায় ধ্বংস করে দেয় । এই সময় কালটিকে বলা হয় তথাকথিত লুডিজম। ১৮১১ সালে, প্রায় দুইশত কাপড় বুনন মেশিন নটিঙ্ঘ্যামে ভেঙ্গে ফেলা হয়, আর্নল্ডে মজুত থাকা বুনন মেশিন ও ভেঙ্গে ফেলা হয়, প্রতিটি মেশিন চল্লিশ পাউন্ডে কেনা ছিলো, শ্রমিকদের মাঝে নানা কারনে প্রতিবাদ ও অস্থিরতা থাকা সত্ত্বেও ষাটটি মেশিন স্থাপন করা হয়। এই ধরনের পদক্ষেপ সকল শিল্পাঞ্চলেই চলতে থাকে ।

আইন শৃংখলা রক্ষার প্রয়োজন বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর প্রয়োজন, কারখানা ব্যবস্থাপক ও সরকারের মধ্যে চলতে থাকে বুঝাপড়া, বাস্তব পরিস্থিতি বুঝার কোন মনোভাব এঁদের ছিলোনা এবং শ্রমিকদের প্রতি তাঁদের কোন প্রকার সহানুভূতি ছিলো না । কিং লুড্ড (১) শিল্পা এলাকায় তার ব্যাপক প্রভাব বলয় সৃষ্টি করে, সে কোন আইন সৃংখলার তোয়াক্কা করত না। তার কথা ছিলো, “ সাহস থাকলে  থামাও ! কেহ পাড়লে  থামাও”! গোপন শ্রমিক গ্রুপের এই ঘোষনা ছিলো। নয়া মেশিন তাঁরা ভেঙ্গে দিলো, বুঝাতে চাইল এভেবে যা খুশি চলতে পারেনা । প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য মানুষের ও মূল্য আছে । তবে তাঁরা তাৎক্ষনিক ভাবে তেমন কিছু করতে পারেনি। মালিক ও সরকার জোট বেঁধে দমন মূলক পথ বেচে নেয় ।

১৮১২ সালে পার্লিয়াম্যান্টে আইন করে দেয়া হল যে কোন শ্রমিক যদি কোন মেশিন নষ্ট করে ফেলে তবে তার শাস্তি হবে মৃত্যদণ্ড । সেই সময়ে লর্ড বায়রন বিতর্কিত এই কালা কানুনের তিব্র নিন্দাবাদ করে সরকারে সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, এই আইনের মাধ্যমে আদলনগৃহ গুলো  বারজন বিচারকের কসাই খানায় পরিণত হবে। (২)

সরকারী ভাবে আন্দোলনরত আত্মগোপন কারী শ্রমিক নেতাদের মাথার মূল্য চল্লিশ হাজার পাউন্ড করে ঘোষণা করে বসে।  ১৮১৩ সালে ১৮জন শ্রমিককে কারখানার সামনে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে মালিক পক্ষ, এবং শত শত শ্রমিককে নির্বাসন দেয়া হল আস্ট্রেলিয়ায়। এই সকল নির্মম কাজ করা  হয়েছিলো লুড্ডিজম নিয়ন্ত্রনের  নামে । কিন্তু আন্দোলন তিব্রতর হতেই থাকে, ফলে বড় বড় ব্যবসায় দেখা দেয় অচল অবস্থার, অন্যদিকে দেখা দেয় নিপোলিয়ানের যুদ্ব। সৈনিক, মাঝি,ও বেকার লোকেরা তখন ঐক্য গড়ে তুলে । এই পরিস্থিতিতে শস্য উৎপাদন কমে যায়, তার উপর সরকার আইন করে শস্য আইন-১৮১৫, ফলে খাদ্য শস্যের দাম ব্যাপক হারে বেড়ে যায়।

কিন্তু আধুনিক শ্রমিক আন্দোলনের প্রাথমিক স্তরে একটি বিরাট অংশ সহিংস হলে ও এঁদের অনেকেই প্রকৃত বিপ্লবী চিন্তার ধারক ছিলেন না । তাঁরা সেই সময়ে বুঝেতে পারেন নাই, প্রচলিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার আসল সমস্য কোথায় নিহিত আছে, আর এই পরিস্থিতি পাল্টাতে চাইলে দরকার হল সমাজবাদের । সহিংসতার পরিনামে নেমে আসবে নির্মম সহিংসতা, যা শ্রমিক শ্রেনীর উপরই আপতিত হবে।  নতুন ভাবে গড়ে উঠা আন্দোলনের পদ্বতীতে পুঁজিবাদের উচ্ছেদ, শোষনের নীতিমালার বিরুদ্বে সুনির্দিস্ট কর্মসূচী ছিলো না । শ্রমজীবী মানুষের জন্য একটি মান সম্পন্ন জীবন যাত্রার রূপকল্প তাঁদের সামনে পরিস্কার ছিলোনা । তাঁদের শ্লোগান ছিল, “ একটি সুন্দর দিনের জন্য একটি সুন্দর কাজ”। কিন্তু যখন শ্রমিকগন নিয়োগকারীগন নানা নির্মমতার মাধ্যমে শ্রমিকদের কষ্ট দিতে থাকে, তখন বাধ্য হয়েই শ্রমজীবী লোকেরা তাঁদের সাধ্যমত বাচার উপায় খোঁজে নেয় ।

ঐতিহাসিক মহান এই আন্দোলনে প্রথমিক ভাবে মানুষের সামাজিক চলমান নূন্যতম চাহিদা গুলো উপস্থাপন করা হয়। এই আন্দোলন ক্রমে সমাজের গভীরে অবস্থিত অর্থনৈতিক অবস্থার সংকটের কারনে মানুষ যে শিল্পাঞ্চলের দিকে দাবিত হচ্ছে সে দিকে ইঙ্গিত করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করে । এটা সামাজিক সচেতনতাকে শানিত করে দেয়। শ্রেনী সংগ্রাম, শ্রমিক শ্রেনীর মধ্যে পারস্পরিক সংহতির গুরুত্ব ইত্যাদি বিষয়ে নিপীড়িত মানুষকে জাগিয়ে তুলে। এই আন্দোলন নিপিরিত, নির্যাতিত ও শোষিত মানুষে্র নয়া স্বপনের জন্ম দেয়, এত দিন যারা শোষক শ্রেনীর সামনে মাথা তুলে কথা বলতে পারত না তাঁরা এখন মানুষ হিসাবে নিজের দাবী উত্থাপনের সুযোগ এনে দিল। এটা শ্রমিক শ্রেনীকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে কথা বলার ও আগামীতে আরো বেশী কিছু করার তাক্বত এনে দেয়। এই আন্দোলন শ্রমিকদেরকে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও লড়াই সংগ্রাম করার প্রশিক্ষন স্বনিয়ন্ত্রন ও সংগঠিত হবার শিক্ষা দেয়। ফলে সামাজিক পরিমণ্ডলে শ্রমিকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি হয় । সামাজিক এই অবস্থানের কারনে পরিস্থিতি এমন হয় যে শ্রমিকদের দুঃখ ও কষ্টের কথা যারা বলেন না তাঁদের ও সামাজিক মূল্য কমে যায়। শ্রমিকদের পক্ষে কথা বললে যে কোন মানুষ সমাজে সমাদৃত হতে শুরু করে ।

সেই সময়ে, ১৮২৪ সালে শ্রমিকদের উপর চেপে বসা সমন্বয় আইন বাতিল করতে বাধ্য হয়, সেই সময়েই মধ্যবিত্ত শ্রেনী ও সরকার শ্রমিকদের উপর নিপীড়ন, নির্যনের পথে না গিয়ে তাদেরকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কাজ আদায়ের চেষ্টা করে, তাঁরা আন্দোলন সংগ্রামকে ভয় পেতে থাকে, পাশাপাশি সারা দুনিয়ার শিল্পাঞ্চল গুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক সংগঠন গড়ে উঠে। আগের তুলনায় অনেক বেশী পারস্পরিক সংহতির মাত্রা বৃদ্বি পায়। ছোট ছোট গ্রুপ মিলে বৃহৎ আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে । প্রতিক্রিয়াশীল সরকার গুলো এই ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাড়াবার মত সাহস দেখায় নাই।

ইংরেজদের দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের পরে ইংল্যান্ডে রাজনৈতিক চরমপন্থার নতুন উত্থান হয়, স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজ শ্রমিক শ্রেণীর উপর এর শক্তিশালী প্রভাব ফেলে। বার্ডেট, হেনরি হান্ট, মেজর কার্টরাইট এবং উইলিয়াম করব্যাটের মত পুরুষ, যার সম্পাদিত পত্রিকা  ‘রাজনৈতিক রেজিস্টারের’ বিক্রি  দ্বিগুণ হয়ে যায়, এর ফলে ৬০ হাজার লোকের সঞ্চালন ঘটে । তিনি নতুন সংস্কার আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রধান ছিলেন। এটি শস্য আইন ও ১৭৯৯-১৮০০ এর সমন্বয় আইন, এবং সর্বাধিক, দুর্নীতিবাজ নির্বাচন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলে। যার মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি বড় অংশকে ফ্রাঞ্চাইজ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে এটি প্রধানত আক্রমণের নির্দেশ দেয়। দেশটির প্রতিটি বিভাগে  সভা সমাবেশে এবং বিশেষ করে শিল্প অধ্যুষিত উত্তরাঞ্চলের  জেলায় বিপুল জনসাধারণের সমাবেশ ঘটে,  সর্ব সাধারনের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।  কিন্তু ক্যাস্টলরিগার অধীন প্রতিক্রিয়াশীল সরকার  যেকোন সংস্কারের বিরোধিতা করেছিল এবং প্রথম থেকেই এটি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখান করেছিল  যেন সংস্কারের প্রক্রিয়াটি কার্যকর করা  না যায়। ১৮১৯ সালের আগস্ট মাসে, ম্যানচেস্টারের পিটারসফিল্ডে ৬০ হাজার লোক ঢুকে সরকারের কাছে গণভোটের দাবীতে সমাবেশ করে। সরকার মিলিশিয়া দ্বারা তাদেরকে বিচ্ছিন্ন  করে দেয় এবং প্রায় ৪০০ জন লোক সেখানে আহত হয় এবং বেশ কয়েক জন শহিদ হন ।

"পিটার্লু" এর গণহত্যার প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বিশেষ অভিযান চালায় যার জন্য সরকার কুখ্যাত ছয়টি কালা  কানুন দিয়ে নিপীড়নের ব্যবস্থা করে, যার ফলে সমাবেশের স্বাধীনতা এবং প্রেসের স্বাধীনতা স্থগিত করা হয়েছিল এবং সংস্কারকরা কঠোরভাবে  প্রসিকিউশনের সম্মোখিন হন। তথাকথিত "ক্যাটা রাস্তার ষড়যন্ত্র" দ্বারা, যেখানে বলা হয়েছে, আর্থার থিস্টলউড এবং তার সহযোগীরা ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার সদস্যদের হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। সরকার সংস্কার আন্দোলনের বিরুদ্ধে কঠোর ভাবে এগিয়ে যায়।  তবে, ১লা মে, ১৮২০ সালে থিস্টলেউড এবং তার চারজন সংগীকে  ফাঁসি থেকে রক্ষার  জন্য ঘুষ হিসাবে অর্থ প্রদান করলে তা সরকার গ্রহন ও করে : হাবিইস কর্পাস অ্যাক্টকে দুই বছরের জন্য  স্থগিত করা হয়েছিলো, এবং ইংল্যান্ডকে একটি প্রতিক্রিয়াশীল শাসনের  অধীন ঠেলে দেয়া হয় । যা তার নাগরিকদের কোনও অধিকারকে সম্মান করে নাই।

এই সময়  সাময়িক ভাবে আন্দোলন  স্তিমিত হয়ে পড়ে। তারপর ফ্রান্সে ১৮৩০ সালের জুলাই বিপ্লবের ফলে ইংরেজি সংস্কার আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়, যা এ যাবত কাল, একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের উপর পরিচালিত হয়েছিল। সংসদীয় সংস্কারের লড়াই আবার নতুন করে শুরু হয়, কিন্তু বুর্জোয়াদের সংস্কার বিল- ১৮৩২ সাল, পাশ করার পর তাঁরা সন্তুষ্ট হয়।  শ্রমিকদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য তারা মালিক পক্ষের উপর  জয়লাভ করেছে বলে মনে করছিলো, তারা সংস্কারের সমস্ত প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখান করে, কিন্তু  নতুন সংসদ বেশ কয়েকটি প্রতিক্রিয়াশীল আইন প্রণয়ন করে, যার ফলে সংগঠিত শ্রমিকরা আবারও হুমকির মুখে পড়ে। এই নতুন আইনগুলি ছিলো নিপিড়নের  জ্বলন্ত উদাহরণ । ১৮৩৪ সালের  সেই কুখ্যাত দুর্বিষহ আইন, যা ইতিমধ্যেই তৈরি করা হয়েছে। যে আইনের আওতায়  শ্রমিকরা মনে করে যে, তাদেরকে বিক্রি করা হয়েছে এবং তাঁদের সাথে  বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে এবং এই অনুভুতিই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাথে  তাঁদের সম্পর্ক সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়ে যায়।

খ্রিস্টবাদের মধ্যে ও শ্রমজীবী মানুষের জন্য একধরনের সংস্কার মূলক আন্দোলন দানা বাঁধে, এটা সত্য যে বুর্জোয়া দল সমূহ শ্রমিকদের মাঝে একটি সক্রিয় উপাদান দেখতে পায়, তাই তাঁরা এদেরকে ও নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে অনুপ্রানিত হয় । খ্রিষ্টান আন্দোলন সমূহের মধ্যে ছয় দফার আন্দোলনই ছিলো প্রধান যাদের মূল লক্ষ্য ছিলো পার্লামেন্টারী সংস্কার সাধন করা, আবার তাঁরা শ্রমিকদের দাবী দাওয়ার প্রতি ও ছিলো শ্রদ্বাশীল, তবে সামাজিক আমূল পরিবর্তনের জন্য তাঁরা প্রস্তুত ছিলেন না । তাঁদের মধ্যে সেই সময়ে জনপ্রিয় নেতা ছিলেন, জে, আর স্টিভেন্স, তিনি ম্যানচেস্টারে এক জনসভা আহবান করেন, তিনি সেখানে বলেন, আমাদের আন্দোলন কোন রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। আমরা জনসাধারনের দুঃখ কষ্ট লাগবের দাবী করছি। আমরা দাবী করছি, “মানুষের রুটি, রুজির ব্যবস্থা হোক”। মানুষের গৃহ, খাদ্য, সমিতি করার অধিকার, ও শ্রমিকের শ্রমদান সময় কমিয়ে দেবার জন্য।

খ্রিষ্টান আন্দোলন একসময় ইংল্যান্ডের মাটিতে বিপ্লবী হয়ে উঠে, তারা বুর্জোয়া ও শ্রমিক উভয় শ্রেনীর মধ্যে ব্যাপক সারা ফেলে দেয়, তাঁরা বলতে থাকেন যে, দেশে যে কোন সময় গৃহযোদ্ব লেগে যেতে পারে। সেই সময় ব্যাপক হারে চারদিকে সভা-সমাবেশ, মিছিল শ্লোগান চলতে থাকে, কল কাখানায় ধর্মঘট, হরতাল চলতে থাকে। ভীত সন্ত্রস্ত  কারখানার মালিকগন, স্ব স্ব শিল্প কারখানায়  সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলে, “ তাঁদের সম্পদ ও জীবন সুরক্ষার জন্য”। এই পরস্থিতিতে শ্রমিক শ্রেনী ও সশস্ত্র হয়ে উঠে। ১৮৩৯ সালে খ্রিষ্টান নেতাগন সারাদেশের মানুষকে তাঁদের আন্দোলনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য বুঝানোর জন্য বেশ কিছু ভালো বক্তা নির্বাচন করে নানা স্থানে প্রেরন করেন। কেবল বার্মিংহামেই  পাঠায় ১২ জন সুবক্তা। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিলো খ্রিষ্টান পিটিশনে মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করা । তাঁদের সমাবেশ গুলো লোকে লোকারন্য হয়ে উঠে। এতে তাঁরা প্রামান করেন যে তাঁদের আন্দোলনের প্রতি জনগনের ব্যাপক সাড়া দিয়েছে।

খ্রিস্টানদের এই আন্দোলনে অনেক বুদ্বিজীবী ও সুবক্তা ছিলেন, এমনকি অনেক ত্যাগী ও সৎ লোক  সেই সময় আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন ( যেমন- উইলিয়াম লাভেল, ফিরাজু কর্নার, ব্রান্টিয়ার, ও বেরিন, জে আর স্টিফেন্স, হেনরী হিটারিংটন, জেমস ওয়েস্টন, হেনরি ভিনসেন্ট প্রমুখ।)  এই আন্দোলনের নির্দেশনা, গনমাধ্যমে ব্যাপক ঝড় তুলে সেই সময়। দি পোর ম্যান্স গার্ডিয়ান, এবং নর্দান স্টার সামাজিক প্রভাব বলয়  তৈরিতে ভূমিকা রাখে । সত্যিকার অর্থে খ্রিস্টবাদের সত্যিকার কোন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিলো না, তবে তাঁরা সামাজিক অশান্তি দূরী করনের জন্য কিছু সুদূরপসারী প্রস্তাবনা হাজির করেন । চার্টিস্টদের সময়ে সমাজবাদিরা খ্রিস্টবাদের এই  কর্মকান্ডকে প্রচণ্ড ভাবে নাকচ করে দেয়, তাঁরা সেই আন্দোলনের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে। কিন্তু এর পর ও উইলিয়াম থমসন, জনগ্যারি, এবং বিশেষ করে রবার্ট অয়েনের চিন্তাধারা ইংরেজ শ্রমজীবী মানুষের মাঝে ব্যাপক সারা ফেলে দেয় ।

ফ্রান্স, বেলজিয়াম এবং রাইন দেশ সমূহে  এবং যে মহাদেশে প্রথম শিল্প পুঁজিবাদের জন্ম হয়, যা পরবর্তী সময়ে অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে, সেই পরিস্থিতিতে বাস্তব প্রয়োজনেই আধুনিক শ্রমিক আন্দোলনের উন্মেষ ঘটে এবং সেই আন্দোলন প্রতিটি দেশে প্রাথমিক অবস্থা থেকে ক্রমে  আন্দোলন কারীদের অভিজ্ঞতা ও উপলব্দির সাথে আন্দোলন ও পরিপূর্নতা অর্জন করে । নয়া সমাজিক ব্যবস্থার দাবী উত্থাপিত হয়। শ্রমিকদের ঐক্য ও সমাজবাদি লোক উভয়ের বক্তব্য একেই ছিলো । কিন্তু তা রাজনৈতিক ধ্যানধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। ফলে প্রতিটি সমাজবাদি তত্ত্বের ধারায় নিজনিজ মতবাদ অনুসারে চলমান ও ভবিষ্যৎ আন্দোলনের গতিমূখ নির্ধারন করে দেয় ।

এমন একটি সময় ছিলো যখন কিছু সমাজবাদি আন্দোলন শ্রমিক শ্রেনীর আন্দোলনের তেমন কোন প্রকার গুরুত্বই দিত না, তাঁরা তাঁদের আন্দোলন সংগ্রামের প্রতি কোন সংহতি এবং প্রয়োজন ও অনুভব করত না । তাঁরা মনে করত শ্রমিকগন এখন যা করছে তা তাঁদের কেবল দৈনিন্দিন কাজ ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা তাঁদের বেঁচে থাকার  লড়াই মাত্র। তাই, তাঁদের অনেকেই মনে করলেন যে, শ্রমিকদেরকে বুঝানো দরকার তাঁদের লড়াইয়ে আশু লক্ষ্য হওয়া উচিৎ সমাজবাদ । সেই লড়াই সংগ্রামের জন্য, আরো জোড়দার সংগ্রাম তৈরি করা দরকার । তাদেরকে বুঝানো দরকার  এবং এটা  গভীর ভাবে উপলব্দি করতে হবে যে মজুরী দাসত্ব রেখে সামগ্রীক মুক্তি কোন দিন আসবে না । তবে এটা সত্য যে যদি ও দৈনিন্দিন দাবী দাওয়া নিয়ে শ্রমিকগন আন্দোলন সংগ্রাম করেন তবে তা গুরুত্বহীন নয়, এর মধ্যে ও বৃহৎ আন্দোলন সংগ্রামের বীজ নিহিত থাকে। তবে সেই আন্দোলন সংগ্রামে দরকার হল নয়া লক্ষ্য নির্ধারন করা । বাস্তবতা থেকে অনেক কিছু নির্গত হতে পারে। একটি শূন্য খালি স্বপ্ন থেকে নয়া দুনিয়ার জন্ম হবে না, কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে রুটি রুজির যে সংগ্রাম, শ্রেনী বৈষম্যের বিরুদ্বে যে লড়াই তা থেকে উন্মেষ ঘটবে এক বৈপ্লবিক মহা সংগ্রামের । যে সংগ্রাম নয়া সমাজ, নয়া জীবন একজন শ্রমিক ও কর্মজীবী মানুষকে উপহার দিবে ।

নিয়োগ কর্তা ও তাঁদের সহযোগীদের বিরুদ্বে যে প্রতিদিনের সংগ্রাম, তার ভেতর দিয়েই একজন শ্রমিক ক্রমশ লড়াই সংগ্রামের মৌলিক বিষয়াদি উপলব্দি করতে সক্ষম হবে। প্রাথমিক ভাবে একজন শ্রমিক তাঁদের তাৎক্ষনিক দরকারী বিষয় গুলো যা প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতিতে গ্রহন যোগ্য তা প্রকাশ করবে, পরে ক্রমশ অর্থনৈতিক একচাটিয়াবাদের বিষ চক্রের বিরুদ্বে এবং প্রচলিত সমাজের অসংগতি সমূহ নিয়ে কথা বলবে।  তাত্ত্বিক আলোচনার চেয়ে প্রতিদিনের লড়াই সংগ্রাম সত্যিকার শিক্ষার জন্য একটি বড় ও কার্যকরী অস্ত্র।

সামন্তবাদের আমলে সামন্ত প্রভূদের অধীনস্থ কৃষকগন ক্রমাগত বিদ্রোহ বিক্ষোভ করাতে থাকে। ফলে সামন্ত প্রভূদের মাঝে ও এই চিন্তার উদ্রেক হয় যে প্রচলিত ব্যবস্থায় দির্ঘ কাল আর ঠিকে থাকা যাবে না, তাই চাষি মজুর শ্রেনীর জীবন যাত্রায় পরিবর্তন না করলে একটি মহা বিপ্লবের সূচনা হতে পারে। ফলে বর্তমান ব্যবস্থাটাই ভেঙ্গে পড়তে পারে। তাই পুঁজিবাদী সমাজে এখন যে পরিমাণ শ্রমিক সমাবেশ ঘটেছে, তাঁরা সামাজিক বিপ্লবের সূচনা করতে সক্ষম, সমাজবাদ এখন একটি জীবন্ত বাস্তবতা হিসাবে দেখা দিয়েছে। কৃষক বিদ্রোহ ছাড়া ও ফ্রান্সের বাস্তিলে প্রায় পাঁচ শত বিদ্রোহের রিপোর্ট করেন টেইনী ১৭৮১ সালে। এই ধারনা সকল জায়গায় স্বাধীনতাকামী মানুষ সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

সারা দুনিয়াময় এই রকমের এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি পেছনে কেবল আধুনিক শ্রমিক শ্রেনীর আন্দোলনই প্রধান নিয়ামক হিসাবে কাজ করে । এটা বলা সমীচীন নয় যে শ্রমিকদের বস্তুগত বা তাঁদের মানসিক পরিস্থিতির কারনেই এমনটি করতে সক্ষম হয়েছে। পুঁজি ও শ্রমের যে দ্বন্দ্ব তা কেবল কিছু ব্যাক্তির মনে জন্ম নিয়েছিলো, সেই চিন্তার সাথে শ্রমিকদের আন্দোলন সংগ্রাম যুক্ত হয়ে এতে রক্ত মাংশের মিলন ঘটায়। শুধু তাই নয়, এটা একটি নয়া সমাজ ব্যবস্থা ও আগামীদিনের সাংস্কৃতিক কাঠামোর প্রক্রিয়া জোরদার করে।  উন্মোচন করে এক নয়া দিগন্তের।

নোটঃ

১। সত্যিকার ভাবে কেহই এই শব্দটির অর্থ জানেনা । কেহ কেহ বলেন এটা নিড লুড্ড র নাম। কিন্তু এর কোন ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা নেই। কোন কোন জায়গায় এটাকে বলে, “জেক সুইং” এবং “গ্রেট এঙ্কো” কিন্তু এ সব কিছু অর্থ একেই দাঁড়ায় ।

২। লর্ড বায়রন লুড্ডিতের প্রতি প্রচণ্ড সহানুভুতি প্রকাশ করে কবিতা লিখেন, যার প্রথম কয়েকটি লাইন এইরূপঃ

“ সামগ্রীক স্বাধীনতা কেবল সমূদ্রের উপর

অকাতরে রক্তদিয়ে স্বাধীনতা এলো

তাই আমরা, বালকেরা আমরাই

স্বাধীন ভাবে বাঁচার লড়াই করব, নইলে মরব

সকল রাজা নিপাত যাক, বেঁচে থাকুক রাজা লুড্ডি!”

ভাষান্তরঃ এ কে এম শিহাব


Share Tweet Send
0 Comments
Loading...
You've successfully subscribed to Bangladesh ASF
Great! Next, complete checkout for full access to Bangladesh ASF
Welcome back! You've successfully signed in
Success! Your account is fully activated, you now have access to all content.