রুডলফ রকারের এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমঃ তত্ত্ব ও অনুশীলন - অধ্যায়ঃ পঞ্চম এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের পদ্বতী ( প্রথম অংশ)

রুডলফ রকারের এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমঃ তত্ত্ব ও অনুশীলন  - অধ্যায়ঃ পঞ্চম এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের পদ্বতী  ( প্রথম অংশ)

ভাষান্তরঃ এ কে এম শিহাব

এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের বিরুদ্বে অভিযোগ তুলা হয় যে, এটার কোন রাজনৈতিক কাঠামো নেই, ফলে স্বাভাবিকভাবেই এর রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামের ও আগ্রহ নেই, এটা কেবল অর্থনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামে নিয়োজিত থাকতে চায়। এই ধরনের অভিযোগ আসে মুলত সেই সকল লোকদের নিকট থেকে যারা আমাদের আদর্শ সম্পর্কে সাম্যক জ্ঞান রাখেন না বা ইচ্ছাকৃত ভাবে আমাদের বক্তব্যকে বিকৃত করে মানুষের সামনে হাজির করেন ।  এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের সংগ্রাম প্রচলিত শ্রমিক দল সমূহের মত নয়, এটার কাজের নীতি-কৌশল ও পদ্বতী একরকমের নয়, এমন কি লক্ষ্য ও ভিন্ন। এটার আসল লক্ষ্যই হলো এমন একটি সমাজের ভিত্তি স্থাপন করা যেখানে মানুষের উপর মানুষের কোন প্রকার প্রভূত্ব বিরাজ করবে না । এটার আসল উদ্দেশ্য হলো, এখন রাষ্ট্রীয় শাসনের নামে যে সকল কার্যক্রম করা হয় তা বন্দ্ব করা, সমাজকে সত্যিকার স্বাধীন ভাবে কর্ম সম্পাদনের পরিবেশ সৃজন করে দেয়া । আধুনিক সমাজে একটি শ্রমিক দল যে সকল কাজ করে এনার্কো- সিন্ডিক্যালিজম সম্পূর্নভাবে এর বিপরীত কাজ করছে, শ্রমিক দল রাজনৈতিক ক্ষমতাবলয় সৃজন করতে ব্যাস্ত, অর্থনৈতিক-সামাজিক জীবনে নিজেদের প্রতিপত্তি শক্ত করার জন্য কাজ করছেন, পুঁজিবাদী সমাজের বিপরীতে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে চাইছে। অথচ এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম সম্পূর্ন ভিন্ন মাত্রায় কাজ করে সত্যিকার সমাজবাদ কায়েম করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ।

রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কে এবং প্রচলিত রাষ্ট্র কাঠামো সম্পর্কে এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের দৃষ্টিভঙ্গী  হলো এই গুলো পুঁজিবাদী শোষণ প্রক্রিয়ারই  নামান্তর। এটা সামাজিক শোষণ ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সম্পূর্ন ওয়াকিব হাল। কিন্ত এটার লক্ষ্য হলো প্রচলিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিলয় সাধন করে সমাজবাদি ব্যবস্থার প্রবর্তন করা। এনার্কো সিন্ডিক্যালিস্ট গন এক মুহুর্তের জন্য ও ভুলে যেতে চান না যে, বর্তমান সমাজ কাঠামো সম্পূর্ন ভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ফল, এটা মুনাফার ভিত্তিতে পরিচালিত। উৎপাদক  ও পন্য সৃজনকারী শ্রেনী সর্বদা শোষিত হয় যেখানে । তার বদল না করে উৎপাদক শ্রেনীর মুক্তির আশা করে কোন লাভ নেই।

এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম চায়  রাষ্ট্র থেকে উদ্ভুত সকল প্রকার রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্বে লড়াই করে তার অপসারণ করতে। এটা বিশ্বাস করে রাষ্ট্র হলো পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একচাটিয়াবাদের ফলাফল, সামাজিক শ্রেনী বিন্যাস হয়েছে সামাজিক কারনেই, রাজনৈতিক শক্তি শ্রেনী ঠিকিয়ে রাখার জন্য ও নিপিড়ন জিয়ে রাখার জন্য রাজনীতি একটি অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে শোষণ হলো রাজনীতির একটি সুরক্ষা মূলক কাজ, রাষ্ট্র বিলুপ্ত করে জনগণের স্বেচ্ছাকৃত চুক্তির মাধ্যমে প্রশাসন পরিচালনা করলে, সামাজিক রাজনৈতিক অধিকার খুব সহজেই সুরক্ষিত হতে পারে। এটা লংগীত  হবার মত কোন পরিবেশই বিরাজ করবে না।

একজন শ্রমিক তার সামাজিক জীবনে অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে যেমন উদাসিন থাকতে পারেন না, তেমনি রাজনৈতিক অবস্থা ও ভূলে থাকতে পারেন না । সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার জন্য, দৈনিন্দিন রুটি রুজির জন্য তাকে লড়াই করতেই হয়, সামাজিক স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক মুক্তির জন্য তাকে  সংগ্রামে লিপ্ত থাকতে হয়। তাই, এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের কথা হলো, সকল সময়ে রাজনৈতিক সংগ্রাম নিয়ে আগ্রহী হবার খুব দরকার নেই। আমরা স্পেনে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্বে সি এন টির বীরোচিত ভূমিকা দেখেছি। সম্ভবত এটা দুনিয়ার সামনে একটি বড় উদাহরন হয়ে আছে।

রাজনৈতিক আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তু রাস্ট্রের আইন সভা বা অন্য কোন বিভাগ হতে পারেনা, তবে তা হতে পারে সাধারন জনগনের মাঝে আদর্শ ভিত্তি বিনির্মান। রাজনৈতিক অধিকার সত্যিকার অর্থে পার্লাম্যান্টে জন্মে না; তা জন্মে এর বাইরে জনগণের মধ্যে। এমনকি তাদের প্রনিত আইন ও জনগণের নিরাপত্তা দিতে পারেনা। নিয়োগ কর্তাগন সকল সময়ই তাদের সুবিধামত আইন রদবদল করে থাকে যখন তখন। সেই সময় গুলোতে শ্রমিক দল গুলোতে কোন না কোন প্রকারের দূর্বলতা প্রকাশ পায়। ফলে সময় উপযোগী পদক্ষেপ গ্রহন করতে পারেনা । সরকার গুলি যখনই বুঝতে পারে যে জনগণের ভেতর থেকে কোন প্রকার প্রতিরোধ হবে না তখন তারা স্বৈরাচারী হয়ে উঠে বা ইচ্ছেমত আইন ও বিধি বিধান প্রনয়ন করে থাকে ।  আর তখনই শৃংখলিত হয়ে পড়ে মানুষের স্বাধীনতা । এমন কি আমাদের দেশ সমূহে গনমাধ্যমের স্বাধীনতা ও হরন করা হয়। সমাবেশের স্বাধীনতা, সংক্ষুব্ধ হবার অধিকার সঙ্কুচিত করে ফেলে। আইন শৃংখলা বাহিনীর মাধ্যমে পরিবেশ পরিস্থিতিকে কঠোর নিয়ন্ত্রনে রেখে মানুষের স্বাভাবিক আচরনকে আইনের নামে অবদমন করা হয়।  প্রকৃত পক্ষে রাজনৈতিক অধিকার তো থাকেই না, কেননা এই গুলি থাকে কেবল মাত্র কাগজে কলমে । কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে মানুষের রক্ত মাংশে স্বাধীকারের বীজ নিহিত আছে, তবে যখন তাদেরকে সেই বিষয়ে উজ্জিবীত করা হয় তখন অনেক ক্ষেত্রে তাদের প্রতিরোধ হয় সহিংস। কোথাও যদি উজ্জিবীত হবার মত পরিস্থিতি না করা হয় তবে এরা প্ল্যাটনিক মানুষের মত গোলামীর জিঞ্জির ছিড়তে পারেনা। মানুষ একে অন্যকে সম্মান করবেন তবে এর সাথে সাথে নিজের সম্মান- মর্যাদা রক্ষার শিক্ষাও থাকা দরকার। এটা কেবল ব্যাক্তি জীবনে নয়, এটা সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে অনুসরন করা দরকার।

বর্তমান সময় কালে আমরা কম বেশী যে সকল রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা সমূহ পেয়ে থাকি তা কিন্তু রাস্ট্রের স্বেচ্ছাকৃত শুভ কামনার ফল নয়, তা হলো জনগণের আদায় করা অধিকার সমূহ। সরকার তার ক্ষমতা বলে নানা স্তরে এমন কিছু ব্যাক্তি বা প্রতিস্টান নিয়োগ করে রাখে যাদের কাজই হলো জনগণের আকাংখার প্রতিরোধ করা। তাই কখনো কখনো এমন অবস্থার তৈরী হয় যখন গনমানুষের ব্যাপক ভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তুলা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না । এমন কি প্রয়োজন হয়ে পড়ে  অভ্যুত্থানের । তাই দরকার হল  কম পক্ষে বিগত তিন শত বছরের ইতিহাস অধ্যয়নের। যাতে বর্তমানকে সঠিক ভাবে বুঝা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন এবং অন্যান্য দেশের শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের অধিকার আদায় করার জন্য তাদের সরকারকে বাধ্য করার জন্য কঠোর সংগ্রাম করেছিলেন। ফ্রান্সে ট্রেড ইউনিয়নের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। যদি শ্রমিকদের অবিরাম সংগ্রাম না চলত তবে হয়ত আজও ফরাসি  দেশের মানুষের জন্য কোন অধিকার কায়েম হত না।  শ্রমিকগন ডাইরেক্ট একশন কর্মসূচীর মাধ্যমেই পার্লামেন্টের সাথে বুঝা পড়ায় লিপ্ত হয়, ফলে সরকার বাধ্য হয় শ্রমিকদের অধিকার সহ ট্রেড ইউনিয়নের স্বীকৃতি দিতে। জনগনের জন্য সরকার কি কি সিদ্বান্ত গ্রহন করেছেন সেটা গুরুত্বপূর্ন নয়, বরং জনগণ কি কি আদায় করতে পেরেছেন সেটাই আসল কথা। যারা এই সত্যটি বুঝতে চায় না তারাই ইতিহাসের অন্দ্বকার গলিতে হাতড়ে মরছেন।

অবশ্য কেহ যদি লেনিনের কথাকে সহি মনে করেন যে, স্বাধীনতা হলো “বুর্জোয়া কুসংস্কার” তবে বলতে হয় শ্রমিকদের স্বাধীকার ও রাজনৈতিক অধিকারের কোন মূল্য নেই। কিন্তু আমরা অতীতের অগনিত বঞ্চিত মানুষের  লড়াই সংগ্রামের যথাযথ মূল্যায়ন করে থাকি। লেনিন তার বিচক্ষণতা বা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য জারের পতন ঘটানোর জন্য শ্রমিক ও জনগণের প্রতি আহবান করেছিলেন। জার সরকারের শত বাঁধা সত্ত্বে ও “বুর্জোয়া কুসংস্কারের” লক্ষ্যে তিনি তার ঘোষনায় অটল ছিলেন।

তবে এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম শেষ বারের মত করেই শ্রমিকদেরকে সাথে নিয়ে এই ধরনের একটি কাজ করবে। শ্রমিকগন বর্জোয়া পার্লামেন্টের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করতে আগ্রহী নয়। কেননা তারা রাজনৈতিক কার্যক্রমের প্রতি আগ্রহী নয়। তারা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেন যে, পার্লামেন্টারী রাজনীতি সত্যিকার ভাবে শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষন করে না ।  পার্লামেন্টে যারা থাকেন তারা নিয়োগকারী মুনাফা অর্জনকারী লোকদের স্বার্থে কাজ করেন। শ্রমিক সংগঠনের স্বার্থের চেয়ে মালিক পক্ষের স্বার্থ বেশী দেখেন তারা। আইন ও বিধি প্রনয়নের ক্ষেত্রে ও এর প্রতিফলন দেখা যায় । প্রচলিত রাজনীতিতে সকলের স্বার্থকে একেই ভাবে বিবেচনায় নিয়ে দল গুলো সেবা দানের জন্য কাজ করছেন । কিন্তু আদতে শ্রমিকদের স্বার্থ ও মালিক পক্ষের স্বার্থ একেবারেই আলাদা বিষয়। চলমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শ্রমিক শ্রেনীর স্বার্থ সংরক্ষন করে না । তা শ্রমিকদেরকে শোষণ করে। শোষনকারীরা সংগঠিত ভাবে আইনী ব্যবস্থার মারপ্যাঁচে শ্রমজিবী মানুষকে নিজেদের সমৃদ্বির সোপানে পরিনত করে থাকে।  এমন কি এখন যে প্রকাশ্য ভোট হয় তাতে ও মালিক শ্রমিকের ব্যবধান বুঝা যায় না । সকলেই একাকার। এই পদ্বতী সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার ও শোষনকে আইনী বৈধতা দিয়ে দেয়। মানুষের উপর মানুষের দাসত্বকে দির্ঘায়িত করছে।

তবে সব থেকে গুরুত্ব পূর্ন বিষয় হলো যে, বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে শ্রমিকদের সংসদীয় কার্যক্রমে অংশ গ্রহন তাদের লড়াই সংগ্রামের শক্তি ও প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল হয়ে পড়ে, অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত ব্যবস্থায় তাদের বিরুধীদের নির্মমতার শিকার হতে হয়। সংসদীয় ব্যবস্থার অধীনে শ্রমিকদের অধীকারের চিটেফোট ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না । এটা অনেক সময় শ্রমিক শ্রেনীর স্বার্থ সংরক্ষনের অন্তরায় হয়ে দেখা দিতে পারে। এই প্রসঙ্গে উদাহরন হিসাবে উল্লেখ্য যে, জার্মানীর বড় শহর প্রুশিয়াতে হিটালারের আগে সামাজিক গণতন্ত্রী দল হিসাবে দেশের বেশ কিছু মন্ত্রনালয় নিয়ন্ত্রন করেছিলো। হেরন ফন পেইন, হিন্দেনবার্গের রিচস্কানজলারের নিয়োগের পর, জমি সংবিধান লঙ্ঘন করে প্রুশীয় মন্ত্রণালয়কে কেবলমাত্র একজন লেফটেন্যান্ট এবং এক ডজন সৈন্যসহ ভর্তি করতে পারত। তখন সাম্যবাদী পার্টি তার চুক্তিগত অসহায়ত্বের কারণে সংবিধানের এই উন্মুক্ত লঙ্ঘনের দায়ে কিছুই করতে পারে না, তখন রাইচ হাইকোর্টের আপীলের ব্যপারে ওপেন প্রতিরোধের জন্য  অভ্যুত্থানকারীকে সহায়তা করার পরিবর্তে বলত যে তারা ভয় পায় । তখন থেকে কিছুই তারা আর করতে পারে না।  এটা সত্য যে, প্যাপেনের অভ্যুত্থানটি মূলত রাস্তার পাশে তৃতীয় রেইচ পর্যন্ত যাত্রা শুরু করেছিল।

এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্ট সকল সময়েই রাজনৈতিক সংগ্রামকে এড়িয়ে চলে, তবে এই কার্যক্রম ও তাদের নিজস্ব ধারার রাজনীতিরই অংশ, তাদের কর্মসূচি ডাইরেক্ট একশন হিসাবে পরিচালিত হয়, শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির জন্য অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের লড়াই সংগ্রামকে সকল সময়েই প্রধান্য দেয়া হয়ে থাকে। শ্রমজীবী মানুষ তাদের মজুরী ভাতা বৃদ্বির আন্দোলনেই দেখতে পান যে পুলিশ, সেনাবাহিনী মালিক পক্ষের পক্ষ নিয়ে শ্রমিকদেরকে ধমকী হুমকী দিয়ে থাকে এবং মালিক ও ধনীক শ্রেনীর স্বার্থ রক্ষার্থে কাজ করে থাকে। আর সেই কারনেই তারা রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ গ্রহনে অনিহা দেখায় । রাজনীতি তাদের জীবনের প্রতিটি ঘটনা প্রবাহকে কোন না কোন ভাবে প্রভাবিত করে ছাড়ে। এই দিক টি বিবেচনায় নিলে দেখা যায় যে, অর্থনৈতিক লড়াই সংগ্রাম যেমন সাধারন ধর্মঘট ও একটি রাজনৈতিক কার্যক্রম। তা ও অনেক ক্ষেত্রে  সংসদীয় রাজনীতির অংশে পরিনত হয়ে থাকে । এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্টদের লড়াই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্বে আপোষহীন ভাবে পরিচালিত হয়, সেনা শাসন ও মানুষের উপর নিপীড়নে বিরুদ্বের স্বাধীন সমাজবাদি ও এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্টগন তাদের সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে । এই সংগ্রামের  জন্য তাদের ত্যাগ তিথিক্ষার ও কোন প্রকার কমতি নেই । সত্য ঘটনা হলো যখনই সমাজবাদি দল সমূহ কোন রাজনৈতিক সংস্কারের পথে এগোতে চায় তখনই তারা নিজেদের শক্তি বৃদ্বির জন্য অর্থনৈতিক লড়াকু শক্তি শমিক শ্রেনীকে সঙ্গে নেবার ফন্দি তৈরী করে । বেলজিয়াম, সুইডেন ও অস্ট্রিয়ায়  রাজনৈতিক ধর্মঘট পালনের জন্য আমরা এর জলন্ত উদাহরন লক্ষ্য করেছি । ১৯০৫ সালে আমরা রাশিয়ায় একেই চিত্র দেখেছি, জার সরকারকে সাংবিধানিক আইনে স্বাক্ষর করাতে  শ্রমিকদের সহযোগিতা নেয়া হয়েছিলো। রাশিয়ার অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও শক্তি সমূহ দশকের পর দশক চেষ্টা করে ও যা পারে নাই । অর্থনৈতিক শক্তির একটি উদ্যোগই তা খুব সহজেই সফল করে দিল ।

রাজনৈতিক দল গুলো প্রায়স দেখা যায় নিজেদের ক্ষমতার উপর তেমন নির্ভর করতে পারে না বরং তারা অর্থনৈতিক শক্তি শ্রমিক শ্রেনীর সংগঠন সমূহের উপর নির্ভরশীল থাকে। এটা এখন এক প্রকার স্বীকৃত বিষয় যে, রাজনৈতিক দল সমূহ বিপ্লবী ইউনিয়নবাদের দিকে ঝুঁকছে, তারা নিজেরা ও সমাজবাদি শিক্ষা নিচ্ছেন, এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার করা্র কলা কৌশল   আত্মস্থ করে নিচ্ছেন । তাদের রনকৌশল হলো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামের জন্য সরাসরি লড়াই করা । আর সত্যিকার কার্যকরী পথই হলো এটি, যখনই ইতিহাসের মোড় পরিবর্তন কারী সময় আসে তখন এই ধরনে পদক্ষেপই কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারে । ইদানিং কালে বুর্জোয়ারা ও এই ধরনের আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে, তারা ও তাদের প্রভাব বলয় কায়েমের জন্য নানা জায়গায় কর না দেয়া,  অসহযোগীতা, বিপ্লব শব্দ ব্যবহার করছে। আজকের তাদের প্রতিনিধিরা তাদের বাপের গল্প ভুলে গিয়েছে, এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামে সংগ্রামরত শ্রমিকদেরকে  হত্যা করেছে। তাই আইন কখনো কখনো কোন শ্রেণীকে তার উপর চাপানো  জোয়াল কেড়ে নেবার অনুমতি দিতেই পারে।

এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্টদের ডাইরেক্ট একশন কর্মসূচি আসলে তাদের বিরুদ্বে চলমান শোষন নিপিড়নের প্রতিবাদের প্রাথমিক পদক্ষেপ। এছাড়া ও তারা আরো যে সকল কার্যক্রম অনুসরন করে থাকেন তা হলোঃ সাধারন ধর্মঘট, কর্ম ক্ষেত্রের নানা স্থরে প্রয়োজনীয় কর্ম বিরতি পালন করা; কর্ম ক্ষেত্র বর্জন;  অনেক ভাবে সাবুটাজ করা, সেনা শাসনের বিরুদ্বে প্রচার, নানা শ্রেনী পেশার মানুষকে সমালোচনায় মুখর করে তুলার ব্যবস্থা করা – এইরূপ কাজ স্পেনে ও করা হয়েছিল। চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে জীবন রক্ষার্থে অস্ত্র ধারন ইত্যাদি আন্দোলনেরই অংশ ।

উক্ত কার্যক্রম গুলোর মধ্যে ধর্মঘট হলো সংগঠিত ভাবে কাজ করতে অস্বীকার করা, এটা খুবই সহজ কর্মসূচি। এটা শিল্প ব্যবস্থায় ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে তবে তা সামন্ত ব্যবস্থায় ও ব্যবহার করা হয়েছে। এই ধরনের কর্মসূচি শ্রমিক মজুরদের জন্য অনুসরন করা ও সহজতর, শ্রমিকদের জীবন মান উন্নয়নের জন্য নিয়োগ কর্তাদের সাথে দরকষাকষির জন্য এমন কি তাদের উচ্ছেদের জন্য এই পন্থা অতি কার্যকরী হিসাবে বিবেচিত হয়। কিন্তু এই কর্মসূচি শ্রমিক শ্রেনীর জন্য তাৎক্ষনিক কোন ফলাফল দেয় না । তবে এটা তাদেরকে শিক্ষা দেয় এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে সমাজ বদলের পথ প্রসস্ত করতে হবে ।

অর্থনৈতিক দাবী আদায়ের সংগ্রামরত সংগঠন সমূহ তাদের কাজের ভেতর দিয়ে দৈনিক মজুরী বৃদ্বির জন্য যে লড়াই করা তার দ্বারা এটা ও পরিস্কার করা হয় যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানুষের সমস্যার সমাধান হয় না । যদি এই লড়াই না থাকে তবে শ্রমিকদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। তবে এটা স্পষ্ট সত্য যে, কেবল মজুরী লড়াই দিয়ে সামাজিক সমস্যার সমাধান হবে না । কিন্তু এটা রাজনৈতিক প্রশিক্ষনের জন্য অতি জরুরী বিষয়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্য এই ধরনের রাজনৈতিক শিক্ষা খুবই কার্যকরী হয় । শ্রমিক শ্রেনীর লোকেরা জীবীকার জন্য নিজেদের হাত ও ব্রেইন মালিক পক্ষের নিকট বিক্রি করে দেয় ।কিন্তু সারা জীবন পরিশ্রম করে ও জীবনের জন্য বা পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ব্যবস্থা করতে পারেন না । আর মানুষের জীবনের চাহিদা সকল সময়ে একরকম থাকে না, তা জীবনের বাকে বাকে প্রতিনিয়ত পরিবর্তীত হতে থাকে।

আমরা এখানে শ্রমিকদের লড়াই সংগ্রামের ধরন ও প্রকৃতি নিয়ে কথা বলব। অর্থনৈতিক জোট গঠনের প্রক্রিয়া পন্য পয়দাকারী মানুষের কেবল জীবন যাত্রার মানই উন্নত করে না তা তাদের জন্য এক মহা বিদ্যালয়ের কাজ করে থাকে, তাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা বাড়াতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে । লড়াই সংগ্রামের বাস্তব অভিজ্ঞতা তাদের নিজ নিজ সংঘের গতিশীলতা বৃদ্বি করে, নিজেদের মধ্যে ইতিবাচক বুঝা পড়া বাড়ায়, এবং তাদের বুদ্বি বৃত্তিক দৃষ্টি ভঙ্গী সম্প্রসারিত করে থাকে।  তাদের ক্রমগাত বুদ্বিবৃত্তিক চর্চার ফলে ব্যাক্তিগত জীবনে ও ইতিবাচক পরিবর্তন আসে, জীবনে নানা বিষয়ের চাহিদা স্পষ্ট হয়ে উঠে। সুনির্দিস্ট ভাবে বললে বলতে হয় যে তাদের মধ্যে তাদের সংগ্রামী জীবনের কারনে উন্নত চিন্তার স্ফুরন দেখা যায় ।

মানুষের বুদ্বি বৃত্তিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে হলে উন্নত জীবন মানের সাথে তাদেরকে পরিচিত করাতে হয়, একটি উন্নত ভাবনাই মানুষকে কর্মে দিনে দিনে সক্ষম করে তুলে । প্রাথমিক ভাবে চিন্তা ভাবনায় বুদ্বি বৃত্তিকভাবে উন্নত জীবন ভাবনা না থাকলে পরিবর্তনের কোন প্রশ্নই উঠেনা । সামাজিক ভাবে উচু স্তরের ভোগবাদি সংস্কৃতির কারনে, মানুষ সকল সময়েই দুঃখ কস্ট দারিদ্রতাকে ভয় পায়। অথচ পন্য পয়দাকারী লোকেরা যুগে যুগে লড়াই সংগ্রাম করেই তাদের জীবন যাত্রার পরিবর্তন সাধন করেছেন। তা না হলে হয়ত সেই পরিবর্তন কোন দিনই সম্ভব হত না । তাদের অঙ্গীকারের কারনেই পন্য পয়দাকারী হিসাবে তাদের বুদ্বি বৃত্তিক বিকাশ হয়েছে। পন্য পয়দাকারীদের এই আকাঙ্ক্ষা গুলো দেখে মালিক পক্ষের মধ্যে এক ধরনের গভীর অবিশ্বাস জন্ম নেয়। পুঁজিবাদীরা একটি শ্রেনী, তাদের সম্পর্কে স্প্যানিশ মন্ত্রী, জোয়ান ব্রাভো মুরিলুর একটি উক্তি আজো বিখ্যাত হয়ে আছেঃ  পন্য পয়দাকারীদের মধ্যে কি এমন কেউ নেই যে চিন্তা করতে পারে; তারা কি কেবল পশুর মত খেটেই যাবে?

অর্থনৈতিক লড়াই সংগ্রামের ভেতর দিয়ে আরো গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয় অর্জন করা যায় তা হলো পন্য পয়দা কারীদের মধ্যে পারস্পারিক সংহতি, এই বিষয়টি প্রচলিত ধারনার দল ও জোটের চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির হয়, এটা এক ধরনের সামাজিক শ্রেনী হিসাবে গড়ে উঠে । আন্দোলনকারীদের এক প্রকার সম্মিলিত সহযোগীতার পরিবেশ সৃজন হয়, তাদের মাঝে সামাজিক পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা সাধনা করার জীবনী  শক্তির বিকাশ ঘটে। এই বিকাশের ফলে সকলের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য একটি ঐক্যমতে সূচনা হয়।

পন্য পয়দাকারীদের প্রাকৃতিক সংহতি ও আন্দোলন একটি সামাজিক চরিত্র দান করে, এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম অনুসারী লোকেরা সেই ধারার বিকাশ ঘটাতে চায় । তাই মানুষের মাঝে সহানুভূতি সৃষ্টি হতে পারে এমন সাধারন ধর্মঘট পালন করতে চায় । এই ধারার একটি মডেল স্পেনে সৃজন করা হয়েছিলো। এই রকমের অর্থনৈতিক লড়াই সংগ্রাম শ্রমিক শ্রেনীকে স্বাধীকার আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করতে সয়াহতা করে ।

আজ, যখন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক কার্টেল এবং ট্রাস্ট গঠনের দ্বারা বেসরকারী পুঁজিবাদ একচেটিয়া পুঁজিবাদে আরো বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন যুদ্ধের এই রূপটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একমাত্র শ্রমিক দ্বারা এবং কেবল  শ্রমিকরাই সফল হতে পারে। শিল্প পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ রূপান্তরের কারণে সহানুভূতিশীল ধর্মঘট শ্রমিকদের জন্য  একটি  অভাবনীয় ঘটনা হয়ে ওঠে। ঠিক যেমন তাদের কার্টেল এবং প্রতিরক্ষামূলক সংস্থার নিয়োগকর্তারা তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি  বৃহত্তর ভিত্তি তৈরি করছে, তেমনি কর্মীদের অবশ্যই তাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থার প্রয়োজনীয়  জাঁকজমক দ্বারা নিজেদের জন্য পরিবেশ তৈরি করা উচিত। সময়ের চাহিদাগুলি মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত কর্ম সঞ্চালনের দরকার। সীমাবদ্ধ ধর্মঘট আজকে তার মূল গুরুত্ব আরো হ্রাস করা হয়েছে, এমনকি  এটি এখন পুরোপুরি অদৃশ্য নয়। রাজধানী এবং পল্লীর শ্রমিকের মধ্যে আধুনিক অর্থনৈতিক সংগ্রামে সমগ্র শিল্প কেন্দ্র জড়িত হয় বড় ধর্মঘটে। এমনকি সমাজতান্ত্রিক ধারনাগুলি দ্বারা এখনও পুরানো নৈপুণ্য সংগঠনের শ্রমিকরা ধরে রেখে এটিকে বিবেচনা করেছেন যে, পুরোনো পদ্ধতির বিপরীতে আমেরিকার শিল্পকেন্দ্রগুলির দ্রুত বর্ধিতকরণের দ্বারা যা কিছুই হোক না কেন তা তারা মোকাবিলা করতে পারবেন।

সংঘবদ্ব শ্রমিকগন ডাইরেক্ট একশন কার্যক্রম পরিচালনা করে সাধারন ধর্মঘটের মাধ্যমে সকল প্রকার উৎপাদন ক্ষেত্রের কাজ বন্দ্ব করে দেয়ার সাথে সাথে প্রলেতারিয়েতের জোটবদ্ব প্রতিরোধের ও প্রদর্শন করে থাকে। শ্রমিক শ্রেনীর জন্য এই কর্মসূচিটি খুবই কার্যকরী অস্ত্র হিসাবে পরিগনিত হয়, তারা এই অস্ত্র ব্যবহার করে নিজেদেরকে একটি সামাজিক বিশেষ শক্তি হিসাবে প্রমান করতে পারেন। সাধারন ধর্মঘট একটি অতি গুরুত্বপূর্ন ও ক্ষমতাশালী অস্ত্র যা শ্রমিকদেরকে সামাজিক ক্ষমতায়নে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে থাকে। ১৮৯২ সালে মার্সেলাইসে ফ্রান্স কংগ্রেসের পর ট্রেড ইউনিয়ন সমূহ এবং সিজিটি ব্যাপক ভাবে ধর্মঘটের মত কাজে হাত দেয় । সেই সময়ে জার্মানীর শ্রমিক দল সমূহ এবং অন্যান্য দেশের সমাজবাদি পার্টি গুলো  এই ধরনের কার্যক্রমকে ইউটোপীয় বলে উড়িয়ে দেয়। তারা সাধারন ধর্মঘটকে সাধারন পাগলামী বলে ও প্রাচার করে । আর এই সকল কিছুর পিছনে ছিলো জার্মানীর সোশ্যাল ডেমোক্রেট চক্র। তবে সেই সাধারন ধর্মঘটের মত কাজের প্রভাব বেশ কিছু দেশে ব্যাপক সাড়া ফেলে ছিলো, যেমন- স্পেন, বেলজিয়াম, ইতালী, হল্যান্ড, রাশিয়া ইত্যাদি দেশে । সেই সময়ে পরিস্কার করে দেখিয়ে দেয়া হয়েছিলো যে, এই ধরনের সর্বপ্লাবী কার্যক্রম কোন কল্পনা বিলাশ নয়। আদতে এই বিপ্লবী কর্মসূচী মানুষের মুক্তির লড়াইকে তড়ান্বিত করে ।


Share Tweet Send
0 Comments
Loading...
You've successfully subscribed to Bangladesh ASF
Great! Next, complete checkout for full access to Bangladesh ASF
Welcome back! You've successfully signed in
Success! Your account is fully activated, you now have access to all content.