মাখনোঃ ফরাসি সাংবাদিকদের নিকট একজন প্রভাবক বিপ্লবী - স্টিফেন রজার
ভাষান্তরঃ এ কে এম শিহাব
ইউক্রেনে যতগুলি প্রতি বিপ্লবি শত্রুকে সেখান কার এনার্কিস্ট বা নিরাজবাদিগন মোকাবেলা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ফ্রান্সের সেনাবাহিনী অন্যতম। একজন পলাতক ব্যাক্তি মাখনো ও তার লড়াকু বাহিনীর বর্ননা দিয়েছেন।
এটা সব সময়ই সত্য যে প্রতি পক্ষ প্রচারাভিযানে তাঁর অপর পক্ষের সুনাম নষ্ট করায় তৎপর থাকে, এই ক্ষেত্রে ও জার্মান উপনিবেশ মেনোনিটির প্রয়াস ব্যাতিক্রম নয়। এরা আমাদের কমরেড মাখনোর সুনাম নষ্ট করতে সচেষ্ট ছিলো। যারা কেবল আমাদের ব্রিগেড কমিশার মাখনোকে ভালোভাবে জানেন না তারাই এই সকল প্রতারনাপূর্ন কথা বার্তা বিশ্বাস করতে পারে।
আমি এখন ফ্রান্সে সাংবাদিক হিসাবে মাখনোকে নিজের চোখে যেমন দেখেছি, সেই ভাবে আমি তাঁকে ও তাঁর বাহিনীর সঠিক ঘটনা জন সম্মোখে তুলে ধরতে পারি। এক এক জন সৈনিক তাঁদের কমিশারের কথা কেমন ভাবে অনুসরন করেছে।
ফেব্রুয়ারী ১২, ১৯১৯ সালে আমি ফরাসি সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসার পর কমিউনিস্ট বাহিনির সাথে যোগ দিয়েছিলাম ( তা আমি আমার অন্য এক লিখায় প্রকাশ করেছি)। মার্চ ১২, ১৯১৯ সালে আমি বলশেভিক ভ্যানগার্ডের সাথে যুক্ত হওয়ার পর যারা মাখনোর নেতৃত্বে আলাদা বাহিনী গড়ে তুলে তাঁদের সাথে আমি ও থেকে যাই। আমি নিজেও আমার বিপদ সম্পর্কে জানতামঃ আমি ও অস্ত্র হাতে নিয়ে সেই দিক থেকেই আসছিলাম যেখান থেকে হোয়াট গার্ডের লোকেরা পালিয়ে গিয়েছিলো। সেই সময়ে সৈনিকদের মধ্যে যুদ্ব ও বিজয়ের বিপুল উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়েছিলো। কোন যুদ্বে যখন বিপ্লবের বিজয় অর্জন করতে গিয়ে প্রচন্ড লড়াইয়ে নিজেদের বিপুল পরিমান কমরেড প্রান দেন তখন অন্য কোন অপরিচিত সৈনিকের খোজ কেইবা রাখতে পারে বলুন !?
অভূতপূর্ব তেমন কিছুই ঘটেনি। যে সকল সৈনিকেরা বিজয়ের আগের সিংহের মত লড়াইয়ে গর্জে উঠেনি, তারাই বিপ্লবের বিজয়ের পর নিজেদেরকে সিংহ সম সৈনিক হিসাবে প্রমান করার চেষ্টা করে ।
এক জনের প্রশ্নের জবাবে আমি বলি, আমি ফ্রান্সের পালিয়ে আসা একজন সৈনিক; তখন তারা আমাকে সউল্লাসে ঘিরে ধরে, আমার সাথে আলিঙ্গন করে, হাত মিলায়, আমাকে খেতে দেয়, জিজ্ঞাসা করে আমার আর কি কি লাগবে- এক কথায় গভীর ভালোবাসায় ওরা আমাকে স্বাগত জানিয়ে নিজেদের মত করে নেয় ।
ইউক্রেনের ৯ নম্বর রেজিম্যান্টের কমিশার মোলেনানকু, ও মোলচাক আমার অন্তর্ভুক্তির বিষয় চুড়ান্ত হবার পর আমি আমার নিকট থাকা সকল অস্ত্র ও গোলাবারুদ সমর্পন করি ওরা ও আমাকে অভ্যার্থনা জানান। কমরেড ম্যালিরেনকু একটি শক্তিশালী দল নিয়ে থাকতেন, তাঁকে সকলেই সম্মান করতেন। সকলের সাথে আমার ও বিস্তারিত পরিচিতির পর পরিচয় পত্র দেয়া হয় । আমি ও সেই সময়ে আমার পলায়নের বিস্তারিত সকলকে জানিয়ে দেই । তিনি আমাকে তাঁর সাথে খাবার খাওয়ার জন্য আহবান করেন এবং আমার আপাদ মস্তক দেখে আমার পোষাকের বেহাল অবস্থা অবলোকন করে আমাকে একসেট পোষাক পরিচ্ছদ উপহার দেন। তিনি বলেন আমার নিজের বাড়ী ঘর আছে কিন্তু আমি বাড়ীতে না থেকে আমি আমার কমরেডদের সাথে থাকতে পছন্দ করি।
আমি কোন সময়েই বিচ্ছিন্ন হবার কথা ভাবি না। আমরা সকলেই এক সাথে সত্যিকার আনন্দ করি, এরা বিজয় ছাড়া আর কিছুই ভাবে না, তাঁদের কথা হল, “ আমরা যখন মাখনোর সাথে থাকি তখন দুনিয়ার কোন কিছু কেই ভয় পাই না। তিনি সর্বদা আমাদেরকে সামনের দিকে পরিচালিত করেন- তিনি সিংহের মত সাহসী, আমরা অবশ্যই বুর্জোয়া ও পুঁজিবাদের বিনাশ করে দিব”। সেই সৈনিক আমায় আরো বলেন, তিনি আমার আগের সেনাপতির মত নয়, তিনি অভাবনীয়ভাবে যুদ্ব পরিচালনা করে থাকেন। যুদ্বের ক্ষেত্র একশত মেইল হলে ও মাখনো যুদ্বে সকলের আগে থাকেন, তিনি সৈনিকদেরকে উৎসাহিত করেন তাঁর অসীম সাহস তিনি সকলের প্রেরনার উৎস।
পরের দিন চা পানের সময়, আমার প্রথম সুযোগ হয় ব্রিগেডিয়ার কমিশার মাখনোর সাথে দেখা করার। তিনি প্রধান অধিদপ্তর থেকে কমিশার ম্যালেরেনকু’র রেজিম্যান্ট পরিদর্শনে আসেন এবং আমাদের সকলকে উষ্ণ অভিনন্দন জানানঃ “ সুভ অপরাহ্ণ!” তিনি সকলের সাথেই করমর্দন করেন, সেই সময়েই ম্যালেরেঙ্কু আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি আমাকে এই বলে পরিচয় করান যে আমি ফ্রান্সের একজন কমরেড আমি সেভাস্তুপল থেকে পালিয়ে এসে এখানে যোগ দিয়েছি। মাখনো চমৎকার হেসে আমার সাথে করমর্দন করেন, তিনি আমায় বলেন আমায় দেখে তিনি খুব খুশি হয়েছেন। তিনি আমাকে তাঁর ঠিক সামনের আসনে বসান, চা পানের পর ডিনার গ্রহন করা পর্যন্ত সঙ্গে রাখেন, তাই রাত ২টা পর্যন্ত আমি তাঁর কাছা কাছি ছিলাম।
মাখনো চিপচিপে গড়নের মধ্যম উচ্চতার একজন সাধারন প্রকৃতির লোক, তবে তাঁর শারিরীক গঠনে ব্যাতিক্রম লক্ষ্য করিনি। তিনি নিল রঙের পোশাক পড়ে ছিলেন, দেখ আকর্ষনীয় ও মর্যাদা সম্পন্ন ব্যাক্তি হিসাবে দেখাচ্ছিল। তাঁর উজ্জল চোখ, হাস্যোজ্জল ছেহেরায় তাঁকে অত্যন্ত সাহসী ও মেধাবী বলেই মনে হচ্ছিলো। সেই সময় তাঁর মাথার চুল গুলো পেছনের দিকে আচড়ানো ছিলো তাকে আরো আকর্শনীয় সুপুরুষ মনে হচ্ছিল।
আমরা নানা বিষয় নিয়ে কয়েক ঘণ্টা কথা বলেছি, ধন্যবাদ কমরেড চের্নভকে যিনি মাখনোর এডজুডেন্ট। চের্নভ একজন দক্ষ বিপ্লবী তিনি বহু বছরে বিপ্লবের কারনে দেশের বাহিরে ছিলেন। তিনি দির্ঘ সময় ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় বসবাস করেছেন। তিনি সেই সময় সমগ্র ইউরূপ ও অন্যান্য দেশের বিপ্লবী দল ও ব্যাক্তির সাথে সাক্ষাৎ করে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করেছেন । যা আজ তাঁকে বিপ্লবী লড়াই সংগ্রামের উচ্চ আসনে অভিষিক্ত করেছে। তিনি ইউরূপের প্রায় সকল ভাষাই জানতেন। তাই তিনি আমার ও মাখনোর আলোচনায় দু ভাষীর কাজ করে সহায়তা করেছেন । আমি ফ্রান্সের সামগ্রীক চিত্র এবং চলমান আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রকৃত চিত্র দিয়ে কমরেড মাখনোকে হালনাগাদ করে দেই। মাখনো আমাকে প্যারিস বিপ্লবের নানা দিক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। অবশ্য তিনি আগেই এই সকল বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন; তিনি ফ্রান্সের প্রায় সকল লিখক ও চিন্তাবিদদেরকে চিনতেন এবং তাঁদের লেখা ও আদর্শিক চিন্তা সম্পর্কে সাম্যক অবগত ছিলেন। আমি তাঁর সেই জ্ঞান ও সচেতনতা দেখে সত্যি অভিভুত হই।
পরের দিন মাখনো জনগনের উদ্দেশ্যে ভাষন দেবার কথা ঘোষণা করেন। মলচাংকের সকল লোকেরা চার্চের সামনের মাঠে সমবেত হন। তাঁর মেধা ও জনপ্রিয়তা মানুষকে প্রবল ভাবে আকর্ষন করে, সেই সময়ে মাখনোর সমান আর কেহই সেখানে ছিলেন না । তিনি যখন ঘোড়ার পিঠে ছড়ে সেখানে এলেন তখন দেখলাম চারদিকের মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ছে। মাখনো ঘুমের চেয়ে বেশী সময় ঘোড়ার পিঠেই কাটাতেন। তিনি হেসে সকলকে অভিবাদন জানালেন, প্রলেতারিয়েত নেতৃত্বের জন্য মেধা ও জ্ঞান আমাদের সকলের চেয়ে বেশী তারই ছিলো, তিনিই আমাদের প্রিয় বন্দ্বু যিনি অত্যাচারিত, নিপীড়িত মানুষের জন্য কাজ করছেন এবং অত্যাচারী ও নিপিড়কদের ঘৃনা করছেন।
তিনি মঞ্চে উঠে দাড়ালেন এবং কথা বলতে শুরু করচলেন। তিনি টেনে কথা বলছিলেন তবে লোকেদের উল্লাসের কারনে তাঁকে বার বার থামতে হয়েছিলো। কথা বলার সময় তাঁর চোখ চিকচিক করছিলো, তিনি উৎসাহ, উদ্দিপনার সাথে পয়েন্ট ভিত্তিক বক্তব্য দিচ্ছিলেন। সেই সময় প্রায় এক ঘন্টা তিনি বক্তব্য দেন। আমি ভিন্ন ভাষী হোওয়ায় তাঁর সকল কথা বুঝতে পারি নাই । তবে তাঁর অগ্নি ঝড়া প্রতিটি কথার সাথে যে জনগণ একাত্ম ছিলো তা স্পস্ট বঝতে পারি। আমি চমৎকার কথা ও মুখের অভিব্যাক্তি দেখে প্রচন্ডভাবে আকৃষ্ট হয়েছি। তিনি তাঁর ভাষনের সময় উপস্থিত জনগণ শ্লোগান দিচ্ছিলো, “ বিপ্লব দির্ঘ জীবী হোক! বুর্জোয়াদের পতন হোক! মাখনো দির্ঘজীবী হোক!” আমি পরিস্কার বুঝতে পারি ইউক্রেনের মানুষ কি চাইছে আর কি তাঁদের অধিকার।
একজন নেতা বিশাল মর্যাদার অধিকারী, তাঁর সব চেয়ে বড় পরিচয় হলো তিনি একজন প্রলেতারিয়েত এবং বিপ্লবী, তিনি সৈনিক ও জনগনের ভালোবসায় সিক্ত। মাখনোকে আমি যেমন দেখেছি, তিনি হাজার জনের চেয়ে উত্তম, তিনি আমাদের লড়াই সংগ্রামে একজন বড় যোদ্বা ও বিপ্লবী।
অনুবাদকের কথাঃ
১৯১৯ সালের মে ৯ থেকে ১৯১৯ সালের ১২ মার্চের মধ্যে প্যারিসের সংবাদ পত্র লা ভাগ্যো তে স্টিফেন রজারের নেস্টর মাখনোর উপর এই লিখাটি প্রকাশিত হয়েছিলো। প্রকাশের সঠিক তারিখটি অজানা। কেননা এটা রাশিয়ান ভাষা থেকে অনুবাদ হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। বলশেভিক নেতা লেনিনের আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে ।
সেই সময়ে বলশেভিকদের সাথে মাখনো বাহিনীর খুবই সখ্যতা ছিলো। তারা উভয়ই দক্ষিন ইউক্রেন থেকে সাদা সেনাবাহিনীকে বিতারনের জন্য কাজ করছিলো। স্থানটির নাম মলোচাংক একটি বিশাল গ্রাম। এই গ্রামটি মাখনোভিস্টগন ১৯১৯ সালের মার্চে দখল করেছিলো।
মাখনোর পড়া শোনার প্রতি খুবই আগ্রহ ছিলো, রাশিয়ান পত্রিকার সম্পাদকেরা এই বিষয়ে অনেক লেখা লিখেছেন। তাঁর সেনাবাহিনীর লোকদের মধ্যে একটি শ্লোগান খুবই প্রচলিত ছিলো, “এক জন সকলের জন্য এবং সকলেই একজনের জন্য”। আলেকজান্ডার দোমার তিনি খুবই অনুরক্ত ছিলেন।
যদি ও বলা হয় মাখনো কেবল দুই বছর অনুস্টানিক শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্ত তিনি তাঁর জীবনে ব্যপক পড়া শোনা করেছিলেন। খুব অল্প বয়সেই ড্যাণ কইস্টের বড় বড় পুস্তক পড়ে শেষ করেছিলেন। আর এই পুস্তক গুলো এনার্কিস্টদের পরামর্শ মতই তিনি পাঠ করেন। ভূগোল, ইতিহাস, গনিত ইত্যাদি ছিলো তাঁর প্রিয় বিষয়।
তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেনঃ
“ আমি যখনই জেলে গেছি, তখনই বই পড়ায় মন দিয়েছি। আমি বইয়ের পর বই শেষ করেছি; আমি রাশিয়ার সকল ক্ল্যাসিকাল বই পড়েছি, সমর কভ থেকে লেভ শেষ্টভ, ব্যালিনস্কি এবং লের্মন্টভের প্রতি আমার বিশেষ আকর্ষন ছিলো কারন তাঁদের লিখায় আমি সব কিছুই পেতাম। যারা কারাগারে মূল্যবান একটি গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছিলেন রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের জন্য তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। এখানে এমন কিছু পুস্তক আছে যা আমাদের প্রাদেশিক শহরে ও পাওয়া যাবে না। আমি ক্লুচেভস্কির কোর্স করেছি। সাম্যবাদিদের গোপন আলোচনা চক্রের সাথে যুক্ত ছিলাম । পরে আমি চিন্তক ক্রপথকিনের মিউচুয়াল এইড বইটি পড়ি। আমি এই পুস্তক দ্বারা প্রচন্ড ভাবে প্রভাবিত হই। ফলে আমি এর নানা দিক নিয়ে কমরেডদের সাথে ব্যাপক আলোচনা করেছি”।