মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত চা জনগোষ্ঠীর শিশুরা

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চা শিল্পের অবদান  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মৌলভী বাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম,  রাঙ্গামাটি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং পঞ্চগড়ে ১৬৭টি চা বাগান রয়েছে। এসব বাগানে  প্রায় সোয়ালক্ষ শ্রমিক নিরলস শ্রমের বিনিময়ে চা শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে।  মালিকপক্ষ এখানে সকল কর্মকান্ডের নিয়ন্ত্রক, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার  প্রবেশাধিকার নেই বললেই চলে। ফলে চা শিল্পে জড়িত জনগোষ্ঠী অধিকাংশ  সরকারি-বেসরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে।  আধুনিকতা ও তথ্য প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এ যুগে চা শিল্পে জড়িত  জনগোষ্ঠীদের চা বাগানের বাইরের পৃথিবীটা অজানা-অচেনা। এখনো তারা মৌলিক ও  মানবাধিকারের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে।

আধুনিক জীবনচেতনা ও অধিকার সর্স্পকে চা শিল্পে জড়িত জনগোষ্ঠী সচেতন নন।  এছাড়া স্বাস্থ্যসম্মত আশ্রয়, নিরাপদ পানি, পয়ঃনিস্কাশনের ব্যবস্থা, চিকিৎসা  সেবা, পুষ্টিসম্পন্ন খাদ্য, শিক্ষা, পর্যাপ্ত মজুরি, সর্বোপরি আত্মউন্নয়ন ও  সামাজিক মর্যাদা থেকে এরা বঞ্চিত। যেহেতু এদের কর্মস্থলে বাস করা  বাধ্যতামূলক তাই মালিক পক্ষ বা কোম্পানী কর্তৃক ১০/১২ ফুটের ঘরে তিন পুরুষ  ধরে বাস করে আসছে। এমনকি এদের নিজস্ব কোনো আবাদী জমিও নেই। এরা সবসময়ই  দরিদ্র জীবনযাপন করে, সঙ্গে থাকে নিত্ত দিনের দুর্ভিক্ষ। নিম্নহার ও দৈনিক  মজুরির কারণে (দিন শেষে ৫৫ টাকা মজুরি) একজনের মজুরি দিয়ে সংসার চলে না তাই  স্বামী ও সন্তানসহ কাজ করে থাকে। বর্তমানে তাদের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি।  এছাড়া বেকার ও ছাঁটাই শ্রমিকদের অবস্থা আরো কষ্টকর। কাজের সুযোগ না থাকা,  লেখাপড়া না জানা, গৃহহীনতা, সঞ্চয় করতে না পারা, পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা  করতে না পারা, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব-এরকম পরিবার থেকে শিশুরা লেখাপড়া  করবে কিভাবে তা ভাবনার বিষয়। তাই স্বাধীনতার ৪১ বছরে বাংলাদেশে প্রায়  দশলক্ষ চা জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাত্র একজন উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে।

মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে এমন অনেক সাংবিধানিক রক্ষাকবচ ও  শ্রম আইন দেশে প্রচলিত আছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, ১৯৭২ এর  রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে ১৫ (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- রাষ্ট্রের অন্যতম  মৌলিক দায়িত্ব হবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির  ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ়  উন্নতিসাধন, যাতে নাগরিকদের জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ  জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায়। এছাড়া ২৮ (১)  অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষবেদ বা  জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবেন না।  সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে মৌলিক অধিকারে ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সকল নাগরিক  আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। চা শিল্পে জড়িত  জনগোষ্ঠীতে বিভিন্ন জাতিসত্ত¡ার মানুষ বাস করে। এদের ভাষা ও সংস্কৃতি  আলাদা। এরা দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ। যে কোনো ধর্মের নারী-পুরুষ  সকল শ্রমিকের নাগরিক হিসেবে মৌলিক অধিকারগুলো সংবিধানে স্বীকৃত আছে।  কিন্তু বেশিরভাগ শ্রমিক নিরক্ষর হওয়ার কারণে আইন, অধিকার ও ন্যায়বিচারের  প্রতি তারা সচেতন নন।

২০০৬ সালের শ্রম আইনের ৯৫ ধারায় চা-বাগানে নিযুক্ত শ্রমিকগণ এবং তাদের  শিশু সন্তানগণের জন্য বিনোদন ও শিক্ষার সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। যে কোনো  ক্ষেত্রে কোন চা-বাগানের শ্রমিকগণের ছয় হতে বারো বছর বয়সী শিশু সন্তানগণের  সংখ্যা পঁচিশ এর উপরে হয় সে ক্ষেত্রে, বিধি প্রণয়ন করে উহার মালিককে,  বিধিতে উল্লেখিত প্রকারে এবং মানের শিশুদের শিক্ষার সুযোগ এর ব্যবস্থা  করবার জন্য নির্দেশ দিতে পারবে। প্রতিটি চা-বাগানে শ্রমিকদের এবং তাদের  সন্তানদের জন্য বিধি দ্বারা নির্ধারিত পন্থায় উপযুক্ত চিকিৎসা কেন্দ্র  প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

দেশের অন্যান্য শ্রমিকের মতো চা শ্রমিকের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার জন্য  সার্ক সামাজিক সনদ ও আইএলও সনদ রয়েছে। সার্ক সামাজিক সনদ দক্ষিণ এশিয়ার  রাষ্ট্রগ্রলোকে তাদের নাগরিকদের জন্য ‘মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং প্রত্যেক  নাগরিকের ব্যক্তি মর্যাদা, নিরাপত্তা এবং সৃষ্টিশীলতা নিশ্চিত করার  অঙ্গীকার করতে বলেছে।’ সনদে মৌলিক শিক্ষার সুযোগ, বাসস্থানের নিশ্চয়তা,  নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের সুবিধা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা- এসব  বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে যেগুলো আইন, নিবার্হী ও প্রশাসনিক নিয়ম  দ্বারা নিশ্চিত করা উচিত। এতে ‘পর্যাপ্ত আশ্রয়, খাদ্য ও পোশাকসহ মানসম্পন্ন  জীবনমান’ নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকার আর্ন্তজাতিক  সনদসমূহ অনুসমর্থন করলেও, যতক্ষণ না এগুলো দেশের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়  ততক্ষণ পর্যন্ত এগুলোর কার্যকারিতা নেই।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, চা জনগোষ্ঠীকে যেমন শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শে  আসতে দেওয়া হয় না, তেমনি তাদের শিক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়না। অন্যদিকে  অভিভাবকরা অধিকাংশ নিরক্ষর বলে সন্তানদের লেখাপড়ার বিষয়ে তেমন কোনো ভূমিকা  রাখতে পারে না। এছাড়া সন্তানদের শিক্ষার ব্যয় বহনের ক্ষমতা ও সামর্থ্য  অভিভাবকদের না থাকায় শিশুদেরকে স্কুলের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। শিশুরা  বাড়িতে সাহায্য না পাওয়ায় অনেকে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। ফলে চা শিল্পে জড়িত  জনগোষ্ঠীর শিশুরা শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়। চা শ্রমিক বসতিপূর্ণ  এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার শিশু প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। উল্লেখ্য, দেশের  মোট ৪টি ইউনিয়নে কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। এর মধ্যে একটি  রাজশাহী জেলার একটি ইউনিয়ন, যেখানে ভিন্ন ভাষাভাষীর আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাস  করে এবং বাকী ৩টি ইউনিয়নই মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল থানায় অবস্থিত।

প্রথম শ্রেনীর বাগানগুলোতে শ্রমিকদের শিশুদের জন্য সরকারী প্রাইমারী  স্কুল আছে। এছাড়া ১৬০াট বাগানে মালিক পক্ষের ৭৮টি প্রাইমারী স্কুল ও ৪টি  উচ্চ বিদ্যালয় আছে। কিন্তু চা বাগান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরিচালিত প্রাথমিক  বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা গ্রহনের কোনো সুযোগ সুবিধা ও পরিবেশ নেই। শিক্ষকের  অভাব ও শিক্ষা কারিকুলাম সঠিকভাবে ফলো করা হয় না। অনেক সময় সাধারণ  শিক্ষার্থীরা চা জনগোষ্ঠীর শিশুদের সহজভাবে নিতে পারে না, ওদেরকে মর্যাদার  চোখে দেখে না। এসব স্কুলের কার্যক্রম মনিটরিং এর কোনো প্রকার ব্যবস্থা নেই।  পর্যাপ্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কারিগরী শিক্ষাকেন্দ্র নেই। এমনকি শিক্ষকদের  গুনগত মান উন্ন্য়নের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। চা শ্রমিকদের উন্নয়নের জন্য  তাদের নিজস্ব চাহিদার আলোকে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়নি বা হচ্ছে না।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য চা জনগোষ্ঠীর শিশুদের শিক্ষার প্রসার ঘটাতে  হবে। মান উন্নয়ন ও সুষ্ঠুভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর জন্য শিক্ষকদের  দক্ষতা বৃদ্ধি, আধুনিক শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, পাঠদান পরিকল্পনা অনুসরণ ও  জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিশুদের  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানোর উদ্যেগের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা ও পদ্ধতি যেমন-  ভর্তি, পাঠদান, পরীক্ষা সর্স্পকে সুষ্ঠু ধারণা ও সচেতনতা লাভের জন্য  অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে জ্ঞান দিতে হবে। আইনী সচেতনতা ও নাগরিক অধিকার  সর্ম্পকে সচেতন হতে হবে। মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সভা, সমাবেশ,  সংলাপ, বৈঠক, আলোচনা, মিডিয়াতে সম্প্রচারের মতো বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ  করতে হবে। চা শ্রমিকদের মাঝে মানব উন্নয়নমূলক কর্মসূচী যেমন- সমবায়ভিত্তিক  কাজ, টেকসই প্রযুক্তির সাথে পরিচয় করা প্রয়োজন। শ্রম আইনের সংশোধন এবং  মালিকদের আইন অনুযায়ী বাগান নিয়ন্ত্রন করার সদচ্ছিা থাকতে হবে। রাষ্ট্রকে  শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার্থে আইনের প্রায়োগিক জটিলতা দূর করে আইনের  বাস্তবায়ন করতে হবে। সামাজিক, আন্তঃব্যক্তিক ও গণমাধ্যমের সাথে যোগাযোগ  অত্যন্ত জরুরি।

চা শ্রমিক এ দেশেরই নাগরিক। দেশে যখন তাদের ভোটাধিকার আছে, তখন অন্যান্য  নাগরিক অধিকারও তারা প্রাপ্য। সেজন্য উন্নত জীবন ও মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ  তাদের সাংবিধানিক ও মানবিক অধিকার। ভূমিহীন এই চা শ্রমিকদের জীবিকা অর্জনের  অন্য কোন পথ নেই। বেশিরভাগ শ্রমিক অশিক্ষিত এবং জীবিকার জন্য এরা সারাজীবন  চা-বাগান মালিকদের ওপর নির্ভরশীল। চা শিল্পে শিশু শ্রম, ইচ্ছার বিরুদ্ধে  কাজ করতে বাধ্য হওয়া, পর্যাপ্ত মজুরি থেকে বঞ্চনা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার  সমস্যা ইত্যাদি প্রতিকারে একদিকে যেমন মালিকদের সদচ্ছিার পরিচয় দিতে হবে তেমনি এর জন্য  রাষ্ট্রকে আইন প্রয়োগে কঠোর হতে হবে। তাদের পূর্বপুরুষেরা এদেশে এসেছিল বলে  তারা থেকে গেছে। তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও  মানসকাঠামোগত সকল ধরনের স্বার্থই অরক্ষিত। তারা এখন পরিবর্তন চায়, সুযোগ  চায়। তাদের সন্তানরা শিক্ষা ও মর্যাদা পাবে এ প্রত্যাশা সকল চা শ্রমিকের।