করোনা ভাইরাসঃ উৎপত্তি দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ও প্রভাব
এ কে এম শিহাব
করোনাভাইরাস বলতে ভাইরাসের একটি শ্রেণীকে বোঝায় যেগুলি স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখিদেরকে আক্রান্ত করে। মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস শ্বাসনালীর সংক্রমণ ঘটায়। এই সংক্রমণের লক্ষণ মৃদু হতে পারে, অনেকসময় যা সাধারণ সর্দিকাশিরন্যায় মনে হয় (এছাড়া অন্য কিছুও হতে পারে, যেমন রাইনোভাইরাস), কিছু ক্ষেত্রে তা অন্যান্য মারাত্মক ভাইরাসের জন্য হয়ে থাকে, যেমন সার্স, মার্স এবং কোভিড-১৯। অন্যান্য প্রজাতিতে এই লক্ষণের তারতম্য দেখা যায়। যেমন মুরগির মধ্যে এটা উর্ধ্ব শ্বাসনালী সংক্রমণ ঘটায়, আবার গরু ও শূকরে এটি ডায়রিয়া সৃষ্টি করে। মানবদেহে সৃষ্ট করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়ানোর মত কোনো টিকা বা অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ আজও আবিষ্কৃত হয়নি।
করোনাভাইরাস রাইবোভিরিয়া পর্বের নিদুভাইরাস বর্গের করোনাভিরিডি গোত্রের অর্থোকরোনাভিরিন্যা উপ-গোত্রের সদস্য। তারা পজিটিভ সেন্স একক সূত্রবিশিষ্ট আবরণীবদ্ধ বা এনভেলপড ভাইরাস। তাদের নিউক্লিওক্যাপসিড সর্পিলাকৃতির। এর জিনোমের আকার সাধারণত ২৭ থেকে ৩৪ কিলো বেস-পেয়ার(kilo base-pair) এর মধ্যে হয়ে থাকে যা এ ধরনের আরএনএ ভাইরাসের মধ্যে সর্ববৃহৎ। করোনাভাইরাস শব্দটি ল্যাটিন ভাষার করোনা থেকে নেওয়া হয়েছে যার অর্থ "মুকুট"। কারণ দ্বিমাত্রিক সঞ্চালন ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ভাইরাসটির আবরণ থেকে গদা-আকৃতির প্রোটিনের কাঁটাগুলির কারণে এটিকে অনেকটা মুকুট বা সৌর করোনার মত দেখায়। ভাইরাসের উপরিভাগ প্রোটিন সমৃদ্ধ থাকে যা ভাইরাল স্পাইক পেপলোমার দ্বারা এর অঙ্গসংস্থান গঠন করে। এ প্রোটিন সংক্রমিত হওয়া টিস্যু বিনষ্ট করে। ভাইরাসটি ডাইমরফিজম রূপ প্রকাশ করে। ধারনা করা হয়, প্রাণীর দেহ থেকে এই ভাইরাস প্রথম মানবদেহে প্রবেশ করেছে।
করোনার সংক্রমণ শুরু হয় যখন ভাইরাল স্পাইক (S) গ্লাইকোপ্রোটিন পরিপূরক বাহক কোষের রিসিপ্টরে সংযুক্ত হয়। সংযুক্তির পর, বাহক কোষ থেকে নিঃসৃত প্রোটিয়েজ, রিসিপ্টর-সংযুক্ত স্পাইক প্রোটিনকে বিদীর্ণ করে এবং সক্রিয় করে দেয়। বাহক কোষের প্রোটিয়েজের প্রাপ্তিসাপেক্ষ, বিচ্ছিন্নকরণ ও সক্রিয়করণ নির্ধারণ করে ভাইরাসটি বাহক কোষে অনুপ্রবেশ করবে এন্ডোসাইটোসিস নাকি বাহক কোষঝিল্লি এর সাথে ভাইরাল এনভেলপ সরাসরি একীভূত হওয়ার মাধ্যমে।
জীবন চক্র
বাহক কোষে অনুপ্রবেশ করে, ভাইরাস কণাটি আবরণী মুক্ত হয় এবং কোষ সাইটোপ্লাজমে এর জিনোম প্রবেশ করে। করোনা ভাইরাস RNA জিনোমে একটি ৫' মিথাইলেটেড ক্যাপ এবং ৩' পলিয়াডেনাইলেটেড টেইল আছে, যা RNA কে ট্রান্সলেশনের জন্য বাহক কোষের রাইবোজোম এর সাথে সংযুক্ত করে। ভাইরাসের প্রাথমিকভাবে অধিক্রমণকারী উন্মুক্ত পঠন কাঠামো, বাহক রাইবোজোম ট্রান্সলেশন করে দীর্ঘ পলিপ্রোটিন গঠন করে। পলিপ্রোটিনের নিজস্ব প্রোটিয়েজ আছে যা পলিপ্রোটিনটিকে বিদীর্ণ করে অনেকগুলো অগঠনমূলক প্রোটিন তৈরি করে।
রেপ্লিকেশন বা, অনুলিপিকরণ
কতগুলো অগঠনমূলক প্রোটিন সমবেত হয়ে বহু-প্রোটিন রেপ্লিকেজ-ট্রান্সক্রিপ্টেজ কম্প্লেক্স (আর.টি.সি.) গঠন করে। আরএনএ-নির্ভর আরএনএ পলিমারেজ(আর.ডি.আর.পি.) হচ্ছে প্রধান রেপ্লিকেজ-ট্রান্সক্রিপ্টেজ প্রোটিন। এই প্রোটিনটি আরএনএ থেকে আরএনএ স্ট্র্যান্ড অনুলিপিকরন এবং ট্রান্সক্রিপশন এর জন্য সরাসরি নিযুক্ত। কম্পলেক্সের অন্যান্য অগঠনমূলক প্রোটিন এই অনুলিপিকরণ এবং ট্রান্সক্রিপশন প্রক্রয়ায় সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপ, এক্সোরাইবোনিউক্লিয়েজ নামক অগঠনমূলক প্রোটিন অনুলিপিকরণে ভুল চিহ্নিত করা এবং সংশোধনের(প্রুফরিডিং) বৈশিষ্ট্য এনে দেয় যা আরএনএ-নির্ভর আরএনএ পলিমারেজ এ নেই।
এই কম্পলেক্সটির অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে ভাইরাসের জিনোমের অনুলিপিকরণ। আরডিআরপি সরাসরি নেগেটিভ-সেন্স জিনোমিক আরএনএ এর সংশ্লেষণকে পজিটিভ-সেন্স জিনোমিক আরএনএ থেকে মধ্যস্থতা করে, যার পরবর্তীতে নেগেটিভ-সেন্স জিনোমিক আরএনএ থেকে পজিটিভ-সেন্স জিনোমিক আরএনএ অনুলিপিকরণ হয়ে থাকে। ভাইরাসের জিনোম এর ট্রান্সক্রিপশন করা কম্পলেক্সটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আরডিআরপি সরাসরি নেগেটিভ-সেন্স সাবজিনোমিক আরএনএ এর সংশ্লেষণকে পজিটিভ-সেন্স জিনোমিক আরএনএ থেকে মধ্যস্থতা করে, যার পরবর্তীতে এসব নেগেটিভ-সেন্স সাবজিনোমিক আরএনএ অণু অনুযায়ী পজিটিভ-সেন্স এম-আরএনএ এর ট্রান্সক্রিপশন হয়ে থাকে।
নির্গমন
অনুলিপিকৃত পজিটিভ সেন্স জিনোমিক আরএনএ অপত্য ভাইরাসগুলোর জিনোম হিসেবে কাজ করে। প্রাথমিক অধিক্রমণকারী গঠন কাঠামো অনুযায়ী ভাইরাস জিনোমের শেষ তৃতীয়াংশের ট্রান্সক্রাইবকৃত জিন হলো এমআরএনএ গুলি। এই এমআরএনএ গুলো পোষক রাইবোজোম দ্বারা ট্রান্সলেটেড হয়ে গঠনমূলক প্রোটিন এবং কতগুলো সহযোগী প্রোটিন তৈরি করে।এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামএর মধ্যে আরএনএ ট্রান্সলেশন হয়। ভাইরাল গঠনমূলক প্রোটিন S, E এবং M ক্ষরণশীল পথ পরিক্রমণ করে মধ্যবর্তী গলজি প্রকোষ্ঠে অবস্থান করে। সেখানে, M প্রোটিন গুলো বেশিরভাগ প্রোটিন-প্রোটিন মিথস্ক্রিয়া নির্দেশনা করে যা কিনা নিউক্লিওক্যাপসিড এর সাথে বন্ধনের পর ভাইরাসের সমবেত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয়। এক্সোসাইটোসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপত্য ভাইরাসগুলো ক্ষরণকারী প্রকোষ্ঠগুলো দ্বারা বাহক কোষ থেকে নির্গত হয়।
ভাইরাসটি কোন একটা প্রাণী থেকে মানুষের দেহে ঢুকেছে এবং একজন থেকে আরেকজনের দেহে ছড়াতে ছড়াতে আবার নিজের জিনগত গঠনে সবসময় পরিবর্তন আনছে - যাকে বলে মিউটেশন। তাই এ ভাইরাস হয়তো আর কিছুদিনের মধ্যে আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, এমন আশংকা রয়েছে। কিন্তু এ ভাইরাসটির প্রকৃতি এবং কিভাবেই বা তা রোধ করা যেতে পারে - এ সম্পর্কে এখনো বিজ্ঞানীরা বিশদভাবে জানার চেষ্টা করছেন। হয়ত অতি শীগ্রই জানা যাবে।
সার্স বা ইবোলার মতো নানা ধরণের প্রাণঘাতী ভাইরাসের খবর মাঝে মাঝেই সংবাদ মাধ্যমে আসে। এই করোনাভাইরাস তার মধ্যে সর্বশেষ। কিন্তু এটি কি আজ-আছে-কাল-নেই ধরণের কোন ভাইরাস? নাকি এটা তার চেয়ে অনেক বেশি বিপদজনক? করোনাভাইরাস এমন একটি সংক্রামক ভাইরাস - যা এর আগে কখনো মানুষের মধ্যে ছড়ায় নি। ভাইরাসটির আরেক নাম ২০১৯-এনসিওভি। এটি এক ধরণের করোনাভাইরাস। করোনাভাইরাসের অনেক রকম প্রজাতি আছে, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৭টি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি হয়তো মানুষের দেহকোষের ভেতরে ইতিমধ্যেই 'মিউটেট করছে' অর্থাৎ গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ নিচ্ছে এবং সংখ্যাবৃদ্ধি করছে - যার ফলে এটি আরো বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এটি অত্যন্ত দ্রুত ছড়াতে পারে এবং বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেছেন যে এ ভাইরাস একজন মানুষের দেহ থেকে আরেকজন মানুষের দেহে ছড়াতে পারে। এই ভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমেই এটি একজনের দেহ থেকে আরেক জনের দেহে ছড়ায়। সাধারণ ফ্লু বা ঠান্ডা লাগার মতো করেই এ ভাইরাস ছড়ায় হাঁচি-কাশির মাধ্যমে । এক দশক আগে সার্স (পুরো নাম সিভিয়ার এ্যাকিউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম) নামে যে ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৮০০ লোকের মৃত্যু হয়েছিল সেটিও ছিল এক ধরণের করোনাভাইরাস। এতে আক্রান্ত হয়েছিল ৮ হাজারের বেশি লোক।
আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে কী লক্ষণ দেখা যায়?
করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রধান লক্ষণ হলো, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, জ্বর এবং কাশি। কিন্তু এর পরিণামে অরগ্যান ফেইলিওর বা দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া, নিউমোনিয়া এবং মৃত্যু ঘটতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি শরীরে ঢোকার পর সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিতে প্রায় পাঁচ দিন লাগে। প্রথম লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। তার পর দেখা দেয় শুকনো কাশি। এক সপ্তাহের মধ্যে দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট এবং তখন কোন কোন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।
এই ভাইরাস কত বিপজ্জনক সেটা একটা প্রশ্ন। এখন পর্যন্ত আক্রান্তদের ৪%-৬% শতাংশ মারা গেছেন, হয়তো আরো মৃত্যু হতে পারে। তা ছাড়া এমন মৃত্যুও হয়ে থাকতে পারে যা চিহ্নিত হয় নি। তাই এ ভাইরাস ঠিক কতটা ভয়ংকর তা এখনো স্পষ্ট নয়।
ভাইরাসটি ছড়িয়েছে কোন প্রাণী থেকে !
মধ্য চীনের উহান শহর থেকে এই রোগের সূচনা। ৩১শে ডিসেম্বর,২০১৯ এই শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে প্রথম চীনের কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। এর পর ১১ই জানুয়ারি,২০২০ প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। ঠিক কীভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়েছিল তা এখনও নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করতে পারেন নি বিশেষজ্ঞরা। তবে তারা বলছেন, সম্ভবত কোন প্রাণী এর উৎস ছিল। প্রাণী থেকেই প্রথমে ভাইরাসটি কোন মানুষের দেহে ঢুকেছে, এবং তারপর মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়েছে।
সার্স ভাইরাস প্রথমে বাদুড় এবং পরে গন্ধগোকুল থেকে মানুষের দেহে ঢোকে। মার্স ভাইরাস ছড়ায় উট থেকে। এর সাথে উহান শহরে সামুদ্রিক খাবারের একটি বাজারে গিয়েছিল এমন লোকদের সম্পর্ক আছে বলে বলা হচ্ছে। ওই বাজারটিতে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী বেচাকেনা হতো । কিছু সামুদ্রিক প্রাণী যেমন বেলুগা জাতীয় তিমি করোনাভাইরাস বহন করতে পারে। তবে উহানের ওই বাজারে জ্যান্ত মুরগি, বাদুড়, খরগোশ, এবং সাপ বিক্রি হতো। হয়তো এগুলোর কোন একটি থেকে এই নতুন ভাইরাস এসে থাকতে পারে। এর কি কোন চিকিৎসা আছে?
যেহেতু এই ভাইরাসটি নতুন, তাই এর কোন টিকা বা ভ্যাকসিন এখনো নেই, এবং এমন কোন চিকিৎসা নেই যা এ রোগ ঠেকাতে পারে। তাহলে এর হাত থেকে রক্ষা পাবার উপায় কী? একমাত্র উপায় হলো, যারা ইতিমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছে বা এ ভাইরাস বহন করছে - তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। তা ছাড়া ডাক্তাররা পরামর্শ দিয়েছেন বার বার হাত ধোয়া, হাত দিয়ে নাক-মুখ স্পর্শ না করা, ঘরের বাইরে গেলে মুখোশ পরা। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. গ্যাব্রিয়েল লিউং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত এ নির্দেশনায় বলছেন, হাত সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, বার বার হাত ধুতে হবে। হাত দিয়ে নাক বা মুখ ঘষবেন না, ঘরের বাইরে গেলে মুখোশ পরতে হবে। "আপনি যদি অসুস্থ হয়ে থাকেন তাহলে মুখোশ পরুন, আর নিজে অসুস্থ না হলেও, অন্যের সংস্পর্শ এড়াতে মুখোশ পরুন" - বলেন তিনি। উহান শহরে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের সংস্পর্শে এসে কমপক্ষে ১৫ জন চিকিৎসাকর্মী নিজেরাই এতে আক্রান্ত হয়েছেন। এবং কয়েক জন মারা ও গেছেন।
করোনায় ও দোষারূপের সংকৃতি চর্চাঃ
চীনের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা বলেছেন, বিশ্বজুড়ে হাজারো মানুষ যে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত, তা মার্কিন সামরিক বাহিনী নিয়ে গেছে চীনে। তিনি দাবি করেছেন, চীনের উহান শহর থেকে এই ভাইরাসের উৎপত্তি দাবি করা হলেও, আদতে এই কাজ মার্কিন বাহিনীর। টুইটারে ৩ লাখ অনুসারী রয়েছে ওই কর্মকর্তা, অর্থাৎ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজানের। তিনি এ ধরনের বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব টুইটারে শেয়ার দিয়েছেন। এ খবর দিয়েছে সিএনএন। খবরে বলা হয়, সম্প্রতি মার্কিন সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের পরিচালক রবার্ট রেডফিল্ড মার্কিন কংগ্রেশনাল কমিটিতে একটি বক্তব্য রাখেন। সেখানে রেডফিল্ড বলেন, আমেরিকায় ইনফ্লুয়েঞ্জা ঘটিত কিছু মৃত্যুর ঘটনা পরে করোনা ভাইরাস-ঘটিত (কভিড-১৯) রোগ বলে প্রমাণিত হয়েছে। রেডফিল্ড বলেননি, কখন ওই রোগীরা মারা গেছেন।
তবে ঝাও ওই মন্তব্যের সূত্র ধরে দাবি করছেন, চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে করোনা ভাইরাস ছড়ায়নি। তিনি টুইটারে লিখেন, ‘হাতেনাতে ধরা খেয়েছেন সিডিসি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম করোনা ভাইরাস রোগী কে? কখন থেকে তিনি আক্রান্ত হয়েছেন? কতজন মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন? হাসপাতালের নাম কী? মার্কিন সেনাবাহিনীই হয়তো এই মহামারি উহানে নিয়ে গেছে। স্বচ্ছ থাকুন। আপনাদের উপাত্ত জনসম্মুখে প্রকাশ করুন। যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যাখ্যা দিতে হবে।’ প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের অক্টোবরে মিলিটারি ওয়ার্ল্ড গেমসে অংশ নিতে মার্কিন সামরিক বাহিনীর শ’ শ’ ক্রীড়াবিদ গিয়েছিলেন উহানে। ওদিকে রেডফিল্ডের ওই ভিডিও টুইটারে চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমেও তা প্রকাশিত হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরেক মুখপাত্র জেং শুয়াং বলেছেন, আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের মধ্যেই ওই ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মতবাদ রয়েছে। ঝাও’র টুইট নিয়ে তিনি সরাসরি কিছু না বলে মন্তব্য করেন, ‘চীন সব সময়ই মনে করে এটি একটি বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন, যেটির উত্তর আসা উচিত বৈজ্ঞানিক ও পেশাদারভাবে।’ চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, এমনকি দেশটির সরকারও করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে প্রচারণা শুরু করেছে। এই ভাইরাসে ইতিমধ্যে প্রায় ১৬ লাখ ২৫ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। তবে প্রথম আক্রান্ত রোগীদের কথা শোনা যায় উহানে। এরপর থেকে সেখানেই বিশ্বের অন্য যেকোনো স্থানের তুলনায় সবচেয়ে বেশি রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ৪ঠা মার্চ বেইজিংয়ে এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে ঝাও বলেন, এই ভাইরাসের উৎপত্তি সম্পর্কে কোনো অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। চীনা বিজ্ঞানীরা এখনো এর উৎপত্তি বের করার চেষ্টা করছেন। ২৭শে ফেব্রুয়ারি চীনের সংক্রামক ব্যাধি বিষয়ক প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ ঝং ন্যানশ্যানও করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘এই সংক্রমণ প্রথম দেখা গেছে চীনে। কিন্তু এর উৎপত্তি চীনে না-ও হতে পারে।’ বৃহস্পতিবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিভাগের প্রধান হুয়া চুনইংও রেডফিল্ডের ওই বক্তব্য টুইটারে প্রকাশ করেছেন। তিনি এরপর লিখেছেন, এই ভাইরাসকে চীনা করোনা ভাইরাস হিসেবে আখ্যা দেয়া সম্পূর্ণ ভুল ও অযৌক্তিক। প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কয়েকজন রক্ষণশীল আইনপ্রণেতা ও মার্কিন প্রশাসনের কর্মকর্তারা এই ভাইরাসকে ‘চাইনিজ ভাইরাস’ বা ‘বিদেশি ভাইরাস’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দৃশ্যত ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে এই প্রচারণা শুরু করেছেন চীনা কর্মকর্তারা। অর্থাৎ পরস্পরকে দোষারূপ করেই চলেছেন।
চিনারা প্যাঙ্গোলিনের মাংস খায়, সেখান থেকেই করোনা ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা প্রকাশ !
এর আগে বাদুড়কে করোনা ভাইরাসের বাহক হিসেবে সন্দেহ করছিল গবেষকরা। অনেকে আবার মনে করেন, বাদুড় ও অন্য কোন প্রাণীর মাধ্যমেই মানুষের শরীরে ঢুকেছে করোনা ভাইরাস। এবার সামনে এলো আরও এক নতুন তথ্য। প্যাঙ্গোলিন থেকে ছড়িয়ে থাকতে পারে এই ভাইরাস। সম্প্রতি ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে একটি গবেষণাপত্র। সেখানেই উঠে এসেছে এই চমকপ্রদ তথ্য। চিনের বাজারে বিক্রি করা হয় এই প্যাঙ্গোলিন। চিনারা একে খাবার হিসেবেও খায়া, আবার ওষুধ তৈরির কাজেও এটি লাগে। এই প্রাণীর দেহেই করোনা ভাইরাস থাকতে পারে বলে অনুমান করছেন অনেকের।
জাতিসংঘের হুশিয়ারীঃ
মহামারি করোনা ভাইরাসে (কোভিড-১৯) গোটা বিশ্বে প্রায় নয় হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রাণঘাতী ভাইরাসটির থাবায় বিশ্বব্যাপী কর্ম হারাতে যাচ্ছেন আড়াই কোটি মানুষ বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ।
ইরানি বার্তা সংস্থা পার্স টুডে জানায়, বুধবার (১৮ মার্চ) বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর করোনা ভাইরাসের প্রভাব মূল্যায়ন করতে গিয়ে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাগ (আইএলও) একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের প্রভাবে গোটা বিশ্বের প্রায় আড়াই কোটির অধিক লোক নিজেদের কর্মসংস্থান হারাতে পারেন।
আইএলও জানিয়েছে, করোনা ভাইরাস আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দা ২০০৮ সালের পরিস্থিতিকেও ছাড়িয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ বেকার হয়ে যাবেন এবং শ্রমজীবী শ্রেণির লোকের আয় মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে। মূলত এসব কারণে পরিস্থিতিটি মোকাবিলায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিটি রাষ্ট্রকে এখনই যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, উৎপত্তিস্থল চীনের সীমা অতিক্রম করে এর মধ্যে বিশ্বের অন্তত ২১০ টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস। বিশ্বব্যাপী ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১৬ লাখ ২৫ হাজার মানুষ। আর করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যাও এরই মধ্যে ৯৬ হাজার ৯৬৭ জনে পৌঁছেছে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, করোনা ভাইরাস মানুষ ও প্রাণীদের ফুসফুসে সংক্রমণ করতে পারে। ভাইরাসজনিত ঠান্ডা বা ফ্লুর মতো হাঁচি-কাশির মাধ্যমে মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ছে এই ভাইরাস। ভাইরাসটিতে সংক্রমিত হওয়ার প্রধান লক্ষণগুলো হলো- শ্বাসকষ্ট, জ্বর, কাশি, নিউমোনিয়া ইত্যাদি। তাছাড়া শরীরের এক বা একাধিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিষ্ক্রিয় হয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে।
বর্তমানে সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো ভাইরাসটি নতুন হওয়ায় এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। ভাইরাসটির সংক্রমণ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় সংক্রমিত ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকা। তাই মানুষের শরীরে এমন উপসর্গ দেখা দিলেই দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা।