মাইকেল বাকুনিন কর্তৃক প্রণীত
ঈশ্বর এবং রাষ্ট্র
ভাষান্তরঃ এ কে এম শিহাব
[১৮১৪-১৮৭৬]
ফরাসী সংস্করনের ভূমিকা
আমাদের মধ্যেই একজন বললেন আমি কিছু দিনের মধ্যেই মাইকেল বাকুনিনের জীবনের গল্প আপনাদের শোনাব, কিন্ত ইতি মধ্যেই আমরা তাঁর বিশেষ গুনাবলী সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্ব পূর্ন তথ্য পেয়ে গেছি। তাঁর যারা বন্দ্বু এবং যারা শত্রু সকলেই জানেন যে, তিনি চিন্তার জগতে তিনি একজন ধীর স্থির প্রকৃতির শক্তিশালী মানুষ; তারা এটা ও জানেন যে, তাঁকে অপমান অপদস্ত করলে ও তিনি অপমানকারীদের সম্পদ, পদ পদবী, গৌরব দেখেন এবং একজন মানুষ হিসাবে তাঁদের অপমানকে বিনোদন হিসাবেই গ্রহন করে থাকেন। তিনি এক জন রাশিয়ান ভদ্রলোক হিসাবে বিবাহের সূত্রে সম্রাট পরিবারের সাথে যুক্ত হন, যার মাধ্যমে বিদ্রোহীরা প্রথম অভিজাত পরিবারে অনুপ্রবেশের সুযোগ পায়, যারা ইতিমধ্যে ঐতিহ্য, জাতি, শ্রেনী স্বার্থ ত্যাগ করে আরাম আয়েশ বর্জন করে বেড়িয়ে এসেছেন। তিনি তাঁদের সাথেই যুক্ত হয়ে বিপ্লবী লড়াইয়ে লিপ্ত হন। ফলে রাজ শক্তির দ্বারা কারাগার বরন, নির্বাসন, ও সকল প্রকার দুঃখ যন্ত্রনা মেনে নেন। জীবনের সকল বিলাশিতা ত্যাগ করে কঠিন জীবন বেঁচে নিয়েছিলেন মাইকেল বাকুনিন।
মাইকেল বাকুনিনের জীবনাবসানের পর ব্যারনদের কবরস্থানে সমাহিত করা হলে ও তাঁর কবরের পাশে একটি অতিসাধারন পাথরে তাঁর নাম খুদাই করে রাখা হয়েছে। তাঁর মত এমন একজন মহান ব্যাক্তিকে যে সম্মান দেয়া হয়েছে তা খুবই নগন্য । এর তুলনায় একজন সাধারন কর্মীকে অনেক বেশী সম্মান প্রদর্শন করা হয়ে থাকে। নিশ্চিত করেই বলা যায় যে তাঁর বদ্বুরা ও তাঁর জন্য কোন বিশাল স্মৃতি স্তম্ভ নির্মান করবেন না। তারা জানেন হাসি মূখে তাঁর স্মৃতিচারণ করলে এবং তাঁর প্রদর্শিত পথে কাজ করে গেলেই তিনি সম্মানিত হবেন। তবে এই কাজ টি এখন জটিল হয়ে উঠেছে। বর্তমান তরুন প্রজন্ম বিপ্লবের জন্য পরিশ্রম করতে তেমন আগ্রহী নয়। তাঁদের মাঝে বিপ্লব নিয়ে আগ্রহ ও অবেগ অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত।
রাশিয়ার ছাত্র ছাত্রী, জার্মানীর যোদ্বা, সাইবেরিয়া, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড এবং ইটালীতে যারা নির্বাসত হয়ে ছিলেন তাঁদের মধ্যে মাইকেল বাকুনিনের ব্যাপক প্রভাব ছিলো। তাঁর চিন্তার মৌলিকত্ব, বিপ্লবী লিখনী, সুন্দর ও আকর্শনীয় বর্ননা বাকুনিনকে সেই সময়ের সকল বিপ্লবী দল ও গ্রুপের নিকট জনপ্রীয় করে তুলে ছিলো। তিনি প্রায় সকলের নিকটই সমাদৃত ছিলেন। তবে আদর্শগত ভাবে কিছু পার্থক্য ও পদ্বতিগত কিছু ভিন্নতা বিদ্যমান ছিল। তাঁর যোগাযোগ কৌশল ছিলো সত্যি মোহনীয়, তিনি বিপ্লবীদের নিকট অনেক লম্বা লম্বা পত্র দিতেন, কিছু কিছু পত্র বিপ্লবী বন্দ্বুদের জন্য পাথেয় হিসাবে কাজ করত, তাঁদের জড়তা দূর করে অধিক সক্রিয় করে তুলত। তাঁর চিঠি পত্র প্রচারনার অস্ত্র হিসাবে কাজ করত যা বিপ্লবী বন্দ্বুদেরকে অন্যায়ের বিরুদ্বে বিদ্রোহ করতে উৎসাহিত করত। বাকুনিনের আরো একটি উল্লেখযোগ্য কাজ ছিলো, তিনি অনেক গুলো ক্ষুদ্র পস্তিকা রাশিয়ান, ফ্রান্স, ইটালীয়ান ভাষায় তৈরী করে প্রচার করতেন। যা বিপ্লবী বন্দ্বুদের জ্ঞান ও চেতনাকে শানিত করত।
‘ঈশ্বর ও রাষ্ট্র’- নামক বইটি মূলত কিছু চিটি পত্র ও প্রতিবেদনের সমাহার। বাকুনিনের অন্যান্য বই ও রচনা সমূহ এই ভাবেই প্রনিত হয়েছে। তাই, এতে ও কিছু সাহিত্যগত সমস্যা বা সিমাবদ্বতা রয়েছে, রয়েছে কিছু ভাগ বিভাজন ও বিন্যাসের সমস্যা; আর আছে ধারাবাহিকতা রক্ষার না করতে পারার অক্ষমতাঃ আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি প্রতিটি বিষয়ের মৌলিকত্ব ও মুল সূত্র আবিস্কার করে তুলে ধরতে। বাকুনিনের নিকট কোন সময়ই সামগ্রীক কর্ম সম্পাদনের পর্যাপ্ত সময় ছিলনা । তিনি যখনই কোন কাজ প্রায় শেষ করে এনেছেন তখনই অন্য আর একটি কাজের সূচনা হয়ে যেত। যারা তাঁর লিখার সমালোচক তিনি তাদেরকে বলেছেন, এই গুলো “ আমার জীবন ও কিছু লিখার প্রয়াস”। যাই হোক, প্রাকশিত বাকুনিনের লিখা “ঈশ্বর ও রাষ্ট্র” বইটি পড়ে কোন পাঠক হতাশ হবার কোন কারন নেই। এতে যুক্তি সহকারে দার্শিনিক বিষয় সমূহ প্রাঞ্জলতার সাথে আলোচিত হয়েছে। তিনি তাঁর বিরুধীদের সামনে তাঁদের বিশ্বাসের অসারতা ও ঐশ্বরিক নির্দেশনার অকার্যকারিতা সুন্দর ভাবে পেশ করে দেখিয়েছেন। তিনি সকলের সামনে প্রমান করে দেখিয়েছেন যে সকল সরকারই মূলত মানব সৃষ্ট। তিনি ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে দেখিয়েছেন, সাধারন মানুষের ক্ষমতাকে যত খাট করে দেখানো হোক না কেন সত্যিকার ভাবে মানুষের শারিরিক শ্রেস্টত্ব, সহিংসতা, মহত্ব, সম্পদ ব্যবস্থাপনায় ক্ষমতাই অতুলনীয় । উদাহরন হিসাবে বলা যায় যে, ক্ষমতা করায়ত্ব করার জন্য যে নির্বাচনী ব্যবস্থা আবিস্কার করা হয়েছে তাতে ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলে ও অন্য আর কি ব্যবস্থা আছে যা সরকারে জন্য অধিকতর জ্ঞানগত ও সততা সম্পন্ন ?
অন্যদিকে, প্রজ্ঞানীগন ও তাঁদের মতামত দিয়েছেন, খাটি ও ভূয়া ‘জ্ঞানীগন’ তাঁদের নিজেদের মত করে দুনিয়ার ব্যাখ্যা দাড় করাবার প্রয়াস পেয়েছেন। আমরা তাঁদের কাজ কর্ম, তাঁদের উদ্যোগ দেখেছিঃ তাঁদের পড়া লিখার দৌড়ও আমাদের জানা; তাঁদের চিন্তার পরিধি প্রসারিত হয়নি, সংকির্ন মানসিকতা দিয়ে সমাজ, পরিবেশ প্রতিবেশকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের বাস্তব জ্ঞান খুবই সীমিত, তারা একটি পরিচিত দেয়ালের বাইরে যেতে অনাগ্রহী; শিশুসুলভ মানসিকতা তাঁদের মজ্জাগত বিষয়, তা নিয়ে এরা গর্বিত, কারন তারা কঠিন সত্যের মুখোমুখী হতে প্রচন্ড ভয় পায়। তা আমরা আমাদের দৈনিন্দিন জীবন যাত্রায় বা আলাপ আলোচনায় ও দেখে থাকি। তাঁদের মতামত হল, দুনিয়া সৃজন করা হয়েছে, সমাজকে নির্মান করা হয়েছে, বিপ্লবী কর্ম জাতিকে বিপদে ফেলে দেয়, রক্তাক্ত পরিবেশে রাজা বিদায় নেন, দারিদ্রতা, রোগ এবং মৃত্যু মানুষের জন্য স্বাভাবিক বিষয়, কেবল শিক্ষাবিদদের মধ্য থেকে অভিজাত শ্রেনীর জন্ম হবে, এরা ফুলে ফলে সুশোভিত হবে আর অন্য মানুষ তাঁদের জন্য কাজ করবে। তাঁদের ধারনা অনেক জাতিই মুর্খতা নিয়ে মারা যায়; অন্যান্যরা ও মারা যাবে, মৃত্যুই এদের চুড়ান্ত পরিণতি, কেবল ভদ্রলোকেরাই অমর হয়ে থাকবেন!
তবে আমরা গভীর প্রত্যয়ে বলতে পারি যেঃ রশি পুঞ্জের গিট আলেক্সজান্ডার ছাড়া আর কেহই কাটটে পারে নাই; অন্যান্যরা তলোয়ার হাতে তুলে নেবার চিন্তাই করে নাই। সরকার বিজ্ঞান ব্যবহার করে অনেক স্বর্গীয় কাজ ও সম্পদ সৃজন করেন। প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে অসাধ্য সাধন করে থাকেন। সকল ক্ষমতা তাঁর নিকটই কুক্ষিগত। মানুষ স্বাধীনতার মানসিকতা নিয়ে জন্ম গ্রহন করলে ও সে নিজেকেই পরিচালিত করতে পারে না; অথচ তারা জানে কি করে নিজেদেরকে চালাতে হয়। উপর থেকে যে সকল আদেশ নিষেধ নিচের দিকে করা হয়, সমাজ অনেক ক্ষেত্রেই তা মানতে আগ্রহী হয় না কিন্তু বাধ্য হয়ে আনুগত্য দেখায়, আবার বিরুধীতা ও করে এবং নিজেকে তা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এইভাবে, বিপ্লব ও নতুন প্রক্রিয়ায় সামনে এগিয়ে যায়। সমাজ ভাঙ্গে, রাষ্ট্র ও ভাঙ্গে নয়া আইন প্রতিস্থাপিত হয়। এই পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাকুনিন বলেন, “মানবিক সুবিচার স্বর্গীয় বিধি বিধানের জায়গায় প্রতিস্থাপিত হবে”। ন্যায় বিচারের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জগতে যদি বিপ্লবীদের নিকট থেকে কোন সত্যিকার বিপ্লবীর নাম চাওয়া হয় তবে মাইকেল বাকুনিনের নাম ই প্রথম উচ্চারিত হবে।
কার্লু ক্যাপিরো ও এলেজি রিক্লোস