ঈশ্বর এবং রাষ্ট্রঃ মিখাইল বাকুনিন

ঈশ্বর এবং রাষ্ট্র

মিখাইল বাকুনিন (১৮১৪-১৮৭৬)

ভাষান্তর- সৌরভ দাস

অধ্যায় : এক

আসলে কারা সঠিক? ভাববাদীরা, না বস্তুবাদীরা? এরকম প্রশ্নে বিন্দুমাত্র দ্বিধা থাকা চলবে না। আমাদের নি:সন্দেহে বলতে হবে যে ভাববাদীরাই ভুল এবং বস্তুবাদীরাই সঠিক। বস্তু এবং ভাব সম্পর্কে প্রুধো ঠিকই বলেছিলেনÑ “ভাব একটা ফুল, যেটার শেকড় আবার বস্তুবাদী অবস্থার মধ্যে নিহিত।” অর্থাৎ ঐ শেকড়টি ছাড়া ফুলের কোন অস্তিত্ব নেই। সেজন্য মানবতা, বুদ্ধিবৃত্তি, নৈতিকতা, রাজনীতি, সামাজিক বিষয়াবলী সবই তাদের অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটা প্রতিফলন। অর্থনীতিটাই এখানে শেকড় অর্থাৎ বস্তু।

বস্তু আর ভাব না হয় বুঝলাম। কিন্তু মানবতা জিনিসটা কি আমরা বুঝি? এটা দিয়ে আসলে কী বুঝায়? মৌলিক বিজ্ঞানের সমস্ত শাখাসমূহ নিরপেক্ষভাবে এ মহান সত্যের সাথে সাথে একমত যে, মানবতা আসলে সর্বশেষ এবং সর্বোচ্চ উন্নয়নকেই বুঝায়। পৃথিবীর মানুষের ক্ষেত্রে আমাদের পশু প্রবৃত্তির সর্বোচ্চ প্রকাশকেই মানবতা বলে। এটা ঠিক যে, যে উন্নয়নকে আমরা মানবতা বলছি সেটারও নেগেশন রয়েছে। মানবতা জিনিসটি তাই এই উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষের মধ্যে পশু প্রবৃত্তিকেই প্রকাশ করে। তাই এই নেগেশনটা একদিকে যেমন র‌্যাশনাল অন্যদিকে তেমনি প্রাকৃতিক।

আমরা নিশচয়ই অ্যাডাম এবং ইভের কথা শুনেছি। হ্যাঁ, আমাদের প্রথম পূর্বপুরুষ, মানে অ্যাডাম এবং ইভ তারা গরিলা না হলেও গরিলার খুব নিকটবর্তী ছিলেন (যদি সঠিকভাবে ইতিহাস পর্যালোচনা করে বলি)। তবে দুটি মূল্যবান গুণ থাকার কারণে অন্য প্রজাতির প্রাণীর চেয়ে তাদের অবস্থানটা একটু উপরে ছিল। গুণ দুটি ছিল- চিন্তার ক্ষমতা এবং বিদ্রোহের ইচ্ছা। এই দুটি গুণ ইাতহাসে তাদের প্রগতিশীল ভূমিকাকে একত্রিত করে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর এবং মানুষের পশুত্বের ইতিবাচক উন্নয়নের নেগেশনকে প্রকাশ করে এবং ফলাফলস্বরূপ মানুষের মধ্যে মানবতার সৃষ্টি করে।

আমরা সবাই কম বেশি “বাইবেল” বইটির সাথে পরিচিত। বাইবেল বইটি বেশ মজাদার এবং একটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ বই। এটা আমাদের সব থেকে পুরনো মানব প্রজ্ঞার টিকে থাকার প্রমাণ। বাইবেলে খুব স্পষ্টভাবে নানান দু:খজনক মিথ পাওয়া যায়। বাইবেলের ঈশ্বর আসলে খুব ঈর্ষান্বিত, রক্তপিপাসু এবং হিং¯্র প্রকৃতির ছিলেন। তিনিই অ্যাডাম এবং ইভকে সৃষ্টি করেছিলেন। তবে তার যে কী উদ্দেশ্য ছিলসেটা বোঝা যায় নি। তিনি নানান ধরনের প্রাণী এবং ফলের গাছ সহ অ্যাডাম এবং ইভকে পৃথিবীতে পাঠান। কিন্তু পাঠালেও ঈশ্বর তাদের একটা শর্ত দিয়েছিলেন। যে গাছটিতে জ্ঞান পাওয়া যায় সে গাছটির ফল খেতে তিনি তাদের নিষেদ করেন। তিনি চান নি মানুষ সব জ্ঞান লাভ করে ফেলুক। কিন্তু তখনই আবির্ভাব ঘটলো শয়তানের। এই শয়তানই ছিল সেই ইতিহাসের একজন বিদ্রোহী এবং প্রথম মুক্ত চিন্তক। কারণ সে-ই প্রথম ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করে এবং জ্ঞানের ফলটি খেয়ে ফেলে।

তারপরে কি হয় আমরা অনেকেই হয়তো সে ঘটনা জানি। ঈশ্বর তখন শয়তানকে শাস্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ঈশ্বর শাস্তি দেন যে, “তুই এই অপরাধে প্রজন্মের পর প্রজন্ম জন্মাবি। তোর কোন মুক্তি হবে না।” আমাদের ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মতত্ত্ববিদরা এই ঘটনা খুব সংক্ষেপে স্পর্শ করেন কারণ এটি একদিকে যেমন কিম্ভুতকিমাকার অন্যদিকে অন্যায়ও বটে। তারা মানুষ কে বুঝানোর চেষ্টা করলন এটা ঈশ্বরের একটা রূপ মাত্র। তিনি কেবল প্রতিশোধ ও ক্রোধের ঈশ্বরই ছিলেন না, প্রেমেরও ঈশ্বর ছিলেন। তাদের ব্যাখ্যা মতে, কয়েক মিলিয়ন দরিদ্র মানুষের অস্তিত্ব ভোগ করার পর এবং তাদেরকে নরকে পাঠানোর পর ঈশ্বর কেন জানি হঠাৎ করে এই মানুষগুলোর প্রতি একটু দয়া বোধ করলেন। তখন তিনি তার একমাত্র পুত্র হিসেবে যীশুকে পৃথিবীতে পাঠান। কিন্তু কী এক পরিহাস এই মানুষগুলোই যীশুকে হত্যা করলো! যীশুর এই মৃত্যুটিই হলো খ্রিষ্টান ধর্মের রহস্যÑ মুক্তির রহস্য! আর এই রহস্যটাই খ্রিষ্টান ধর্মের ভিত্তি। কিন্তু দুঃখজনক বিষয়, ঐ ঐশ্বরিক পরিত্রাতা মানুষকে রক্ষা করতে পারেন নি। তিনি মানুষকে স্বর্গের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেখানকার সিট সংখ্যা তো সীমিত। আনুষ্টানিক নির্বাচিত কিছু মানুষ ছাড়া আর কেউই তো সেখানে যেতে পারেন না। বাকী বিশাল সংখ্যার মানুষকে  বার বার পৃথিবীতে আসতে হয় এবং নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। তাহলে সমাধানটা কি হলো? কিছুই না।

বরং আমরা দেখি ঈশ্বরকেই এই পৃথিবীর দায়িত্বভার কখনো তৃতীয় নেপোলিয়ন, কখনো প্রথম উইলিয়াম, কখনো অস্ট্রিয়ার ফার্ডিন্যান্ড কখনো বা আলেকজান্ডারের হাতে তুলে দিতে হয়েছে।

সাধু সন্ন্যাসীরা উনিশ শতক জুড়ে এরকম উদ্ভট শিক্ষা প্রচার করে গিয়েছিলেন। ইউরোপের পাবলিক স্কুলগুলোতে সরকারের আদেশে এই শিক্ষাগুলো প্রচার করা হতো। তারা বলতো এর মাধ্যমে নাকি তারা মানুষকে সভ্য করছে! আদৌতে এটা ছিল ঢাহা মিথ্যাটার।

মজার ব্যাপার হলো, ঈশ্বর নিজেই স্বীকার করেছিলেন যে শয়তান সঠিক ছিল। তিনি স্বীকার করেছিলেন জ্ঞান ও স্বাধীনতা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অ্যাডাম এবং ইভের সাথে সে প্রতারণা করেনি। কিন্তু সে অ্যাডাম এবং ইভকে ঐ নিষিদ্ধ ফলটি গ্রহণ করতে প্ররোচিত করেছিল।  বাইবেলে ঈশ্বর বেচারা আক্ষেপ করে বলেছিলেন- “শোনো, মানুষ ঈশ্বরের মত হয়ে গেছে। সে ভাল মন্দ সব জেনে গেছে। তাকে থামাও। নিষেদ করো ঐ ফলটি খেতে। নইলে সে আমাদের মত অবিনশ্বর হয়ে যাবে।”

এবার চলো এই মিথের প্রকৃত সত্যটি বুঝি। আসলে মানুষ নিজেকে নিজেই মুক্ত করেছে। সে নিজেই তাকে পশুপ্রবৃত্তি থেকে মুক্ত করে একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে। সে এই ক্রমাগত অমান্য করে এবং অবাধ্য হয়েই নিজেকে উন্নত করেছে। এর জন্য তাকে সহায়তা নিতে হয়েছে দুটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের। একটি চিন্তা এবং অন্যটি বিদ্রোহ। ঈশ্বর নামে কোন কিছু এখানে কোন সহায়তা করেনি।

এবার উন্নয়নের প্রসঙ্গে আসি। মূলত তিনটি উপাদানের উপর ভিত্তি করেই মানুষের উন্নয়ন বিচার করা যায়। হতে পারে তা ব্যক্তিগত কিংবা সামষ্টিক। উপাদান তিনটি হলো-

১.মানুষের পশু প্রবৃত্তি

২.চিন্তা

৩.বিদ্রোহ

এই তিনটির মধ্যে প্রথমটা সামাজিক এবং ব্যক্তিগত অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত। দ্বিতীয়টা বিজ্ঞান এবং তৃতীয়টি স্বাধীনতার সাথে সম্পৃক্ত। এখন যদি কোন ভাববাদীকে তার মহান বুদ্ধিমত্তা, তার মহিমান্বিত চিন্তা, তার সীমাহীন আকাঙ্খা এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলো তাহলে সবকিছুই তার কাছে নৈতিকভাবে ভুল কিংবা অপরাধসমান জিনিস ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না। সব ভাববাদীরাই এটাতে বিক্ষুদ্ধ হন। প্রশ্ন জিনিসটি তারা খুব একটা সহ্য করতে পারেন না।

বস্তুবাদীদের মতে, বস্তু স্বত:স্ফূর্ত এবং চিরকাল ধরে গতিশীল, সক্রিয় এবং বস্তু তার আভ্যন্তরীণ উপাদান দিয়েই গঠিত। কিন্তু উপাদান দিয়ে একটা বস্তু গঠিত হওয়ার বিষয়টি ভাববাদীদের কাছে নৈতিকভাবে একটা ভুল জিনিস! তারা এটাকে মানতে পারেন না। তাদের এই ভুল চিন্তার ফলাফলস্বরূপই পরে একটা স্টুপিড এবং কুৎসিত জিনিসের সৃষ্টি হয়। আর সেটিই হলো ঈশ্বর! যেটির সৃষ্টি হয়েছে বস্তুর ঠিক বিপরীতে গিয়ে। এই ঈশ্বর জিনিসটা সর্বোচ্চ অকর্মণ্যতা ছাড়া আর কিছুই প্রকাশ করে না। ঈশ্বরপন্থীরা তাদের চিন্তা দিয়ে মানুষের জীবন, বুদ্ধিমত্তা কেড়ে নিচ্ছে। যেগুলো দিয়ে আসলে বস্তুর মধ্যে গতির সঞ্চার হয় যেমন গতি সেটিকেও ঈশ্বরপন্থীরা কেড়ে নিচ্ছে। সকল ধরনের প্রাকৃতিক শক্তি, সম্পদ, সবকিছুকেই তারা তাদের বিমূর্ত শক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। তারপর ঈশ্বরের ভূমিকাকে খানিকটা পরিবর্তন করে ঈশ্বরপন্থীরা ব্যাখ্যা করা শুরু করলো যে ঈশ্বর আসলে কিছুই নন। তিনি কেবলই একজন শ্রেষ্ট জীব। তারা দাবি করলেন, ঈশ্বর নাকি ঘোষণা দিয়েছেন যে সত্যিকারের যা কিছু আমরা দেখছি, আমাদের পৃথিবী, বস্তু  এগুলো আসলে কিছুই না। সব কিছুই নাকি ঐ ঈশ্বর দিয়েছেন। এমনকি বস্তুর মধ্যেকার গতিও।

একজন মানুষ যেসব কারণে ঈশ্বর সংক্রান্ত চিস্তা দ্বারা আক্রান্ত হয় বইটির শেষের দিকে আমি সেসব ফ্যালাসিগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করবো। আসলে ঐ ফ্যালাসিগুলোই আমাদের ঈশ্বরকে এই পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা কিংবা এরকম কিছু ভাবার দিকে ধাবিত করে। যে কারণে ঈশ্বর সত্ত্বাটিও সব সময় পৃথিবীতে বর্তমান থাকে, প্রভাব বিস্তার করে পুরো বস্তু জগত জুড়ে। এখন আমি অন্য একটা বিষয় নিয়ে শুরু করছি। সেটি হলো উন্নয়ন।

বস্তুজগত এবং প্রাণীজগতের এই যে ক্রমাগত উন্নয়ন এটি সহজেই আমরা অনুমান করতে পারি। সরল থেকে জটিল, নিচু থেকে উঁচু, নিকৃষ্ট থেকে উৎকৃষ্ট এরকম স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়ায় এই উন্নয়নটি সম্পন্ন হয়েছে। এই উন্নয়ন অবশ্যই আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতা আমাদের মানসিক, বিশেষ করে সেরেব্রাল রিপ্রডাকশন সিস্টেমের ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে যার কারণে আমরা এতখানি উন্নত হয়েছি।

কিন্তু ভাববাদীরা এর ঠিক বিপরীতে যুক্তি করেন। অর্থাৎ মানুষের এই যে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এই উন্নয়নটি সাধিত হলো এটি তারা মানতে চান না। তাদের অবস্থান এই চিন্তার ঠিক বিপরীতে। তারা ব্যাখ্যাটা এমনভাবে দাঁড় করান যেটি উদ্ভট চিন্তা ছাড়া আর কিছু দাঁড়ায় না।  এটি এতদিনকার অভিজ্ঞতার মাধ্যেমে অর্জিত জটিল জিনিসকে সরল, উৎকৃষ্টকে নিকৃষ্ট, উচুঁকে নিচু এরকম করে ব্যাখ্যা করে। তারা শুরুই করে ঈশ্বর দিয়ে অর্থাৎ একটি ভয়ংকর পতনের মধ্য দিয়ে । তারা সবকিছুকে বস্তুর বাইরে নিয়ে যায়। মানুষ, জীব, জন্তু সব কিছুর অস্তিত্বকে তারা অস্বীকার করে। তারা পরিপূর্ণতাকে নিয়ে যায় অপরিপূর্ণতার দিকে। সমৃদ্ধ একটা জিনিসকে নিয়ে যায় শূণ্যতার দিকে। সঠিকতাকে নিয়ে যায় বেঠিকতার দিকে। আসলে কখন, কিভাবে এবং কেন এই ঐশ্বরিক, চিরন্তন, অসীম চিন্তাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এটা কোন ভাববাদী, ধর্মতত্¦বিদ, মেটাফিজিশিয়ান কেউই বুঝে ওঠা কিংবা ব্যাখ্যা করা কিছুই করতে পারেন নি। আর সব ধর্মই এরকম এককটি রহস্যের জালে আবৃত।

পবিত্র মানুষ, নবী, যীশুখ্রিষ্ট সবাই জীবনের জন্য এই ধর্মের অনুসন্ধান করে গেছেন। কিন্তু তারা যন্ত্রণা আর মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই সেখানে খুঁজে পান নি। অনেকটা প্রাচীন স্ফিংক্স এর মত। মানুষ এটা নিয়ে আতঙ্কে থাকতো কারণ মানুষ তখন এটা সম্পর্কে পরিষ্কার কিছু জানতো না। ঈশ্বর জিনিসটা অনেকটা এরকম। মানুষ এটা সম্পর্কে পরিষ্কার জানে না বলেই এটাকে ভয় পায় এবং বিশ্বাস করে। হেরাক্লিটাস এবং প্লেটো থেকে শুরু করে ডেসকার্টেস, লিবনিজ, কান্ট, ফিকটে, শিলিং, হেগেল, ভারতীয় দার্শনিক সবাই বিশাল বড় বড় ভলিউমের বই লিখেছেন। যেখানে তারা বিভিন্ন সুন্দর বিষয় এবং তাদের আবিষ্কৃত অবিনশ্বর সত্য সম্পর্কে বলেছেন। তবে লোকোত্তর  অনুসন্ধানের যে প্রধান নীতি মানে “রহস্য” সেটিকে তারা পরিত্যাগ করেছেন। সেটি তারা স্পষ্ট করে যান নি।  সিসিপাস তার অনুসন্ধানে দেখেছেন এই রহস্যের বিষয়টি আসলে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তবে বিভিন্ন গোঁড়া শিষ্যের কারণে বিষয়টি আমাদের সামনে অনাবৃত থাকবে। কারণ তারা প্রত্যেক মানুষকেই তাদের চেতনা দিয়ে বিজ্ঞান থেকে দূরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে।

এটা স্পষ্ট যে এই ভয়ংকর রহস্যটি অনির্বচনীয়। এটা কিম্ভুতকিমাকার। এই কারণেই কিম্ভুতকিমাকার যে এর কোন ব্যাখ্যা নেই। এটাও স্পষ্ট যে যে-ই এটার মধ্যে সুখ খুঁজে পায় তাকে অবশ্যই তখন যুক্তি পরিত্যাগ করতে হয়। তখন তার আলোচনা সমালোচনা সব ভেস্তে যায়। থেকে যায় কেবল ঐ স্টুপিড বিশ্বাস। এভাবেই একেকটা মানুষ এই স্টুপিড বিশ্বাসে আক্রান্ত হয়।

কিন্তু এখানে সাথে সাথে আরেকটি প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যায়- “কিভাবে একজন বুদ্ধিমান মানুষ এই রহস্যে বিশ্বাস করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে?” প্রশ্নটা খুবই স্বাভাবিক।

ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস খুব স্বাভাবিক বিষয়। এটা গ্রামের মানুষদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে শহরের প্রলেতারিয়েতদের তুলনায়। তবে কম বেশি দু জায়গাতেই এটি বিদ্যমান। মনে রাখতে হবে, মানুষজন এখনো বঞ্চিত এবং বিভিন্ন উপায়ে  সরকার তাদের বঞ্চিত করছে। কোন কারণ ছাড়াই তারা সরকারী বঞ্চনার স্বীকার হচ্ছে। প্রতিদিনের কাজের পর তাদের বিশ্রাম নেয়ার সময়টুকুও থাকে না। ঈশ্বরপন্থীরা এই সুযোগটি গ্রহণ করে।  তারা এমন ভাবে এই ধর্মীয় চিন্তাটি মানুষের মধ্যে প্রচার করে যে কোন প্রকার সমালোচনা ছাড়াই মানুষ ধর্মীয় চিন্তাকে গ্রহণ করতে বাধ্য থাকে। এই সংস্কৃতি ছোট বেলা থেকেই একটা শিশুর চারপাশে বিরাজিত থাকে এবং ধীরে ধীরে এটি তার মনের মধ্যে গেঁথে যায়। এক পর্যায়ে তা এসে অভ্যাসে পরিণত হয়।

এর পেছনে অবশ্য আরো একটা কারণ আছে। ইউরোপের কিছু সভ্য দেশের কিছু অর্থনৈতিক সংগঠন মানুষকে এই উদ্ভট বিশ্বাসের জন্য মানুষকে মারাত্মকভাবে নিন্দা করে থাকে। সমাধানের বিপরীতে সব বুঝে শুনে তারা মানুষকে দূরে ঠেলে দেয়। ফলে নিজেকে বুদ্ধিভিত্তিকভাবে, নৈতিকভাবে, সর্বোপরি বস্তুগতভাবে অনমন করে মানুষ নিজেকে জেলে বন্দী আসামীর মত মনে করে। এজন্যই এই অর্থনীতিবিদদের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। যদি আমরা এই অর্থনীতিবিদদের বিশ্বাস করি তাহলে আমরা একটা সংকীর্ণ চিন্তার মধ্যে বড় হবো এবং বুর্জোয়াদের থেকে কখনো নিজেদের মুক্ত করার চিন্তা করতে পারবো না। মুক্তির জন্য আমাদের সামনে সব মিলে তিনটি উপায় আছে। এর মধ্যে প্রথম দুইটা কাল্পনিক কিন্তু তৃতীয়তা বাস্তব। প্রথম দুইটা হল ড্রাম শপ এবং চার্চ। আর  তৃতীয়টি হলো সমাজ বিপ্লব। যদি আমি তৃতীয়টি করি তাহলে এটা সব থেকে বেশি কার্যকরী হবে। আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোর নিষ্টুর উপভোগ দূর করতে একমাত্র সমাজ বিপ্লবই পারে ড্রাম শপ এবং এবং চার্চগুলো বন্ধ করে মুক্তির একটা সমাধান দিতে।

এনে রাখতে হবে, যদিও মানুষের এই বিশ্বাসের পেছনে কোন নেই তবুও পৃথিবীতে তাদের একটা অধিকার আছে। তাই মানুষকে এরকম দোষারোপ করা ঠিক না। এই বিশ্বাসের মূল অনুসন্ধান করে তা উন্মোচন করা উচিত।

না হলে তখন আবার একটা শ্রেণী জনগণ বিশ্বাস করানোর জন্য ঈশ্বরের একটা রূপ তাদের সামনে উপস্থাপন করবে। তারা সকল পীড়ক, সকল নির্যাতক, সকল শোষক; যেমন- সাধু, সন্ন্যাসী, সৈনিক, অফিসিয়াল, পুলিশ সবাই ভলতেয়াররের বাক্যটির পুণরাবৃত্তি করবে- “ যদি ঈশ্বর না থাকে তাহলে ঈশ্বরকে আবিষ্কার করো। মানুষের অবশ্যই একটা ধর্মের প্রয়োজন আছে।” কারণ এটা একটা সেফটি ভালভের মত।

অবশেষে কেউ কেউ এই খ্রিষ্টীয় ডগমাটি সিরিয়াসলি নেয়। কেউই আর এটাকে পরিত্যাগ করার আর সাহস করে না। যদি তুমি সমালোচনা করতে যাও তারা তোমাকেও ধর্মের সমালোচনা করতে নিষেদ করবে। তারা সর্বত্র নাক উঁচিয়ে কথা বলবে।  তাদের সেই কিম্ভুতকিমাকার চিন্তাকে তারা শক্তভাবে ভাবে আঁকড়ে ধরবে। তাদের ঈশ্বর কেবল বীর্যবান কিংবা ক্ষমতাশালী নন, তিনি নিষ্ঠুর ঈশ্বর। এটা এমনই এক নিষ্ঠুর সত্ত্বা যা একই সাথে আবছা, স্বচ্ছ এবং মায়াময়। শূণ্যেই এটি হারিয়ে যায়। এটা অনেকটা মরীচিকার মত যা  কোন কিছু দূরীভূত করতে সহায়তা করে না। ঈশ্বরপন্থীরা এখনো বিশ্বাস করে ঈশ্বর শেষ হওয়ার সাথে সাথে সব শেষ হয়ে যাবে। তারা অনিশ্চিত, অসুস্থ আত্মায় আক্রান্ত। তারা বর্তমান সভ্যতার উপর তাদের মূল্যায়ন হারিয়েছে। তারা বর্তমান ভবিষ্যত কোনটির সাথেই নেই। তারা বুর্জোয়া এবং সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির মাঝামাঝি একটা স্থান ধারণ করে আছে। নিজের চিন্তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা কিংবা ইচ্ছা কোনটাই তাদের নেই। তারা কেবল তাদের সময় নষ্ট করে। এদেরই “বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রী” বলা হয়।

তাই তাদের নিয়ে কিংবা তাদের বিরুদ্ধে তাই আলোচনা করার প্রশ্নই আসে না। তারা আলোচনার মতো তেমন আহামরি কেউ নন।

তবে এখানে কিছু মহান মানুষ আছেন আমাদের বেশির ভাগই যাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না। তাদের জ্ঞানী মনে করেন। তাদের শক্ত মন, চিন্তা ভাবনা নিয়ে কেউই প্রশ্ন করার সাহস করেন না। খানিকটা সম্মানও করেন বটে।  আমি এদের মধ্যে শুধু কয়েক জনের নাম উল্লেখ করছি- মাজজিনি, মিখিলেট, কুইনেট, জন স্টুয়ার্ট মিল। তারা সকলেই ভাববাদের প্রচারক। বস্তুবাদের কেবল প্রতিদ্বন্দ্বী নন, এটা নিয়ে উপহাসও করেন যখন তখন। ফলে তাদের বিরুদ্ধে আমাকে অবশ্যই প্রশ্ন তুলতে হবে।

আমি এখানে যাদের কথা বললাম তারা কখনোই যুক্তির দিকে খুব একটা নজর দেন নি। তাদের কেউই চিন্তাকে  দার্শনিকভাবে স্থির করার চেষ্টা করেন নি। এজন্য তাদের প্রতি আমার প্রায়শই প্রশ্ন তুলতে ইচ্ছে করে যে, তারা কি দ্বন্দ্বগুলো দেখে ভয় পেতেন নাকি ইতিহাসে তাদেও মত জিনিয়াসদের(!) ব্যর্থতার দিকে তাকিয়ে হতাশ হতেন? নাকি তারা মনে করেছিলেন যে তাদেও চিন্তা যেহেতু সেটেল হয়ে গেছে তাহলে ওসব যুক্তি টুক্তি এবার থাক? হতে পারে এটা তাদের গোপনীয় কিংবা ব্যক্তিগত কোন বিষয়। কিন্তু সত্য ঘটনা হচ্ছে যে, তারা ঈশ্বরের অস্তিত্বের তত্ত্বগত আলোচনার বিষয়টিকে অবহেলা করেছেন । এই অবহেলা করে যেটা তৈরি করেছেন সেটা হলো প্রায়োগিক এবং প্রভাবগত কিছু বিষয়। এটাই তাদের কাছে মুখ্য। তারা ধর্মকে এমনভাবে আকৃতি দিয়েছেন যাতে সারা বিশ্ব কোন যুক্তি ছাড়া এটি গ্রহণ করে। এভাবে তারা নিজেদের সীমাবদ্ধ করে  রেখেছেন। সীমাবদ্ধ করে রেখেছেন প্রাচীন সৃষ্টি এবং ঈশ্বরের প্রতি বিশ্ববাসীর বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয়টিকেও।

কোপার্নিকাস এবং গ্যালিলিওর আগে সবাই বিশ্বাস করতো যে সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। সবাই কি তখন ভুল করে নি? দাস প্রথার থেকে প্রাচীন আর কি আছে? সম্ভবত নরমাংস ভক্ষণ প্রথা। তখন কি মানুষ ভুল করে নি? মোদ্দাকথা, ঐতিহাসিক সমাজ ব্যবস্থা থেকে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা পর্যন্ত সব জায়গায়ই শ্রম শোষণ হচ্ছে। কখনো দাস হিসেবে, কখনো ভুমিদাস হিসেবে, কখনো মজুর,  শ্রমিক হিসেবে এ শোষণ চলছেই।  চার্চ তাদের নিপীড়ন করছে নিপীড়ন করছে রাষ্ট্রও। যারা করছে তারা আবার সমাজের সংখ্যালঘু। তাহলে কি এই শোষণ এবং নিপীড়ন প্রত্যেক সমাজই তার উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছে? তাহলে ঈশ্বরকে চ্যাম্পিয়ন করে লাভটা কি হলো?

আসলে সত্য এবং ন্যায়বিচার হচ্ছে সর্বশেষ ইউনিভার্সাল বিষয়। এটাই মানুষের উন্নয়নের সবচেয়ে জীবন্ত বৈশিষ্ট্য। এর জন্য অবশ্য অনেককেই অনেক শাস্তি বরণ করতে হয়েছিল। মানুষও তাদের কম নির্যাতন করে নি। কিন্তু শেষ মেষ দেখা যায় এক পর্যায়ে এসে মানুষ তাদের চিন্তাই গ্রহণ করেছে।

ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরায় আমাদের কাছে বস্তুবাদী এবং সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী আশ্চর্যজনক কিংবা ভীতিকর কোন বিষয় নয়। আমাদের বিবেকের দৃঢ়তা, সত্যের প্রতি ভালবাসা, যুক্তির মত শক্তিশালী জিনিসের উপর আবেগ, ন্যায়বিচারের প্রতি আবেগ এবং মানবতার প্রতি আমাদের অফুরন্ত বিশ্বাস এসবের মাধ্যমে আমরা ঐতিহাসিক সকল ঘটনার প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত করেছি। মুক্ত করে আমরা সৃষ্টি করেছি সামাজিক আইন, প্রাকৃতিক আইন সহ অন্যান্য আইন যা পৃথিবীকে পরিচালনা করছে।

এই আইনটি যুক্তি সম্মত এবং এটা মানব সমাজে পশু প্রবৃত্তি সৃষ্টির ফলাফল। জার্মানদের ফ্রান্স দখল সহ আরো অনেক ঘটনা এর চাক্ষুষ প্রমাণ। এই পশু প্রবৃত্তিকে গ্রহণ করার সাথে সাথেই ইতিহাস আমাদের কাছে একটি বিপ্লবী নেগেশন হিসেবে আবির্ভূত হয়। মানুষ আজ সেই বন্য পশু, সেই গরিলার বংশধর থেকে, পশুত্বের অন্ধকার থেকে আলোর মুখ দেখেছে। তবে আলোর মুখ দেখলেও মানুষ এখন নতুন দাসত্বের স্বীকার। তারা এখন পশুত্বের দাসত্ব থেকে বের হয়ে ঐশ্বরিক দাসত্বের কবলে পড়েছে। এটা পশুত্ব এবং মানবিকতার মাঝামাঝি একটি স্তর। মানুষকে তাই এখনো ছুটতে হচ্ছে মানব মুক্তির পানে। আমাদের পেছনে পশুত্ব এবং সামনে মানবতা। এই মানবতাই একমাত্র জিনিস যেটা আমাদের আলোকিত করতে পারে। একমাত্র জিনিস যেটা আমাদের মুক্ত করতে পারে। আমাদের মর্যাদা, স্বাধীনতা, সুখ সব দিতে পারে।

তাই কখনো পেছনে তাকানো চলবে না। চলো, সামনে তাকাই। সামনে আলো, সামনেই মুক্তি। সামনে তাকাতে হবে এজন্যই যাতে আমরা বুঝতে পারি আমাদের কি আছে এবং কি হওয়া উচিত। আমাদের কি বিশ্বাস করা উচিত এবং কি নয়। আমরা কি করবো এবং কি করবো না। ইত্যাদি।

যেহেতু এটা এখন প্রতিষ্টিত যে মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে এর মাধ্যমে আমরা কেবল এই উপসংহারে পৌঁছতে পারি যে, ঐশ্বরিক ধারণা এক ধরনের ভ্রান্তি যেটা মানুষ তার উন্নয়নের জন্য আজ প্রয়োজনীয় মনে করছে। এখন আমাদের প্রশ্ন করা উচিত, কেন এটা ইতিহাসের পরিক্রমায় সৃষ্টি হয়েছে? এবং কেন পৃথিবীর বড় একটা অংশ সত্য হিসেবে এটাকে গ্রহণ করছে?

আমাদের সব সময় ভাবতে হবে যে কিভাবে এই আধ্যাত্মিক চিন্তাগুলো বিকাশ লাভ করলো। নইলে আমাদের বৈজ্ঞানিক অর্জন এটার কারণে ভেস্তে যাবে। এটা ছাড়া আমরা কখনো সংখ্যাগরিষ্টের মতামতকে ধ্বংস করতে পারবো না। তাহলে আমরা কখনো এটাকে গভীর থেকে আক্রমণ করতে পারবো না। এজন্য আমাদের প্রাণপণে এই সংগ্রামটা করা উচিত। এটা ভাবলে ভুল হবে যে এই অদ্ভুত চিন্তা, ঈশ্বরে বিশ্বাস এগুলো সমাজে ডালপালা গজাবে না। অবশ্যই গজাবে। আমরা কিছু না করলে আজ এই যুগে এসেও খ্রিষ্টান ধর্মের ধ্বংসস্তুপে উপর দাঁড়িয়েও এসব চিন্তÍা আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।

এখানে যে কেবল জনগণের স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে বিষয়টা সেরকম নয়। আমাদের মানসিক শান্তির জন্যও এটা করা দরকার। আমাদের এই ঐতিহাসিক জেনেসিস, ঈশ্বরের ধারণার বিকাশ এবং এর কারণ এগুলো সম্পর্কে বুঝতে হবে। না পারলে দেখা যাবে আমরা কেবল নিজেদের নাস্তিক দাবি করে বসে আছি। কিন্তু কখনো সেই সত্যটিকে বের করতে পারবো না। মনে রাখতে হবে আমরা সব সময় একটা হুমকির মধ্যে আছিÑ  ধর্মীয় কিম্ভুতকিমারদের দ্বারা আমাদের স্থান হারানোর হুমকি। এসব হুমকি বিভিন্ন জায়গায় কার্যকরও হচ্ছে। তাই প্রকৃত সত্যকে উন্মোচন করার কোন বিকল্প এখানে নেই।


Share Tweet Send
0 Comments
Loading...
You've successfully subscribed to Bangladesh ASF
Great! Next, complete checkout for full access to Bangladesh ASF
Welcome back! You've successfully signed in
Success! Your account is fully activated, you now have access to all content.