এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম এবং এনার্কো-কমিউনিজমঃ সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য
(bangladesh ASF)
আমাদের যে সকল নতুন কমরেডগন এনার্কিজম নিয়ে পড়া শুনা শুরু করেন তাঁরা প্রায়স প্রশ্ন করেন এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম ও এনার্কো- কমিউনিজমের মধ্যে পার্থক্য কি আছে। উভয়ই কি একেই রকম? তারা কি একে অন্যের বিপরিত কিছু ? কেহ কি এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্ট হতে পারেন – এনার্কো- কমিউনিস্ট না হয়েই, বা তাঁরা কি পরস্পর বিপরীত ধারা ? এই প্রশ্নের জবাব খোজতে গিয়ে আমরা প্রথমেই এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম ও এনার্কো-কমিউনিজমের মধ্যে মিল ও অমিল নিয়ে আলোচনা করব।
এনার্কো-কমিউনিজম
আমরা আলোচনাটা এনার্কো- কমিনিজমের জন্মের আগে থেকেই সূচনা করতে চাই। সেই সময়ে অনেক মানুষই “কমিউনিজম” শব্দের সাথে নির্দয় নির্মম রাস্ট্রবাদ এবং “একনায়কতন্ত্রের” সাথে পরিচিত ছিলেন। আর তখন এনার্কিজম বলতে হাঙ্গামা এবং গণ্ডগোল বুঝতেন। আর এই সকল শব্দের ভেতর সত্যিকার অর্থে কোন কমিউনিজম বা এনার্কিজম কিছুই ছিলো না । একটি চক্র পরিকল্পিত ভাবে তাঁদের স্বার্থে এই শব্দের অর্থ মন্দ ভাবে জনগণের মাঝে ব্যাপক ভাবে প্রচার করে। রাজনৈতিক প্রচারনা হিসাবে এনার্কিস্ট বলতে বোমাবাজ, সন্ত্রাসী, খুনী গণ্ডগোল সৃষ্টি কারী হিসাবে নানা মাধ্যমে প্রাচনা চালানো হয়েছে । কৌতুক হিসাবে সিনেমার ব্যাটম্যানকে ও “এনার্কিস্ট” বলা হয়েছে।
“কমিউনিজম” শব্দটির ক্ষেত্রে ও সেই রকম কিছু ঘটনা ঘটেছে। ১৯১৭ সালে যখন “বলশেভিক” পার্টি রাশিয়ার ক্ষমতা দখল করে নেয় তখন পশ্চিমাজগত এটাকে “কমিউনিজম” বলে প্রচার শুরু করেছিলো। রাশিয়ায় ক্ষমতা গ্রহনের পর থেকে স্ট্যালিনের আমল পর্যন্ত সেই বলশেভিক জোয়ার চলতে থাকে, আর সেই সময়ে চিন,কিউবা,ভিয়েতনাম এবং উত্তর কোরিয়া সহ নানা দেশে ক্ষমতার হাত বদল হয়। বলশেভিকগন নিজেদেরকে মার্ক্সবাদি বলে প্রাচার করলে ও আদতে রাশিয়াকে “কমিউনিস্ট” সমাজ বানাবার চেষ্টা করেনি। ১৯৩০ সালে স্ট্যালিন ক্ষমতা গ্রহনের পর রাশিয়াকে সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসাবে ঘোষণা করে বসেন। সমান্তরাল ভাবে কমিউনিস্ট পার্টিকে শাসক দলে পরিনত করে। তাঁরা বলেন সমাজতন্ত্রের অনুসরন করে ক্রমে কমিউনিজমে উন্নিত হবেন। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সময়কালে পশ্চিমা দুনিয়া কমিউনজমকে বদনাম দেবার জন্য নানা অপকৌশল অবলম্বন করে। রাশিয়ায় নামকা ওয়াস্তে কমিউনিজম ঠিকে থাকার চেষ্টা করে ও একসময় তাঁদের পতন হয়। তবে উত্তর কোরিয়া ও কিউবা তাঁদের সেই পথ ধরেই চলতে থাকে।
সত্যিকার রাজনৈতিক দর্শনটি বুঝার জন্য আন্দোলনের প্রতিটি স্তর ও বুঝে নেয়া দরকার। উনিশ শতকে এনার্কিস্ট আন্দোলনের আসল লক্ষ্য হলো পুঁজিবাদের বিলয় সাধন করা । সমাজকে এমন ভাবে বিনির্মান করা যেখানে পারস্পরিক সহযোগীতা সবিশেষ প্রাধ্যন্য পাবে । এনার্কিস্ট সমাজ গড়ে উঠবে “মুক্ত সমাজতান্ত্রিক” ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে। সেখানে কোন চাপিয়ে দেয়া নির্দেশনা থাকবে না। সমাজ কাঠামো হবে (হরিজন্টাল) দিগন্তস্থিত ধরনের। কেহ কারো অনুগত হবেন না। সকল সম্পদের মালিক হবেন সমাজের সকল লোক। কমিউনিস্ট আন্দোলনের ও আসল লক্ষ্য হলো উৎপাদন যন্ত্রের একটি সামাজিক সম্পর্ক প্রতিস্টা করা। একটি শ্রেনীহীন সাম্যবাদি স্বাধীন সমাজ কায়েম করা। তবে বলশেভিকগন এক সময় কমিউনিজমের বদলে স্ত্যালিনিজমের দিকে বেশী ঝোঁকে পড়েন। তাঁরা শাসক শ্রেনীর পক্ষে কাজ করতে গিয়ে শ্রেনীহীন সমাজ প্রতিস্টায় অধিক মনযোগ দেন নাই।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থার বিলোপনের পর উনিশ শতকে এনার্কিস্টগন স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মানের জন্য ঘোষণা দেয়। পিটার ক্রপথকিন সহ সকল এনার্কিস্ট চিন্তকগন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এরিকো মালাতিস্তা, এবং রুডলফ রকার “এনার্কিস্ট কমিমিউনিজম” কে রাজনৈতিক দর্শন হিসাবে তুলে ধরেন। তাই তাঁরা একটি নয়া সমাজ গড়ে তুলার জন্য এনার্কিস্ট কমিউনিজমকে জনপ্রিয় করে তুলায় প্রয়াস নেন ।
এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম
এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের উপর অনেক মোটা মোটা বোই লিখা যাবে। তবে এখানে আমাদের উদ্দেশ্য হলো সাধারন ভাবে উভয়ের পার্থক্য সমূহ বোঝা। এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম মূলত উনিশ শতকের শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর সূচনা লগ্নে বিকশিত হয়েছে। বিশেষ ভাবে ফ্রান্সে সি জি টি গঠন করে বিংশ শতাব্দিতে শ্রমিক শ্রেনীর ইউনিয়নবাদের সূচনা করে। প্রথম বিশ্ব যুদ্বের ধাক্কা লাগার পর ও এটা আন্তর্জাতিক ভাবে শ্রমিক শ্রেনীর পক্ষে স্বীয় প্রচার প্রপাগান্ডা চালিয়ে এসেছে। এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম রাজনৈতিক আদর্শ হিসাবে দুনিয়ার নানা স্থানে ভূমিকা পালন করেছে। শ্রেনী সংগ্রাম কে সিন্ডিক্যালিজম নামে অভিহিত করে কর্মজীবী মানুষের পক্ষে নয়া সমাজ বিনির্মানের জন্য কাজ করেছে ।
পার্থক্য সমূহঃ
এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমকে আমরা অনেকেই যে ভাবে বুঝে থাকি, অবার এনার্কো- কমিউনিজমকে ও সেই ভাবে বুঝে থাকেন কেহ কেহ। অনেক জায়গায় পুঁজিবাদের পরবর্তী স্তরে এনার্কিস্ট কৌশল গ্রহনের জন্য অনেকেই পরামর্শ দেন। যদি ও দুটি মতবাদের মধ্যে মৌলিক ভাবে পরস্পরের মধ্যে একটি যোগ সাজশ আছে তবু এদের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট ভাবে পরিলক্ষ্যিত হয়। দৃশ্যতঃ এরা পরস্পর বিপরীত ধারার মতবাদ। এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের প্রতিস্টাতা রুডলফ রকার, এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের প্রতিস্টার আগে একজন এনার্কিস্ট কমিউনিস্ট ছিলেন। যা তিনি তাঁর গ্রন্থ “এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমঃতত্ত্ব ও প্রয়োগ” উপস্থাপন করেছেন। এনার্কিস্ট কমিউনিস্ট পিটার ক্রপতকিন তাঁর গ্রন্থ “ মুক্ত স্বাধীন সাম্যবাদে” সিন্ডিক্যালিজমকে একটি প্রয়োগ পদ্বতি হিসাবে দেখিয়েছেন। আমি প্রথমে আধুনিক এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজকে আন্তর্জাতিক ভাবে একটি “স্বাধীন সাম্যবাদী” সমাজ হিসাবে বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্যায়ে দেখাতে চাই একটি অন্যটির পরিপূরক ।
এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের জন্য এনার্কো-কমিউনিজমের দরকার
এনার্কো-কমিউনিস্ট না হয়ে কেহ এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্ট হতে পারবেন না। আর এনার্কো –সিন্ডিক্যালিজমের চর্চার ভেতর দিয়েই কেবল এনার্কো-কমিউনিজম কায়েম করা যেতে পারে। এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম হলো মক্ত স্বাধীন সাম্যবাদ কায়েমের একটি কৌশল মাত্র । মুক্ত স্বাধীন সাম্যবাদের আদর্শ হলো তৃনমূল থেকে সংগঠন কায়েম করে উঁচু স্তর পর্যন্ত একটি শ্রেনীহীন সমাজ কায়েম করা। যেখানে থাকবে প্রশাসন ও উৎপাদন যন্ত্রের যৌথ মালিকানা । ঐতিহাসিক ভাবে এনার্কিস্টগন মুক্ত স্বাধীন সাম্যবাদী ধারাকে কমিনিস্ট বিরুধী আদর্শ হিসাবে দেখেছেন। প্রথমেই নিজেদেরকে একজন কমিউনিস্ট ধারার বাহিরের রাজনৈতিক কর্মি হিসাবে দেখিয়েছেন। পি জে, প্রুধু, স্বাধীন মুক্ত সাম্যবাদের যৌথভাবে যে মালিকানা গড়ে উঠবে তাতে নিজেরা নিজেদের মধ্যেই বেচা কেনা চালু রাখার কথা বলেছেন। এনার্কিস্ট চিন্তকগন প্রশ্ন তোলছেন, “পুঁজিবাদের বিপরিতে কি ধরনের মতবাদ চর্চা করা যায়। বিপ্লবের পর সাম্যবাদের জন্য কি কি কৌশল অনুসরন করা যেতে পারে?”
এই পরিস্থিতিতে এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের বিজয় নিশ্চিত করা দরকার। প্রুধুর মতবাদ ছিলো যৌথ উৎপাদন ব্যবস্থায় যৌথ ভাবে সকল কিছুর ব্যবস্থা চালু করা হবে- তা সাম্যবাদ না ও হতে পারে। ব্যাক্তিগত ও যৌথ খামার এবং কারখানা উৎপাদন এবং বেচা কেনা চলবে। এই পরিকল্পনা অন্য দুজন চিন্তক বলিন এবং ম্যারমূল নাকচ করে দিয়েছেন। তাঁরা বলেছন মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এবং মুক্ত সাম্যবাদী সমাজ কাঠামো নির্মান এই প্রক্রিয়ায় সম্ভব নয়। কেবল তৃনমূল থেকে গড়ে উঠা সমবায় সমিতির নিজস্ব প্রচেস্টায়ই এইধরনের সমাজ কায়েম করা যেতে পারে। যেখানে যৌথ উৎপাদন ও বন্ঠন প্রক্রিয়া চালুর ভেতর দিয়ে নয়া সমাজ গড়ে উঠতে পারে। যাকে আমরা- কমিউনিজম বলি।
এনার্কো-কমিউনিজমের জন্য এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম দরকার
কোন ব্যাক্তি এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্ট না হয়ে এনার্কো- কমিউনিস্ট হতে পারবেন না। উদাহরন হিসাবে ইংল্যান্ডের এনার্কিস্ট ফেডারেশনের কথা বলা যায়। তাঁরা শ্রেনী সংগ্রামের ক্ষেত্রে এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমকে নাকচ করে দিয়েছেন। বিপ্লবী এনার্কিজমের জন্য এটি একটি বাঁধা। তাঁরা এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজকে নাকচ করেন ই বলে যে ইউনিয়নের সাথে পুজিবাদিরা বোঝা পড়া করে নিজেদেরকে মিমাংসার জায়গায় নিয়ে যেতে পারে। এই প্রসঙ্গে এমা গোল্ডম্যান বলেন, “ পুরাতন ইউনিয়ন এবং এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো, কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া এরা মজুরীর জন্য সংগ্রাম আর পুঁজিবাদের বৃত্তেই আবর্তিত হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ও বাধ্য করে। তবে সিন্ডিক্যালিজম এই অবস্থাকে প্রত্যাখান করে প্রচলিত শিল্প ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে নয়া ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে বিপ্লবী ভূমিকায় এগিয়ে যায়। (১)
তিনি আরো বলেন, “ সিন্ডিক্যালিজম অবশ্যই পুরাতন ইউনিয়ন গুলোর মত মজুরী লড়াই করলে ও মুর্খের মত শ্রমিকদের বর্তমান অমানবিক ব্যবস্থাকে মেনে নেবে না। বরং নয়া সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যায়। এটা শত্রুদেরকে পরাজিত করে কারখানা ও খামার থেকে সকল প্রকার মজুরী প্রথার উচ্ছেদ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ব”।(২)
এনার্কিস্ট কমিউনিজম হলো এনার্কিস্ট ধারার একটি পথ ও পন্থা। যা কেবল স্বীয় সংঠনের মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির পথ নিশ্চিত করতে চায়। পুঁজিবাদের বিলয় ঘটাতে বদ্বপরিকর। শ্রমিক শ্রেনীর নিজস্ব সংগঠন কায়েম করে নিজেদের লড়াই নিজেরাই লড়তে চান। আর সামাজিক নিয়ন্ত্রন গ্রহন করে, সমাজিক যৌথ প্রচেস্টায় পরিচালনা করতে চান। এবং মুক্ত স্বাধীন সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চান। এই গুলো হলো বিপ্লবী শ্রমিক সংগঠনের লক্ষ্য। যখন বিপ্লবী শ্রমিক ইউনিয়ন বিপ্লবী কর্ম কান্ড গ্রহন করে সামাজিক পরিবর্তন সাধন করতে চায় –তখন তা এনার্কো-সিন্দিক্যালিজমে পরিনত হয়।
উপসংহারঃ
এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম এবং এনার্কো-কমিউনিজম হলো দুটি স্পষ্ট তত্ত্ব এবং অনুশীলন। তবে তাঁদের মধ্যে কোন বিরুধ নেই। বরং এরা একে অন্যের পরিপূরক মাত্র। এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমকে মুক্ত-স্বাধীন সমাজবাদ কায়েম করতে হলে তাদেরকে অবশ্যই এনার্কো-কমিউনিজম কায়েম করতে হবে। চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো স্বাধীন সাম্যবাদ- আর সেই জন্য এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম আন্দোলন জোরদার করতে হবে। আর সেই করনেই ঐতিহাসিক ভাবে এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের বেশীর ভাগ অনুসারীগন ছিলেন এনার্কো-কমিউনিস্ট ভাবধারার। এরা একে অন্যের সহযোগী।
Notes:
1. Syndicalism: The Modern Menace To Capitalism, Emma Goldman
2. ibid.
Bibliography:
Fighting For Ourselves, Solidarity Federation
Anarcho-syndicalism In The 20th Century, V. Damier
Communism and Anarchy, Peter Kropotkin
Note On Individualism and Anarchism, E. Malatesta
Property Is Theft, Pierre Joseph Proudhon
Anarchism Without Adjectives (1890), Robert Graham
Anarchist Synthesis, Volin
Introduction To Anarchist Communism, Afed