এ কে এম শিহাব অনূদিত গ্রেগরী পেট্রোভিচ ম্যাক্সিমফ প্রণীত প্রোগ্রাম অব এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম পুস্তকের ধারাবাহিক-৭

এ কে এম শিহাব অনূদিত গ্রেগরী পেট্রোভিচ ম্যাক্সিমফ প্রণীত প্রোগ্রাম অব এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম পুস্তকের ধারাবাহিক-৭

দ্বিতীয় বিভাগঃ রাজনৈতিক পরিমন্ডল

অধ্যায়ঃ ২ । জাতীয়তা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কঃ

জাতিগত অধিকার নিজেই কোন নীতি নয়, বরং এটা হলো স্বাধীকারের একটি নীতি মাত্র। কোন জাতী বা জাতীয়তা প্রাকৃতিক সংস্থা নয়, বরং এতে ব্যাক্তিদের সাধারন ভাষা একটি মৌলিক উপাদান হিসাবে কাজ করে, আর এসব বিষয় গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠে পুঁজিবাদ ও রাস্ট্রের বিকশিত হবার প্রয়োজনে। শক্তিশালী জাতি গুলি দুর্বল জাতিসমূহকে পরাজিত করে তাদেরকে আত্মীকরনের চেস্টায় লিপ্ত হয়। জাতীয় গৌরবের প্রচারের আসল মতলবই হলো রাস্ট্র ও পুঁজিবাদের ক্ষেত্রভুমি প্রস্তুত করা। শাসক শ্রেনী সকল সময়েই ভাড়াটে শক্তি ব্যবহার করে জাতিতে জাতিতে ঘৃনা ও দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটায়, দেশ প্রেমের শ্লোগান তোলে মানুষকে মারমূখী করে দেয়- এই সকলের পেছনে ও রাস্ট্র এবং পুঁজিবাদ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অপকর্ম করে যায়।

তথাকথিত জাতীয় স্বার্থ, যা এখন রাস্ট্রীয় দৃষ্টিকোন থেকে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। ফলে জাতি সমূহের মাঝে পারস্পরিক ঘৃনার উদ্রেক হয়ে তা যুদ্বে রূপ নিচ্ছে। পুজিবাদি রাস্ট্র সমাজ সমূহে এখন এই বিষয় সমূহ সাধারন সমস্যার অংশমাত্র হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। যেমন – কোথাও কোথাও  স্বাধীনতার সমস্যা ইত্যাদি। যা কেবল শ্রমিক শ্রেনীর স্বার্থে তা সমাধান করা যাচ্ছে না ।

" একটি জাতির স্ব সিদ্বান্ত গ্রহনের অধিকার" এবং স্বাধীন সার্বভৌম অস্তিত্বের জন্য, জাতীয় বুর্জোয়াদের অধিকার তাকে তার সর্বহারা শ্রেণীর সীমাহীন শোষণের অধিকার ছাড়া কিছুই দেয় না; একটি বহু-জাতীয় দেশে এই অধিকারের প্রকৃতীকরণ যা সামাজিক বিপ্লবের ব্যানারকে  উর্ধে তোলে ধরে এবং এভাবে পুঁজিবাদের দ্বারা নিজেকে ঘিরে ফেলে, আসলে বিপ্লবের বিরুদ্ধে জাতীয় বুর্জোয়াদের আত্মরক্ষার অধিকারের স্বীকৃতি আদায় করা  আন্তর্জাতিক বুর্জোয়াদের অস্ত্র। ১৯১৭ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে রাশিয়ান বিপ্লবের অভিজ্ঞতার দ্বারা এটি দৃঢ়ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। "জাতীয় স্ব-সংকল্পের অধিকার" এর উপলব্ধি থেকেই স্বতন্ত্র স্বাধীনতার উপলব্ধি  আসে- অন্যান্য  জাতীয়তাগুলির মাঝে ও  – এসব কিছু থেকে  যদিও শোষিত শ্রেণীগুলি তাদের জন্য অভিজ্ঞতা লাভ করে খুবই সামান্য ।

অধিকন্তু, “প্রতিটি জাতির স্বীয় স্বাধীকারের অধিকারের সুরক্ষা ”- এই শ্লোগান এবং সেই ভাবে যৌক্তিক ভাবে সিদ্বান্তের দিকে এদিয়ে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়ত প্রজাতন্ত্রের এই বিষয়টি অনেকেই গভীর ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তাঁরা একটি বহুজাতিক রাস্ট্র বিনির্মানের জন্য হাত দেন। আর এসব কিছুর ভেতর দিয়ে প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর স্বার্থ, স্বাধীনতা, ও সামাজিক বিপ্লবের পথকে প্রশস্ত করতে চেয়েছিলেন।

ভুলবুঝার কোন অবকাশ নেই যে এনার্কিস্টগন জাতীয় স্বাধীনতার বিরুধী। এটা স্পস্ট যে এনার্কিস্টগন সকল সময়েই নিপিড়িত নির্যাতিত জাতী সমূহের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করে। তাদের নিকট জাতীয় সমস্যাকে একটি ব্যাক্তির জীবন মরনের মতই গুরুত্বপূর্ন বিষয় বলে বিবেচিত হয়। এটার প্রাকৃতিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক বিষয়ে কথা বলা ও সমর্থন জানানো একটি গুরুত্বপূর্ন নীতি হিসাবে সকলেরই বিবেচিত হওয়া দরকার । একটি জাতি বড় হোক বা ছোট হোক, তার সংস্কৃতি যতই সমৃদ্ব হোক বা  না হোক তার অধিকার আছে এটাকে ধারন করার, চর্চা করার, এটা নিয়ে কথা বলার – তাদের সেই অধিকারে হস্তক্ষেপ করা সমীচীন নয়। আসল কথা হলো জাতীয় অধিকার বলতে- নিজেদের মত চলার অধিকার;  সেই ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পরিবেশের নীতি অনুসারে স্বাধীকার ও সাম্যের নীতি বহাল রাখাকে নিশ্চিত করা বুঝায় ।

জাতিয়তা নিজে কোন নীতি নয় কিন্তু এটা একটি বাস্তবতা। কিন্তু এটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আন্দোলনকারী লোকেরা যখন জাতীয়তার উপর বেশী গুরুত্ব আরোপ করেন তখন তা অপরাধ হিসাবে গন্য হয়। এনার্কিস্টগন কখনই এই সংকির্ন জাতীয়তাবাদি চেতনায় কাজ করবে না। “ যাদের কথাই হলো আমাদের জাতীই শ্রেস্ট, আমরাই দুনিয়ার কেন্দ্রবিন্দু,আমাদের মহানত্ব দিয়ে সকলের উপর প্রভাব বিস্তার করব”- এরূপ বক্তব্যের সাথে  এনার্কিস্টগনের কোন প্রকার সম্পর্ক নেই।  আন্তর্জাতিক স্বাধীণতা এবং সাম্য ও ন্যায় বিচার হলো সকল জাতীয় স্বার্থের চেয়ে গুরুত্বপূর্ন।  তারা অল্প সময়ের জন্য স্বাধীনতার সাধ পাক বা না পাক জাতীয় স্বার্থের বাইরে আসতে চায় না । প্রতিটি রাস্ট্রই হলো স্বাধীনতা ও সাম্যের শত্রু। জাতীয়তাবাদের শ্লোগান দিয়ে যখন দেশ অন্যেদের প্রভাব থেকে মুক্ত করা হয় তখন দেখা যায় রাস্ট্র গঠনের পর পর ই তাঁরা জাতীয় স্বার্থের কথা বেমালুম ভূলে যান। তাঁরা বড় জাতি গুলোর প্রতি ঝুকে পড়ে আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি সমূহের সাথে দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। তাদের ভাষা, সংস্কৃতির উপর প্রভূত্ব কায়েম করে ফেলে। এমন কি রাস্ট্র ও সরকারের ক্ষমতাশীল ব্যাক্তিবর্গ  ক্ষুদ্র জাতি সমূহের কোন কথারই গুরুত্ব দেয় না । স্ব শাসনের ব্যাপারে অন্যান্য সাধারন মানুষের চেয়ে ও শ্রমিক মেহানতী মানুষ বশী উৎসাহিত হয়ে থাকেন। কিন্তু তা তাদের সমস্যার সমাধানে তেমন কোন ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনেনা । এটা রাট্রের জন্য ও বিপদজনক কেননা সেই রাস্ট্র তখন চাইবে তার দূর্বল প্রতিবেশীর উপর নিজের ক্ষমতা খাটিয়ে  তাকে করায়ত্ব করে রাখতে ।

আসল কথা হলো সেই সকল কারনেই এনার্কিস্টগন রাস্ট্রকে অস্বীকার করেন। তারা মনে করেন, রাস্ট্র জাতীগত সমস্যার ও সমাধান করতে সক্ষম নয়; কেবল মাত্র এনার্কিজম কায়েমের মাধ্যমেই জাতীয় সমস্যার সমাধান করা সম্ভব; স্বাধীন সাম্যবাদের বাস্তবায়ন করে ব্যাক্তি স্বাধীনতার নিশ্চয়াতা বিধানের মাধ্যমে স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে –মহাসমিতি গড়ে তুলে সাম্য ও স্বাধীকার বিধান সম্ভব হয়ে উঠবে। আর এভাবে প্রকৃতিক ধারায় জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা যাবে।

ভূবন ভিত্তিক মহাসমিতি গড়ে উঠবে সম্পূর্ন স্বেচ্ছাপ্রনোদিত ভাবে, নিজেদের ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সকল জাতীয় সমস্যার সমাধান করবে, সেখানে পূর্ন স্বাধিণতা ও সাম্য বজায় রাখা হবে। কোণ প্রকারের বুর্জোয়া মানসিকতার প্রশ্রয় থাকবে না । এমন ভাবে সমস্যার সমাধান করা হবে যাতে জাতিসমূহের মধ্যে প্রকাশ্য ও গোপন হিংসা প্রতিহিংসার স্থান না থাকে। কেবল মাত্র সম্প্রদায়গত মহাসমিতি সমূহ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয় ঠিক করবে- যেন পরস্পরের মধ্যে কোণ প্রকার শোষণ, নিপিড়ন, যুদ্ব বা দ্বন্দ্বের উৎপত্তি না হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা চুক্তি সমূহ কোন ভাবেই রাস্ট্র কৃতৃক নির্ধারিত হবে না। এখন যে জাতিসংঘ গড়ে উঠেছে তা কোন ভাবে জাতি সমূহের প্রতিনিধিত্ব করে না। বরং এটি  এখন একটি শোষক শ্রেনীর সমিতি বা সংঘ হিসাবেই কাজ করছে। তাঁরা দুনিয়া জোড়ে সকল প্রলেতারিয়েত শ্রেনী বিপরীতে কাজ করে যাচ্ছে। সেখানে বড় বড় দেশ সমূহ অস্ত্রের জোড়ে নিজদের মতামত অন্যের উপর ছাপিয়ে দিচ্ছে এবং দুনিয়াকে প্রতিনিয়ত যুদ্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মহা সমিতি সমূহ তাদের মহান কর্ম সম্পাদনের জন্য অবশ্যই সাম্যবাদি বিপ্লবের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাবে। তাঁরা প্রথমেই রাস্ট্রের স্থানে কমিউন ও ট্রেড ইউনিয়ন পরিস্থাপন করবেন। যা মানুষকে স্বেচ্ছা প্রনোদিত হবে, একেবারে  নিচে থেকে সামগ্রীকভাবে সুসংগঠিত করবে। সেই ক্ষেত্রে সকলের ই স্ব-শাসনের অধিকার নিশ্চিত করে কমিউন ও প্রভিন্স সমূহের মধ্যে একটি চমৎকার ঐক্য গড়ে তুলবে। তবে সেই ক্ষেত্রে কোন প্রকার ছোট বড় বৈষম্য করবে না । সেই স্ব শাসনের জন্য দুটি বিশেষ শর্তপূরন করা হবেঃ এমন কোন কাঠামো অনুমোদন করা হবে না যাতে পার্শ্ববর্তী কমিউনের স্ব শাসন বিঘ্ন ঘটে। কোন কমিউনেই কাউকে বাধ্যতামূলক ভাবে সদস্য করা হবে না ।

উক্ত কাঠামোর আলোকে এনার্কিস্টগন জাতীয় সমস্যা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বিশ্বময় সকল কৃষক ও প্রলেতারিয়েতদের ঐক্য বিধানে অগ্রনী ভূমিকা পালন করবেন। সেই ক্ষেত্রে সকলের লক্ষ্য হবে ব্যাক্তিগত সম্পত্তির বিলুপ্তি, এবং রাস্ট্র ব্যবস্থার বিতারন করা।  জাতিগত ভাবে সকল প্রকার অন্যায় অবিচার বিদূরিত করা হবে। প্রতিটি জাতীর স্ব শাসন নিশ্চিত করা হবে যেন সকলের জন্য স্বাধীকার ও সাম্যের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা যায়। তাই, আন্তর্জাতিক ওয়ার্কিংম্যান্স এসোসিয়েশন তাদের সামগ্রী কার্যক্রমে সবিশেষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। তাঁরা প্রতিটি এনার্কিস্ট ব্যাক্তি ও সংস্থার সাথে কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন করবে।

স্ব শাসনের  অধিকারের মতই এনার্কিস্টগন জাতীয় বিভক্তিকে ও স্বীকার করে নেয়। মানুষের জাতীয় আকাঙ্ক্ষাকে অস্বীকার করে না । তাঁরা এটাকে ও স্বাধীনতার অংশ হিসাবে মেনে নেন। তাঁরা কেবল প্রলেতারিয়েতদেকে ব্যবহার করে ফায়দা হাসিলের বিরুধীতা করেন, কোন ভাবে স্ব শাসনের বিরোধীতা করেন না, তবে সকল প্রকার রাস্ট্রীয় ধারনার তিব্র বিরোধী । এটা স্বীকৃত বিষয় যে দাসত্বের নিগড়ে বন্দ্বি জাতি সমূহ  দেশপ্রেমের নামে এক ধরনের প্রহেলিকায় ভোগেন। অন্য দিকে প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর প্রতি জাতীয়তাবাদি শাসক চক্রের একধরনের অবিশ্বাস জন্ম হয়। ( কেননা শ্রমিক শ্রেনীর বিশ্বাস ও আদর্শ হলো আন্তর্জাতিকতাবাদ) এনার্কিস্টগন উপনিবেশিক সকল জাতি সত্ত্বার স্বাধীকার ও সাম্যের জন্য লড়াই করেন। তাঁরা শ্রমিক ও কৃষকের সম্মিলিত প্রায়সে জতীয় মুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে চায় ।


Share Tweet Send
0 Comments
Loading...
You've successfully subscribed to Bangladesh ASF
Great! Next, complete checkout for full access to Bangladesh ASF
Welcome back! You've successfully signed in
Success! Your account is fully activated, you now have access to all content.