এ কে এম শিহাব অনূদিত গ্রেগরী পেট্রোভিচ ম্যাক্সিমফ প্রণীত প্রোগ্রাম অব এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম পুস্তকের ধারাবাহিক-

দ্বিতীয় বিভাগঃ রাজনৈতিক পরিমন্ডল

অধ্যায়ঃ ১ । সাধারন রাজনীতি

বুর্জোয়ারা-গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, সকল মানুষের জন্য তার আনুষ্ঠানিক সমতা এবং তার আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার কথা বলে প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষা করে এবং এভাবে অবশ্যই বুর্জোয়াদের একনায়কতন্ত্র এবং কর্মরত জনগণের নিদারুণ শোষণের জন্য একটি সংগঠন হয়ে ওঠে। সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের রূপে নতুন রাস্ট্রবাদের ক্ষেত্রেও এটি সত্য, এমনকি সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্রের ধারণা অনুসারে এটিও পবিত্র। রাষ্ট্র কেবলমাত্র উৎপাদনকারীর সকল উপায়েই নয় বরং প্রতিটি ব্যক্তির জীবনেরও মালিক, প্রত্যেককে দাসের অবস্থান, কথা বলা রোবটগুলির অবস্থান এবং একেবারে যুক্তিযুক্ত  ও যুক্তি দিয়ে বৈধ করা হয়, নতুন শাসক শ্রেণীর শোষণের সৃষ্টি করে। শ্রমিক শ্রেণী - আমলাতন্ত্রের একনায়কতন্ত্র; একটি ক্ষুদ্র চক্র দ্বারা জনগণের বিশাল জনগোষ্ঠীর শোষণ এবং মোট দাসত্বের জন্য রাষ্ট্র একটি দৈত্য মেশিন হয়ে ওঠে।

বিপরীতভাবে, শ্রমিক শ্রেনী দ্বারা সংঘটিত কর্মকাণ্ডের জনগোষ্ঠীগুলিকে নতুন, নিরাজবাদি সমাজের নির্মাণের একমাত্র ভিত্তি হিসাবে রূপান্তরিত করবে, এইভাবে আন্দোলনের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন এবং ব্যাক্তির জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে।

বুর্জোয়া গণতন্ত্র সর্বজনীন মৈত্রী ও জাতীয় সমতার বুলির অধীনে তার শ্রেণী চরিত্রকে লুকিয়ে রাখে। অন্যদিকে, সোভিয়েত গণতন্ত্র, শ্রেণী চরিত্র ও রাস্ট্র ধ্বংসের জন্য সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্রের ধারণাকে অপরিহার্যভাবে বজায় রাখার মাধ্যমে তার শ্রেণির চরিত্রকে দ্রুত জোরদার করে। যাইহোক, রাশিয়ান বিপ্লবের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে যে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্রটি একটি কল্পনা, একটি অগ্রহণযোগ্য কল্পরূপ, এটা যৌক্তিকভাবে এবং অনিবার্যভাবে, এটি  একটি পার্টি একনায়কতন্ত্রের রূপ  ধারন করে এবং পরবর্তীতে আমলাতন্ত্রের একটি নিয়ম হয়ে উঠে, অর্থাৎ সহজ পরমত্ব। সোভিয়েত রাষ্ট্রকে বলতে  বাধ্য করা হয়েছে যে আমলাতন্ত্রের একনায়কতন্ত্র হ'ল সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র, ঠিক যেমন বুর্জোয়ারা তার একনায়কতন্ত্রকে "জনগণের ইচ্ছা" বলে দাবি করে।

অন্যদিকে, শ্রেনী ভিত্তিক কনফেডারেশন সমূহ গঠিত হয় হাজার হাজার স্বাধীন শ্রমিক দল নিয়ে, ফলে তারা প্রচুর সুবিধা ও কাজের স্বাধীনতার জন্ম দেয়। এটা বিশেষ কোন শ্রেনীর প্রাধান্যকে বা একনায়তন্ত্রকে বাধা দেয়, ফলে সেই সকল ক্ষেত্রে একটি সন্ত্রাসী শাসন ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটেতে পারে না। শ্রেনী ভিত্তিক কনফেডারেশনের চরিত্র হলো তারা মানুষের ব্যাপক স্বাধীনতাকে সীমীত করতে চায় না। মানুষের সামগ্রীক অধিকার নিশ্চিত করতে চায়, তাদের কাজের পরিধি বাড়াতে চায়। ফলে সত্যিকার গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃস্টি হয়। বাস্তব জগতে শ্রেনী ভিত্তিক ফেডারেশনই সত্যিকার গণতন্ত্রের ভিত্তিকে মজবুত করে দিতে পারে।

বুর্জোয়া এবং সোভিয়ত উভয়ই নিজেদের আনুস্টানিক সকল কার্যক্রমকে রাজনৈতিক স্বাধীনতার ঘোষনার মধ্যে সীমাবদ্ব রাখতে চায়ঃ বাক স্বাধীনতা, সমাবশের স্বাধীনতা, সংঘ গঠন এবং সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা, ও ধর্মঘট পালনর অধিকার ইত্যাদি। প্রাচীন লোকেরা কবল আনুস্টানিক স্বাধীকার প্রতিস্টায়  আগ্রহী। তাঁরা ও শুধু শ্রমিক শ্রেনী কথা বলেন। কিন্তু প্রশাসনিক গণতন্ত্র, আর্থিক শোষণ মুক্তি অর্জিত না হলে - সত্যিকার স্বাধীকার অর্জিত হবার কোন সম্ভাবনাই নেই। তা বুর্জোয়া রাস্ট্রই হোক বা প্রলেতারিয়েত রাস্ট্রিই হোক। তাই সকল আন্দোলনের লক্ষ্য ই হওয়া দরকার সামগ্রীক স্বাধীনতা অর্জন করা।

নাগরিকদের জন্য পূর্ন অধিকার অর্জন করা অসম্ভ নয়, বাস্তব অবস্থায় বিবেচনা করলে আমরা দেখব যে যেসকল ঘোষণা দেয়া  হয় , তা অর্জনের পদক্ষেপ নেয়া হয় না, অনেক ক্ষেত্রে তা সামাজিক ও রাস্ট্রিয় কাঠামোগত কারনে সম্ভব ও হয়ে উঠেনা। তাই সামাজিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে তা অর্জন করা সম্ভব । তাই দরকার হল ফেডারেশন গঠন করে স্ব স্বাশিত ব্যবস্থার প্রবর্তন করা। পুঁজিবাদ ও রাস্ট্র ব্যবস্থাকে বিতারন করা । আজকের সভ্য দুনিয়ায় এই গুলোই হলো মানুষের বড় শত্রু।

বুর্জোয়া গনতান্ত্রিকগন ও প্রায়স মানুষের অধিকার স্বাধীনতার বানী প্রচার করেন, কিন্তু রাস্ট্র ও পুঁজিবাদের কারনে তা সত্যিকার ভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে না । তাদের সমাজে ক্রমান্বয়ে অসাম্য, শোষণ বাড়তেই থাকে। আজকের সাম্রাজ্যবাদি দুনিয়ায় বুর্জয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জাতিগত ও জাতি শোষণের চূড়ান্ত স্তরে অবস্থান করছে।

সোভিয়েত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ও আনুস্টানিক ভাবে গণতন্ত্রের কথা বলা হয়েছিলো, কিন্তু তাঁরা ও এক জাতির উপর থেকে অন্য জাতির প্রাধান্যকে নির্মূল করতে পারেন নাই। স্বশাসিত ব্যবস্থার কথা বললে ও বাস্তবে সোভিয়েত গুলো স্বসাশিত হয়ে উঠতে পারেনাই। অধিকন্তু, তাঁরা তাদের নিজেদের নাগরিকদেরকে রাষ্ট্রীয় নিপিড়ন থেকে মুক্তি দিতে পারে নাই। জাতীয় স্বাধীনতাকে কেবল স্বাধীন হলেই বা নিজস্ব সরকার গড়ে তোলেই নিশ্চিত করা যায়নি। তাই ব্যাক্তির স্বাধীণতা নিশ্চিত করার ভেতর দিয়েই জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন করা যেতে পারে।

জাতীয় পূর্ন স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য সম্প্রদায়গত কনফেডারেশন গড়ে তোলা যেতে পারে। যা ব্যাক্তিগত স্বাধীনতা অর্জনে সহায়ক হবে। আর সেই ব্যাক্তিগত স্বাধীনতার জন্য দরকার প্রত্যেক জাতির ভেতর  মুক্ত ও স্বেচ্ছাধীন সমিতি গড়ে তোলা।

জেন্ডার বা লৈঙ্গিক স্বাধীনতা ও কেবল ঘোষণা দিয়ে অর্জিত হয় না, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সেই কাজ করেছিলো। কিন্তু বাস্তবে তা খুব কমই অর্জিত হয়। নারীদেরকে গৃহ কর্ম ও শিশু লালন পালনের ভার থেকে মুক্তি দেবার প্রয়াস ছিলো খুবই দুর্বল। কিন্তু প্রকৃতিগত ভাবেই রাস্ট্র হলো মানুষের সত্যিকার স্বাধীকনতার  বিরোধী। তাই সেই ক্ষেত্রে ও রাষ্ট্র এই ইস্যূতে আন্তরিক ছিলো না একেবারেই- বাঁধা দেয়া তার ঐতিহাসিক ঐতিহ্য- চার্চ ও বুর্জোয়া সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করতে পারেনি। ফলে বিবাহ প্রথা আইন বহাল থেকেই গেল। জেন্ডার সমতা সামগ্রীক ভাবে কেবল মাত্র কনফেডারেশন গড়ার মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে। রাস্ট্র, ধর্ম, পুঁজিবাদ কোন কিছুই মানুষের সত্যিকার স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করতে পারবে না ।

রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবের অভিজ্ঞতা আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, নতুন একটি সামাজিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা অসম্ভব নয়। আমরা দেখেছি একটি সামাজিক সংগঠন ফেডারেশনের মাধ্যমে সোভিয়েত ব্যবস্থায় বুর্জোয়া কার্যক্রমের অনেক মন্দ্ব দিক ই বিতারিত করতে পেরেছিলো। তাদের তথাকথিত গণতন্ত্র, পার্লামেন্ট, সাধারন নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি প্রেরন যা সত্যিকার ভাবে মানুষকে সামাজিক প্রতিস্টান থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। তার বিপরিতে ভিন্ন ধারায় রাস্ট্র ও একানয়কত্বকে বিতারনের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। সেখানে সাম্যবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের জায়গায় - সামাজিক সংগঠন সহ সোভিয়েত গুলো সমাজ ও উৎপাদন ব্যবস্থার দায়িত্ব গ্রহন করেছিলো।

বুর্জোয়া রাস্ট্র সেনাবাহিনীকে নিজের স্বার্থে শ্রমিক শ্রেনীকে দমন করে রাখার জন্য ব্যবহার করে থাকে। ক্ষমতাসীন দল কোন কারনে ঝুঁকির লক্ষন দখলেই রাস্ট্রের হেফাজতের নামে সেনা তলব করে বসে। রাশিয়ায় সোভিয়েত ও কেই অপকর্ম করছে। দুনিয়া জোড়ে একই নিয়ম চালু করে বসে আছে বুর্জোয়া চক্র। সাধারন মানুষের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা সুরক্ষার জন্য আমরা মনে করি শ্রমিক শ্রেনীর মিলিশিয়া বাহিনী, গ্রাম সুরক্ষা দল, ও স্বেচ্ছাসেবক কর্মী বাহিনী ই উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। শ্রমিক শ্রেনীর তৈরী মিলিশিয়া বাহিনী রাস্ট্র ও শ্রেনীর বিলুপনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে।

প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর অবস্থা স্বীকার করেই  এনার্কিস্টগন বিশ্বাস করেন যে, বিপ্লবের সূচনা লগ্ন থকেই সকল মানুষের জন্য সমান সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরী। অন্যান্য লোকদের সাথেই শ্রমিক শ্রেনীকে ও একেই ভাবে কাজে লাগানো ও তার বিনিময় ব্যবস্থা সমান রাখতে হবে। তাদেরকে আলাদা ভাবে প্রদর্শন করা ঠিক হবে না । সকল মানুষের সমান অধিকার সুরক্ষার কাজ – বিপ্লবের প্রথম দিন থেকেই মেনে চলতে হবে। এটা সামাজিক ন্যায় বিচারের মৌলিক শর্ত।