প্রথম ভাগ- অর্থনীতি

প্রথম অধ্যায়ঃ উৎপাদন শিল্প

সাম্রাজ্যবাদী লড়াই সংগ্রামে এটা প্রমানিত হয়ে গেছে যে,  রাশিয়ায় একটি অসফল  বিপ্লব হওয়া সত্বে ও পুঁজিবাদী সমাজকে তাত্ত্বিক ভাবে যত বেশী শক্তিশালী মনে করে হয়েছিলো বাস্তবে তা নয়।

রাশিয়ার বিপ্লবের অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে আরও একটি জিনস তোলে ধরেছে যে, সামাজিক বিপ্লবে মানুষের চাহিদার মাত্রা বৃদ্বি পায়, তবে সেই সময়ে উৎপাদনের পরিমান কমে যায়; এটায় আরও স্পষ্ট হয়েছে যে, দেশ যখন বিপ্লবের পতাকা উর্ধে তোলে ধরে তখন বুর্জয়ারা বিপ্লবের বিপরীতে আক্রমনাত্মক হয়ে উঠে।

এই পরিস্থিতিতে অবর্ননীয় দুর্ভিক্ষ ও অনাহার দেখা দেয়। ফলে বাস্তব অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য পূর্ব প্রস্তুতী থাকা একান্ত আবশ্যক। যদি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার মত পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেই প্রস্তুতিতে কে কোথায় কি কি দায়িত্ব পালন করবেন তা সুনির্দিস্ট ভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। প্রধানত কি কি উৎপাদন করতে হবে, কি ভাবে তা সুরক্ষিত হব, তার জন্য পূর্নাংগ পরিকল্পনা থাকা চাই ।         ( বিপ্লবের জন্য সামগ্রীক প্রস্তুতি অত্যাবশ্যক)।

রাশিয়ান বিপ্লবের অভিজ্ঞতা বলে সেই সময়ে বাধ্যতামূলক উৎপাদনের জন্য মানুষের উপর চাপ প্রয়োগ করা ছিল অত্যান্ত ক্ষতিকারন ও বিপদজনক পদক্ষেপ; এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম এই ধরনের বাধ্যতামূলক ভাবে কারখানা পরিচালনা, শ্রমিকদের স্পেশাল বাহিনী বা অন্য কোন প্রকারের সংস্থান করার  চরম বিরুধী। সিন্ডিক্যালিস্ট উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিকদের স্বাধীনতার গ্যারান্টি দেয়াই আসল উদ্দেশ্য । অর্থাৎ প্রতিটি মানুষ তার কাজের বিষয়ে পূর্ন স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে। মানুষ তার পছন্দ মত কাজ বাঁচাই করে গ্রহন ও পরিবর্তন করতে পারবে।

সামাজিক বিপ্লবের ফলে নতুন সমাজ, তার অস্তিত্বের প্রথম দিন থেকেই শ্রমের একীকরণ নিশ্চিত করার উপায়গুলি কি কি তা খুঁজতে হবে, যাতে এককথায় চেতনাগত এবং শারীরিকভাবে উভয়কেই  ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে । পুঁজিবাদী সমাজে শিল্প ও কৃষি শ্রমিকের মধ্যে সম্পূর্ণ আলাদাতা অবস্থান দেখা যায়, কিন্তু সিন্ডিকেটবাদী সমাজ দৃঢ়ভাবে শিল্প ও কৃষির সম্পকর্কের মধ্যে আরও ঘনিষ্ঠতা অর্জনের প্রচেষ্টা চালাবে এবং যার ফলে শ্রমিকরা কারখানা এবং জমিতে  বিকল্প কাজে যোগদান করতে সক্ষম হবে।

রাশিয়ার শিল্প প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতাটি দেখিয়েছে যে উৎপাদন কেন্দ্রিকীকরণের নীতিটি সমগ্র শিল্প যন্ত্রপাতির নীতিমালা, যা একটি সরকারী শ্রেণির উদ্ভবের দিকে পরিচালিত করে, উৎপাদকদের কাছ থেকে / সামাজিক অর্থনীতির প্রশাসনকে অপসারণ করার জন্য, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে চলমান সংকটের দিকে শ্রমিকদের স্বাধীন কার্যকলাপের বিরোধীতা করে এবং এই অভিজ্ঞতার কারণে,  এনার্কো-সিন্ডিক্যালস্টিগন কারিগরি কেন্দ্রীকরণ এবং প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ভিত্তিতে উৎপাদন প্রক্রিয়া নির্মাণ করবে।

এই ভাবে রাশিয়ার বিপ্লব আমাদেরকে নিজেদের ত্রুটিগুলি সংশোধন করে প্রাপ্ত সমস্যার সামাধান করে সামগ্রীক উৎপাদন ব্যবস্থায় একটি হ্রদয়তাপূর্ন পরিবেশ আনয়নের জন্য পরিবেশ তৈরী করে দিবে- এটা ছিলো প্রত্যাশা। এই অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে প্রমানিত হয়েছে; মহান চিন্তক ক্রপথকিন যেমন বলেছিলেন যে, “ কোন রাস্ট্রের পক্ষেই সামগ্রীক উৎপাদন ব্যবস্থার সুস্ট ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব নয়, ট্রেড ইউনিয়ন গুলো যদি দায়িত্ব গ্রহন না করে তবে বিপর্যয় অনিবার্য”। তবে অবশ্যই শ্রমিক শ্রেনীকে একমত করতে হবে যে তারা যেন বৃহত্তর জনগণের ব্যবহার উপযোগী পন্য উৎপাদন করেন । তাদেরকে উৎসাহিত করতে হবে যে, সকলেই যেন জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নে একেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করেন । মন্ত্রী পরিষদ ও নানা প্রকার কমিটির খেয়াল খুশিমত সিদ্বান্ত চাপিয়ে দেয়া নয় সত্যিকার জনগনের চাহিদার আলোকে সকল কিছু পরিচালিত হবে । তবে কাজের সুবিধার জন্য কমিটি থাকবে । তা হবে খুবই সরল সহজ প্রকৃতির । তা গঠিত হবে কৃষি খামারে আর শিল্প কারখানায় । সকল কমিটিই পরিচালিত হবে শ্রমিকদের ইচ্ছে অনুসারে” । আর তা চালিত হবে শ্রমিকদের স্বার্থে।

উপরোক্ত পরিস্থিতির আলোকে এনার্কো – সিন্ডিক্যালিস্টগন বিশ্বাস করেন যে, সামগ্রীক সামাজিক  পরিবর্তনের জন্য সমগ্র শ্রমিক শ্রেনীর লোকদেরকে অবশ্যই সচেতন করতে হবে। যাতে উৎপাদক শ্রেনী “ সামাজিক নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে উৎপাদন সংস্থান, উৎপাদনের নীতিমালা, ও এর সামাজিকিকরন এবং বিকেন্দ্রীকরণ প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিত অবহিত হবেন।  এই সকল কাজে নিয়োজিত থাকবে এনার্কো সিন্ডিক্যালিস্ট সংগঠন সমূহ । তাছাড়া উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সিন্ডিক্যালাইজেশন করবেন সকল শ্রমিক নিজেদের হাতে, আর এতে নেতৃত্ব দিবে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন, প্রতিটি কারখানা ও ফার্মকে একত্রিত করার জন্য শ্রমিক সংগঠন সমূহ ক্রমে ভোক্তা বান্দ্বব উৎপাদন পরিবেশ সৃজন করবেন”।

রাশিয়ান বিপ্লবের অভিজ্ঞতা বলে, সুসংগঠিত উৎপাদন ব্যবস্থার প্রতিটি উপকরন সাধারন ভাবে পরিবর্তন ও পরিমার্জন করতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে সিন্ডিক্যালাইজেশনের সময় প্রতিটি কর্ম যেন শ্রমিক বান্দ্বব হয় । প্রতিটি উৎপাদন কারী প্রতিস্টানই হবে তৃনমুলের সাথে সম্পর্কিত তারা উৎপাদনের ব্যবস্থাপনাকে ও সাধারন মানুষের নাগালের মধ্যে রেখে সামগ্রী উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবেন । প্রতিটি ফ্যাক্টরী পরিচালনার ক্ষেত্রে স্থানীয় শ্রমিকদেরকে ব্যবস্থাপনার জড়িত রাখাবে । উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া নীতির অবসান হবে ।

সাম্যবাদ সফল ভাবে প্রতিটি কারখানায় প্রতিস্টার জন্য, যথাযথ ভাবে প্রতিটি কারখানায় সুস্টুভাবে দক্ষতার সাথে কর্ম সম্পাদনের লক্ষ্যে, সকল প্রকার ব্যাক্তিগত উদ্যোগে স্থাপিত কলকারখানাকে একত্রিকরন করা হবে।  একেই সাথে সকল উৎপাদন কেন্দ্র যেন গুন ও মান বজায় রেখে উৎপাদন করতে সেই বিষয়িটি নিশ্চিত করা হবে। এই একত্রিকরন করার ক্ষেত্রে কোন ভাবেই ব্যাক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হবে না, সেই জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত, প্রশাসনিক, তথ্যগত সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে সামগ্রীক উৎপাদন ব্যবস্থাপনাকে একেই কমান্ডের আওতায় নিয়ে আসা হবে । ( ক্রপথকিন, পৃস্টা-২৩)

এই পদ্বতীটি বাস্তবায়নের জন্য নিম্নলিখিত পন্থা অনুসরন করা হবেঃ

১। স্বব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ফ্যাক্টরী – কমিউন চালাবে

২। কমিউনের উৎপাদক পরিষদের ফ্যাক্টরী

৩। ইউনিয়নের উৎপাদক পরিষদ

৪। সাধারন শ্রমিকদের কংগ্রেস ( জনগণের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক)।

সকল উৎপাদন প্রক্রিয়াটা সংগঠিত করা হবে উক্ত ব্যবস্থাপনাগত নীতিমালার আলোকে, যেকোন সময়ে রি-কল বা ফেরত নেয়া যায় এমন প্রতিনিধিগনের মাধ্যমে সকল ব্যবস্থাপনা ও নির্দেশনা বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষন করা হবে । আভ্যন্তরীণ শৃংখলা ও সামগ্রী ব্যবস্থাপনায় যেন কোন প্রকার ব্যাঘাত না ঘটে সে দিকে সবিশেষ নজর রাখা হবে ।

রাশিয়ার বিপ্লবের অভিজ্ঞতা আমাদের শেখায় যে, বৈজ্ঞানিক ও উৎপাদনের সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্বির কাজ অব্যাহত থাকবে, যতক্ষন পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেনী অধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে সক্ষম না হয়ে উঠবেন। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার উত্তরাধিকার হিসাবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গীগত দিক গুলোতে  সংকির্নতার প্রশ্রয় পাবে না । প্রচলিত সমাজের বুদ্বিবৃত্তিক লোকেরা বিপ্লবের পর ও তাদের স্ব স্ব কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারবেন, তাদের অধিকার কোন ভাবেই সীমিত বা ক্ষুন্ন হবে না । তবে সামাজিক উত্থানের সূচনা থেকে সকলের সমান অধিকার বজায় থাকবে ।

এটা সত্য যে সূচনা লগ্নেই সাম্যবাদকে সামগ্রীক ভাবে অনুসরন  করা যাবে না; “ চাহিদা মত বিতরন” এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ কিছু পদক্ষেপ গ্রহন কর দরকার হয়ে পড়বে ।

প্রাথমিক ভাবে সকলের জন্য যে নীতিটি বাস্তবায়ন করা হয়ে তা হলো ; “ সকলের জন্য সমান অংশীদারীত্ব”। সমান অংশীদারিত্ব উৎপাদনের ব্যাপক গতি নিয়ে আসবে, সিন্ডিক্যালিস্ট শিল্পে তা ব্যাপক ভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। ছোট ছোট পদক্ষেপের মাধ্যমে সর্বস্তরে এই পদ্বতী চালু করা হবে; প্রত্যেকের জন্য তাদের চাহিদার আলোকের বিতরন করার নীতি বজায় থাকবে।

সকলের জন্য সমান অংশীদারিত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে যারা যার উপর  নির্ভরশীল তাদেরকে অনুপুরক সাহায্য দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে । রেশনিং ব্যবস্থায় পরিমান ততই বাড়বে , কমিউনের উৎপাদন যতই বাড়বে ।  এছাড়া কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র শিল্প সম্পর্কে এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্টগন সকল কিছু  তাৎক্ষনিক ভাবেই সমন্বিত করে বিশাল আকারে উৎপাদনে যাওয়ার বিষয়ে উৎসাহী নয়। তবে, পারস্পরিক সহযোগিতা, একে অন্যের সাথে মিলে মিশে কাজ করার পরিবেশ তৈরী করা হবে। সকলেই স্বাধীন সিদ্বান্ত গ্রহন করে নিজেদের কাজ করার পূর্ন সুযোগ পাবেন । এনার্কো- সিন্ডিক্যালিস্টগন সকল সময়েই চেষ্টা করে নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প গুলোকে একত্রিত করতে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সহায়তায় তাদের উৎপাদন ও সামগ্রীক ব্যবস্থাপনার বিকাশ ঘটাতে। প্রগতির ছুঁয়া ছাড়া সামগ্রীক উন্নয়ন সম্ভব নয়।