(বি এ এস এফ)

বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা ক্ষেতল্যান্ডের ওপর তাদের অধিকার রক্ষা এবং ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিগত কয়েক বছর যাবৎ আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। এই আন্দোলন বাংলাদেশ এনার্কো সিন্ডিক্যালিস্ট ফেডারেশন - বি এ এস এফ সহ  দেশের সংবেদনশীল মানুষদের একটি বড় অংশকে স্পর্শ করেছে এবং অনেক প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। যেসব প্রশ্ন বহুকাল চাপা ছিল। যেমন আমরা প্রায়শ ভাবতে পছন্দ করি, চা শ্রমিকদের ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিয়ে এসেছিল ব্রিটিশরা। তাই তারা এখানকার নয়। এটা অনেক সময় তাদের প্রতি বিদ্বেষ নয় শুধু, বরং সহমর্মিতা থেকেও বলা হয়। এটা যে তথ্য ও তত্ত্ব উভয় দিক থেকেই ভুল এবং এ ভাবনা যে তাদের অধিকারকে করুণায় পর্যবসিত করে_ আন্দোলনের সংগঠকরা কিন্তু এটা জোরের সঙ্গে সামনে এনেছেন এবং তারা এই ঐতিহাসিক সত্যটি দেখিয়ে দিচ্ছেন, তারা যখন আসছেন তখন ভিনদেশে নয়, নিজ দেশের অর্থাৎ ভারতেরই এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে তারা এসেছিলেন।

আরও সামনে নিয়ে এসেছে চা শ্রমিকদের অবিশ্বাস্য কম মজুরি, মধ্যযুগীয় কর্মপরিবেশ, দারিদ্র্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান আর অধিকারহীনতা, ভূমি অধিকার এবং ভূমি সম্পর্ক_ এসব অত্যন্ত প্রাথমিক কিন্তু জরুরি প্রশ্ন ছাড়াও চা শিল্পের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, এককালের শীর্ষ চা রফতানিকারক দেশের অবস্থান হারিয়ে আমদানিকারক দেশের তালিকায় প্রবেশ, চা শিল্পে পুঁজি প্রবাহের ঘাটতি, বিদেশি বা স্টার্লিং কোম্পানিগুলোর উৎপাদনে (পরিমাণ ও গুণগত মান) শীর্ষ অবস্থান বজায় রাখা, দেশি ব্যক্তিমালিকানাধীন কিংবা সরকার পরিচালিত কোম্পানিগুলোতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ না হওয়া, বিদেশি নিম্নমানের চায়ের জন্য বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়া, বিশেষ ইকোনমিক জোন কার স্বার্থে কিসের বিনিময়ে, কতটা ফলপ্রসূ, পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশ যারা এসব জোন আগে তৈরি করেছে তাদের অভিজ্ঞতা, আমাদের দেশে ইতিপূর্বে জনগণের জমি দখল করে অনুরূপ যেসব এলাকা গড়া হয়েছিল বিসিক ইত্যাদি সেসব প্রকল্পের বর্তমান হাল, ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার জন্য যেসব আইন প্রণয়ন করা হয়েছে সেসবের বৈশিষ্ট্য, সর্বোপরি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতার ওপর জনগণের মালিকানার প্রকৃতি ইত্যাদি।


আমরা জানি, হবিগঞ্জের চা শ্রমিকরা তাদের ক্ষেতল্যান্ড থেকে প্রস্তাবিত বিশেষ ইকোনমিক জোন প্রকৃত অকৃষি জমিতে সরিয়ে নেওয়ার দাবিতে গত ১৩ ডিসেম্বর থেকে টানা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি বা 'বেজা' সম্প্রতি বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় 'হবিগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়নে বাধা কার স্বার্থে' শীর্ষক বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে। ওই বিজ্ঞাপন থেকেই এটা স্পষ্ট_ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ আছে ক. 'কৃষিজমি, উপার্জনে ব্যবহৃত জমি এবং বসতভিটা' অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের জন্য ব্যবহার করা যাবে না। খ. চান্দপুর চা বাগানের ৫১১ একর জমিতে ডানকান চা বাগান করেনি। গ. এই জমি চা শ্রমিকরা ফসল উৎপাদনের জন্য রেশনের বিনিময়ে ব্যবহার করত। ঘ. কিন্তু এটা কৃষিজমি ছিল না। এটা সরকারের রেকর্ড অনুযায়ী অকৃষি খাস হিসেবে ডানকানকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।


ওপরে আলোচিত ৪টি স্বীকৃত পয়েন্টের একটি উত্তরই শুধু হবিগঞ্জের চা শ্রমিকরা তাদের আন্দোলনের মাধ্যমে দিয়ে যাচ্ছে। আর তা হলো, সরকারি খাস খতিয়ান হিসেবে যে অকৃষি জমি ডানকানকে ১৮৯০ সালে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, সেই অকৃষি খাস জমিকে ফসলি জমিতে রূপান্তরিত করেছে তাদের পূর্বসূরিরা ১২৫ বছর আগে। ১২৫ বছর যাবৎ ফসল ফলানো, প্রতি বছর বিঘাপ্রতি সাড়ে তিন মণ চাল অথবা আটার সমপরিমাণ রেশনের মূল্যে এই জমির দাম পরিশোধ করা হয়েছে বহু আগে। এত চড়া দামে মূল্য পরিশোধের পরও যদি এই খাস জমির মালিকানা সরকারেরই থাকে এবং ডানকান চুক্তিমতো জমি ব্যবহার না করায় যেহেতু আইন অনুযায়ী এই লিজ বাতিল করা হয়েছে, তাহলে ১৯৯৭ সালের খাস জমি বন্দোবস্ত আইন অনুযায়ী এই জমির স্থায়ী বন্দোবস্ত পাওয়ার অগ্রাধিকার রয়েছে চা শ্রমিকদের। কোনো যুক্তিতেই বেজা এই জমি বরাদ্দ পাওয়ার অধিকারী নয়।


প্রকৃতপক্ষে দেশের ভূমিনীতি, ভূমি সংরক্ষণ আইন-২০১৫ (খসড়া), সরকারের পরিকল্পনা, প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার ও নির্দেশনা এবং আন্দোলনকারীদের দাবির মধ্যে কোনো নীতিগত বিরোধ নেই। সব পক্ষই কৃষিজমিতে ইকোনমিক জোন স্থাপনের বিরুদ্ধে এবং অনাবাদী পতিত জমিতে তা স্থাপনের পক্ষে। দুর্ভাগ্যবশত এ রকম একটি মীমাংসিত বিষয়েই এখন হাজার হাজার চা শ্রমিককে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হচ্ছে।


আমরা যাদের কাছ থেকে বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামোটি পেয়েছি, সেই ব্রিটিশ আমলারা ছিলেন রাজকর্মচারী, আমরা ছিলাম প্রজা। রাজকর্মচারীদের কলমের দাগ-আঁক হাজার হাজার বা লাখ লাখ প্রজার জীবনপণ সংগ্রামের চেয়ে বড় ছিল। সেটাই আমলাতন্ত্রের বুনিয়াদির গোড়ার শিক্ষা। কিন্তু সেই আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোটির গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্যই তো এ দেশের মানুষ ব্রিটিশদের খেদিয়েছে, পাকিস্তানিদের তাড়িয়েছে। বিগত ৪৫ বছর স্বাধীন বাংলাদেশেও বহু আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। কিন্তু যা লিখেছিল ব্রিটিশ, যা বহাল রেখেছে পাকিস্তান; বাংলাদেশেও সেটা বহাল থাকবে হুবহু? আমাদের দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা হলো, সরকারি বিভিন্ন ভুল ও অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনগণ হাজারো আবেদন-নিবেদন করে ব্যর্থ হয়ে যখন আন্দোলন-সংগ্রামের পথে নামতে বাধ্য হয়েছে, তখনি তাদের ওপর নেমে এসেছে ঔপনিবেশিক আমলের চাইতেও অনেক বেশি নির্মম নিপীড়ন। অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে নাগরিকদের সামান্য দাবি-দাওয়া অর্জনে।


বিদ্যুৎ কর্মকর্তাদের অসততার বিরুদ্ধে কানসাট, বিদেশি কোম্পানির স্বার্থে পরিবেশ ধ্বংস করে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফুলবাড়ী, বিমানবন্দর স্থাপনের নামে কৃষিজমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মুন্সীগঞ্জের জনগণ বিরাট-বিপুল আন্দোলন করেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা হলো_ জনগণের ব্যাপক জানমালের ক্ষয়ক্ষতি, প্রশাসনের সঙ্গে জনগণের অকারণ বৈরিতা একটি ভয়াবহ মাত্রায় উপনীত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সরকার এসব ক্ষেত্রে আমলা-অফিসার ও স্বার্থান্ব্বেষী মহলের পক্ষ নিয়ে হয় জনগণের বিপক্ষে অবতীর্ণ হয়, অথবা নির্মম নীরবতা পালন করে। অথচ একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেখানে নাগরিকরাই রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার মালিক, যেখানে সরকার ও আমলাতন্ত্র নাগরিকদের নিযুক্ত প্রতিনিধি এবং চাকরিজীবীমাত্র, সেখানে তা হওয়ার সুযোগ থাকার কথা নয়।


বি এ এস এফ মনে করে, দেশের উন্নয়ন তো নাগরিকদের জন্যই। সেখানে ভুক্তভোগী নাগরিকরা যখন ন্যায্য কোনো দাবি তোলেন, আন্দোলন করেন; আইন, সত্য ও কল্যাণের পক্ষে দাঁড়ান তখন তাতে কর্ণপাত করা হবে না কেন? অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আগেই চা শ্রমিক-জনতার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির শান্তিপূর্ণ, ন্যায্য, মানবিক ও টেকসই সমাধান করবে; নাকি আরেকটি ভয়াবহ বিপর্যয় ও দুর্যোগের পথে দীর্ঘদিনের অবহেলিত, লাঞ্ছিত, ভাগ্যহত চা শ্রমিকদের ঠেলে দেবে সেটা মালিক ও সরকারের পরবর্তী কর্মকাণ্ড দ্বারাই নির্ধারিত হবে।