বস্তুবাদি অর্থনীতির অপর্যাপ্ততা

বস্তুবাদি অর্থনীতির অপর্যাপ্ততা

১। বস্তুবাদি অর্থনীতির অপর্যাপ্ততা

[ ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবে ক্ষমতার মোহ । ইতিহাসের ধারনা ও বিজ্ঞান। বস্তুবাদের অর্থনৈতিক অপর্যাপ্ততা। বাস্তবতার আইন এবং “সামাজিক বাস্তবতা”। উৎপাদনের বাস্ততব অবস্থান। আলেকজান্ডারের অভিযান। ধর্ম যুদ্ব। পোপ তন্ত্র। উৎপাদনের বাধা হিসাবে ক্ষমতার অপব্যবহার। ভাগ্যবাদ “ঐতিহাসিক প্রয়োজনবাদ” এবং “ঐতিহাসিক মিশন” । অর্থনৈতিক অবস্থান এবং সামাজিক কার্যক্রমে বুর্জোয়াদের ভূমিকা। সমাজবাদ এবং সমাজবাদি। অঈতিহাসিক পরিবর্তন সমূহ। যুদ্ব ও অর্থনীতি। একত্ব ও কর্তৃত্ব। রাস্ট্র এবং পুজিবাদ।]

একটু গভীর ভাবে ইতিহাসের দিকে তাকালেই আমরা যুগে যুগে রাজনৈতিক প্রভাব সমুহ স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাব। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে আমরা দেখছি “ক্ষমতার মোহ” মানব ইতিহাসকে নাড়া দিয়ে এসেছে। মানুষের উন্নয়ন বা সামাজিক সংস্কারের চেয়ে ক্ষমতার লিপ্সাই প্রধান প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। সকল রাজনৈতিক ধারনা ও সামাজিক ঘটনা প্রবাহ অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও সামাজিক কাঠামো রাজনীতির মৌলিক নির্নায়ক হিসাবে ভূমিকা রেখেছে। মানব জাতির যাত্রা পথকে দিয়েছে দিক নির্দেশনা । কার্ল মার্ক্সের আরো অনেক আগে থেকেই অনেক বিষয়টিকে পর্যবেক্ষন করে আসছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ফ্রান্সের মহান চিন্তক সেইন্ট – সিমন, লুইস ব্ল্যাংক, এবং প্রুধু সহ অনেক লিখকই তাঁদের লিখায় বিষয়টির প্রতি সকলের দৃস্টি আকর্ষন করেছিলেন। সেই ক্ষেত্রে কার্ল মার্ক্স এই বিশ্লেষনের ধারায় সামাজিক ব্যাখ্য করতে গিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রস্তাবনা দুনিয়ার সামনে হাজির করেছিলেন। অধিকন্তু, তিনি সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অর্থনীতির প্রভাব নিয়ে ব্যাপক আলোকপাথ ও করেছিলেন।

এটা সত্য যে, মার্ক্সীয় চিন্তাধারায় ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ভাবে এই বিষয় গুলোকে চর্চার ক্ষেত্রে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। তবে মার্ক্সবাদের ভিত্তি হিসাবে উক্ত বিষয় গুলো কাজ করেছে। মার্ক্স দার্শনিক হেগেলের শিষ্য হিসাবে তার প্রভাব থেকে কোন সময়ই বেড়িয়ে আসতে পারেন নাই। মার্ক্সের উপর হেগেলের প্রভাব ছিলো ব্যাপক। তাই, তিনি নিজেকে  “নিরেট দর্শন” উদ্ভাবক হিসাবে “ঐতিহাসিক প্রয়োজন” এবং “ঐতিহাসিক মিশন” সৃজনে নিজেকে প্রতিস্টিত করতে পেরে ছিলেন। কেবল হেগেলিয়ান ভাবনার কারনেই মার্ক্স বিশ্বাস করতেন, সামাজিক আইন বস্তুগত অবস্থার ব্যাতিক্রম হতে পারেন না । তাঁদের চিন্তায় ছিলো, সমাজের প্রতিটি ঘটনাই বস্তুগত অবস্থার উপর ভিত্তিকরে সংঘটিত হয়ে থাকে। মার্ক্স এবং তার সকল উত্তরাধিকারীগণ “অর্থনৈতিক বস্তুবাদের” উপর ভিত্তিকরে তাঁদের সকল কর্ম কান্ড সাজিয়েছেন। তাঁরা কুপারনিকাস ও ক্যাপলারের  আবিস্কারের উপর ভিত্তিকরে এঙ্গেলস সহ অন্যান্য চিন্তাবিদ্গন ইতিহাস ও সাম্যবাদকে বিজ্ঞান হিসাবে অবিহিত করার প্রয়াস পেয়েছেন।

এই ধরনের চিন্তা ধারা আদতে গোঁড়াতেই গলদ থেকে গেছে। সামাজিক ঘটনা প্রবাহকে যান্ত্রিক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রকৃত সত্যকে আড়াল করা হয়েছে বা উপেক্ষিত হয়েছে। বিজ্ঞান একান্ত ভাবেই প্রাকৃতিক নিয়মের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত স্থান ও কালের উপর ভিত্তি করে গানিতিক সূত্রায়নের ভিত্তিতে মানুষের চিন্তার প্রতিফল ঘটায়। প্রাকৃতিক পরিবেশে একটি বিষয় অন্য আরো একটি বিষয় বা উপাদানের উপর সম্পূর্ন নির্ভরশীল, প্রাকৃতিক নিয়মে কারন এবং ফলাফল অঙ্গাঙ্গীভাবে  জড়িত হয়ে আছে। এই প্রাকৃতি রাজ্যে কোন দূর্ঘটনার সুযোগই নেই। বা চাপিয়ে দেবার মত কোন ব্যাপার গ্রহন যোগ্য নয়। তাই বিজ্ঞান প্রতিটি বিষয়ে অত্যন্ত কঠিন ও কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রন করে থাকে। কোন একটি বিষয় যতই পরিক্ষা নীরিক্ষা করা হোকনা কেন সেটা যদি অন্যান্য বিষয়ে সাথে সংগতি পূর্ন না হয় তবে তা বিজ্ঞানের জগতে গ্রহন  যোগ্যতা পেতে পারে না ।

অধিবিদ্যার জগতে এমন অনেক বিষয় আছে যা সামাজিক মানুষ সত্য বলে জানে, হয়ত তার উপযোগীতা ও আছে। কিন্তু বিজ্ঞানের জগতে এর এক পয়সার ও কোন মূল্য নেই। অন্যদিকে আমাদের প্রকৃতিতে প্রচুর বৈচিত্র দেখা যায়, প্রতিটি প্রাকৃতিক উপাদানের নিজস্ব নিয়ম নীতি রয়েছে। আবার মহাজাগতিক ক্ষেত্রে প্রতিটি গ্রহ উপ গ্রহ স্ব স্ব নিয়ম কঠোর ভাবে মেনে চলছে। অনেকটা পৃথিবীর বস্তুজগতের মত। এই সকল বিষয়ের উপর মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছার তেমন কোন প্রভাবই পরে না । প্রকৃতির এই সকল উপাদান সমূহ আমাদের জীবন জীবীকার সাথে গভীর ভাবে মিশে আছে। এদেরকে বাদ দিলে মানুষের অস্থিত্ব বিলিন হয়ে যাবে। আমরা জন্ম গ্রহন করি, পরিপুষ্ট হই, বেড়ে উঠি, খাদ্য গ্রহন করি আবার বর্জ ত্যাগ করি, চলা ফেরা করি – এক সময় মরে যাই। এই সকল কিছু কোন প্রকার পরিবর্তন করার সাধ্য আমাদের নেই। প্রায়স প্রয়োজন আমাদের ইচ্ছেকে পরিবর্তন করে দেয়। মানুষ তার দরকার মত প্রকৃতিকে কাজে লাগাবার জন্য চেস্টা করে, নিজের মত করে পরিচালনা করে নিজেদের চাহিদা মেটাতে প্রায়াস চালায়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফল হলে ও চূড়ান্ত ভাবে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে না। বরং তার সাথেই চলতে হয়। নইলে দেখা দেয় বিপর্যয়। আসল কথা হলো মানুষ প্রকৃতিকে থামিয়ে দিতে পারে না তবে তা থেকে কিছু ফায়দা হাসিল করতে পারে।  প্রকৃতির স্বভাবিকতার উপর আমাদের  অস্থিত্ব নির্ভশীল। আমরা কিছু সাধারন বিষয়ের সাথে নিজেদেরকে সমন্বয় করে নিতে পারি, কিন্তু কোন ভাবেই প্রাকৃতিক নিয়মকে অস্বীকার করে চলা সম্ভব নয়। প্রকৃতি আমাদের খাবারের জন্য যা যা দান করে এর বাহিরে আমাদের কিছু খাওয়ার সাধ্য নেই। প্রকৃতির নিয়মে আমরা ঘুমাই। খাদ্য ও ঘুম বাদ দিলে আমরা বেঁচেই থাকতে পারব না । এই সকল বিষয় চিন্তা করলে আমরা দেখি প্রকৃতির নিয়মের বাইরে যাবার ক্ষমতা মানুষের নেই ।

মহাজাগতিক বিষয়াদি ও বস্তুময় জগতের নিয়মাবলী বিশ্লেষন করলে দেখা যায় এমন কিছু চিরন্তন ও কঠোর বিধিবিধান প্রকৃতিতে বিরাজমান যা বৈজ্ঞানিক পদ্বতী অনুসরন করলে তার রহস্য উতঘাটন করা যায়। তা থেকে সামাজিক আইন কানুন বিনির্মান করা ও সহজ হয়ে উঠে। দুনিয়ায় বহু ঐতিহাসিক তত্ত্ব ভুল চিন্তার উপর তৈরী হয়েছে। যে সকল চিন্তাধায় প্রাকৃতিক বিধানাবলীকে উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে তা মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে নাই। অনেক ক্ষেত্রে তা মানুষের জন্য বিপদই ডেকে এনেছে।

আমরা ইতিহাসের সেই সকল উপাদান সমূহকে কখনোই অস্বীকার করিনা যা প্রকৃতির মাঝে বিদ্যমান আত্মিক সম্পর্ককে তোলে ধরেছে। ঘটনা প্রবাহের কারন ও ফলাফলের উপর আলোকপাত করেছে। তবে সামাজিক গতি প্রকৃতির ধারায় মানুষের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে প্রধান্য দেয়ার বিষয়টি সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষন কারে। আমরা প্রায়স লক্ষ্য করি আমরা আমাদের অবদানকেই বেশী গুরুত্ব দিয়েছি; ধর্মের ধারনা, নৈতিকতা, প্রথা, অভ্যাস ঐতিয্য, এবং আইনী বিষয়াদিকে আমরা সর্বদা উর্ধে তোলে ধারার চেস্টা করেছি। রাজনৈতিক সংগঠন, সম্পদের সংস্থা, উৎপাদনের কাঠামো ইত্যাদি আমাদের মন মগজকে পরিবেস্টন করে আছে । এই সকল বিষয়  সর্বত্র তেমন গুরুত্বপূর্ন না হলে ও তা বেশী আলোচিত হয়েছে। প্রতিটি ধারনা ও বিশ্বাস বৈজ্ঞানিক পরিসংখ্যান অনুসারে বিশ্লেষিত হবার দাবী রাখে। বস্তুময় জগতে গানিতিক সূত্রায়নের ভিত্তিতে সঠিকটা নিশ্চিত করা যত সহজ, অন্য দিকে ভাবের জগতে কেবল সম্ভাবনা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা ছাড়া কোন উপায় থাকে না ।

প্রাকৃতিক বস্তুজগতে যে প্রক্রিয়া চলেছে তাতে মানুষের কোন ভূমিকা নেই । তবে মানুষের সমাজের যে সকল লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয় তা মানুষের সীমিত সামর্থের উপর ভিত্তিকরেই নির্ধারিত হয়ে থাকে। ফলে এই লক্ষ্যমাত্রার সাথে প্রাকৃতিক প্রয়োজনের তেমন কোন সম্পর্ক থাকে না ।

এক জন ভারতীয় নারীর এটা ভাবার দরকার নেই যে তা্র নব জাতক শিশুর মাথার আকৃতি কেমন হবে বা কোন বিশেষ পরিষদ কিভাবে ঠিক করে দিবে। এই ধরনের বিষয় আষয় মানুষের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। এমন কি কেহ  বা কারো এক বিবাহ, বহু বিবাহ বা কৌমার্য গ্রহন করার ক্ষেত্রে ও তা সামাজিক বিশ্বাস ও প্রথার উপর ভিত্তি করে প্রচলন হয়ে থাকে । প্রতিটি আইনগত মতামত প্রধানত বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠে। মানুষ গুলো মুসলিম, হিন্দু, ইহুদি, খ্রিস্টান বা শতানের পূজক কি না তার উপর নির্ভর করে আইনী কাঠামো নির্ধারন করা হয়ে থাকে। মানুষ যে কোন অর্থনৈতিক সম্পর্কের মাঝে, যে রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভেতর বসবাস করতে পারে, নাগরিক হিসাবে আইনকে কোন প্রকার ক্ষতিগ্রস্থ না করে দিব্য জীবন যাপন করে যেতে পারে। হঠাত কোন মধ্যাকর্ষন শক্তির প্রভাবে সকল কিছু পরিবর্তন হয়ে যেথে পারে না । এমন  কি কোন কারন ছাড়া কোন মানুষ ও হঠাত মারা যেতে পারে না । মানুষ যদি মধ্যাকর্ষন শক্তি ব্যাখ্যা না জানে, বা হাম্মুরাবীর বিধি বিধান না জানে বা পিথাগোরিয়ান বিশ্লেষণ না বুঝেন সেই জন্য মানুষের শারিরিক কোন ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই।

আমরা এখানে কোন প্রকার স্বেচ্ছাচারী মতামত প্রকাশ করছি না, তা কেবলি একটি সত্য ঘটনাকে তোলে ধরার প্রয়াস নেয়া হয়েছে। মানব জীবনের মহান উদ্দেশ্যের উপর  ভিত্তি করে সামাজিক অস্থিত্বের বিষয় সমূহের উপর আলোকপাত  করা দরকার। সামাজিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যে সকল বিষয়দি উঠে আসে তাকে প্রয়োজন হিসাবে বিবেচনা করে গ্রহন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। নইলে ব্যাপক ভাবে মানুষ ভূলের বেড়াজালে জড়িয়ে পড়বে। ফলে ইতিহাসের গতি বুঝতে পারবে না মানব জাতি।

ইহিহাস অধ্যয়ন করতে গেলে যতেস্ট সন্দেহ থেকেই যায় যে ঐতিহাসিকগন ইতিহাসের ঘটনা প্রবাহকে পারস্পরিক সংযোগ স্থাপনের প্রয়াস চালায়নি। তাঁরা ভাসা ভাসা ভাবে ইতিহাসের আলোচনা করেছেন অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা  ইতিহাসের গতি প্রকৃতির সঠিক মূল্যায়ন করতে পারে নাই। একজন মহাকাশ বিজ্ঞানী খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বলে দিতে পারেন গ্রহ উপগ্রহের গতি প্রকৃতি । আমাদের প্লান্যাটের অস্থিত্ব নেপচুনের অবস্থান সঠিক ভাবে বলে দিতে সক্ষম। আর এই ধরনের বিষয় গুলো এক জন বিজ্ঞানীর নিকট তখনই সম্ভব যখন তা বস্তুগত বিষয়ের উপর জোর দেয়া হয়। সত্যিকার অর্থে মানুষের  মনন ও মানসিকতা যাচাই করার জন্য তেমন কোন মানদন্ড নেই। জাতি, উপজাতি, জাতীয়তা, এবং অন্যান্য সামাজিক সংঠন সমূহের সত্যিকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা কঠিন ব্যাপার। এমন কি তাঁদের অতীত নিয়ে যথাযত সিদ্বান্তে পৌছানো জটিল বিষয় । ইতিহাসের ক্ষেত্রে মানুষের জন্য ভবিষ্যৎ নির্ধারন করা কঠিন বিষয়। বাস্তবতা হলো, বিশ্বাসের বিষয় গুলো সম্ভাব্যতা নিয়েই কাজ করে; এটা বিশেষ কোন দিক নির্দেশ করে না  বা নিশ্চয়তা ও দেয় না ।


Share Tweet Send
0 Comments
Loading...
You've successfully subscribed to Bangladesh ASF
Great! Next, complete checkout for full access to Bangladesh ASF
Welcome back! You've successfully signed in
Success! Your account is fully activated, you now have access to all content.