ভালো নেই চুনারুঘাটের চা-শ্রমিকেরা
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার ৩ নং দেওরগাছ ইউনিয়নের চণ্ডিছড়া ভ্যালির ন্যাশনাল টি কোম্পানিতে কাজ করেন চা-শ্রমিক চামিলি কর্মকার। বিনিময়ে দিন মজুরি পান ১০২ টাকা। যা অন্য যেকোনো ধরণের শ্রমিকের চেয়ে অনেক কম। এই অল্প টাকায় চার সদস্যের পরিবার চলে চামিলির। এই অল্প টাকায় চাউল কিনলে তেল কিনতে পারেন না। এক বেলা ভাত জুটলে অন্যবেলা উপোস থাকতে হয়। সন্তানদের পড়াশোনার খরচ দিতে পারেন না। এমনটাই জানাচ্ছিলেন তিনি।
চামিলির মতই শত শত চা-শ্রমিক কাজ করেন হবিগঞ্জ সহ বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন চা বাগানে। আজও এই অল্প মজুরিতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন বাগানের শ্রমিকেরা। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি হলেও বাগানে কাজ করার সুযোগ পান মাত্র এক থেকে দুজন। বাকিদের বস্তি, ইটভাটা সহ অন্যান্য জায়গায় কাজ করতে হয়। এখন আবার মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে করোনা ভাইরাস। ইতোমধ্যে বাগানে হানা দিয়েছে এই ভাইরাস। করোনার কারনে বস্তিবাড়িতে কাজ করা চা শ্রমিকেরা বেকার হয়ে পড়েছেন। একদিকে করোনা ভাইরাস অন্যদিকে ক্ষুধা। কর্মহীন হয়ে পড়া এই চা শ্রমিকদের জীবন কাটছে আতংকে আর উৎকন্ঠায়।
জানা যায়, ২০০৭ সালে দৈনিক মজুরি ছিল ৩২ টাকা ৫০ পয়সা, ২০০৯ সালে সেটি হয় ৪৮ টাকা, ২০১৩ সালে ৬৯ টাকা, ২০১৮ সালে সেটি হয় ১০২ টাকা এবং বর্তমানে বহাল রয়েছে। এই অল্প টাকায় বাচ্চাদের লেখাপড়া, পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা, জীবনযাপন করতে হিসশিম খাচ্ছেন শ্রমিকেরা।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য মতে, সারাদেশে চা বাগান রয়েছে ১৬৭ টি। প্রতিটি বাগানের চিত্রই একই রকম। করোনার কারনে অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেও একদিনের জন্য বন্ধ হয়নি এ বাগান গুলো। চা-শ্রমিকদের পক্ষ থেকে সুরক্ষা প্রদান ও বাগানের কাজ বন্ধ রাখার দাবী জানানো হয় কয়েকটি বাগানে। কয়েকটি বাগানে অবস্থান ধর্মঘট পালন করা হয়। কিন্তু বাগানের সংশ্লিষ্টদের দাবি নিরাপদ দূরত্ব এবং করোনার কারনে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কাজ করছেন শ্রমিকেরা।
চণ্ডি বাগানের আরেক বাসিন্দা লক্ষিন্দর কর্মকার। বাগানে তালিকাভূক্ত শ্রমিক না হওয়ায় কাজ করেন বস্তিবাড়িতে। করোনাভাইরাসের এই পরিস্থিতির কারনে বর্তমানে তার কাজকর্ম বন্ধ রয়েছে। তিনি বলেন, 'বাগানের শ্রমিকদের তালিকায় আমি নেই। সেজন্য আমি বস্তিবাড়িতে কাজ করি। কিন্তু করোনার কারনে নিয়মিত কাজ পাচ্ছিনা। বেশিরভাগ দিন কাজ না পেয়ে চলে আসতে হয়। এজন্য খুব অর্থাভাবে দিন যাচ্ছে। এইদিনগুলি উপোস থাকতে হয়। আবার কোনো দিন শুধু শাক ভাজি, কখনো পানি ভাত বা আটা রুটি খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ি।'
লক্ষিন্দরের মতো শতশত চা-শ্রমিক করোনা ভাইরাসের কারনে কর্মহীন অবস্থায় ঘরবন্দী হয়ে পড়েছেন। এই পরিস্থিতিতে বাগানের শ্রমিকেরা যতটুকু সাহায্য পেয়েছেন তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল বলে জানান তারা।
ন্যাশনাল টি কোম্পানির অবসর প্রাপ্ত অফিস চৌকিদার অরুন পাল সম্প্রতি অবসরে গেছেন। তিনি জানান, অবসর ভাতা হিসেবে বর্তমানে তিনি প্রতি সপ্তাহে মাত্র ১০০ টাকা পান। মাসে মাত্র ৪০০ টাকা। এই অল্প টাকায় অনেক কষ্টে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন বলে জানান তিনি। অবসর ভাতা যাতে বৃদ্ধি করা হয় সেজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সহ সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানান তিনি।
সাবেক ছাত্রনেতা ও দেওরগাছ ইউনিয়নের তরুণ সমাজসেবক রোমন ফরাজী বলেন, চা শ্রমিকরা এই করোনার সময় খুব কষ্টে রয়েছে কারন লকডাউনের কারনে তারা কাজে যেতে পারে না। যে কারনে তাদের রুজিরোজগার বন্ধ হয়ে আছে এতে করে তাদের দুইবেলা খেয়ে জীবনধারণ করা খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য বাংলাদেশ এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্ট ফেডারেশন- (বি এ এস এফ) দির্ঘদিন ধরে চা-শ্রমিকদের মজুরী ও অন্যান্য দাবী আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে । ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সম্পাদক বলেন, '২০০৯ সালে তৎকালীন শ্রমমন্ত্রী দৈনিক ১৫০ টাকা প্রস্তাব করেন। পরে ২০১৪ সালে সমাজকল্যাণমন্ত্রী ২০০ টাকা এবং গত (২০১৯-২০) অর্থ বছরের বাজেটের আলোচনায় জাতীয় সংসদ অধিবেশনে স্থানীয় সংসদ সদস্য চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৫০০ টাকা করার প্রস্তাব করেন। সেই প্রস্তাব বিবেচনায় আনতে সরকারের কাছে আমি দাবি জানাচ্ছি।'
করোনা ভাইরাসের কারনে কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমিকদের বিষয়ে তিনি বলেন, 'সত্যিই দুঃখজনক যে করোনার কারনে অধিকাংশ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। স্থানীয় ভাবে বাগানে কিছু ত্রাণ দেয়া হয়েছে। তবে সেটি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আমি সকলের কাছে অনুরোধ জানাই এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য।'