অসমতা বনাম সমাজতান্ত্রিক সমতা

অর্থনীতিতে সাম্য বজায় রাখা, অসমতা দূরকরার, শোষণ বন্দ্বকরা একটি পুরাতন আলোচ্য বিষয়। এর জন্য শ্রমিকদের মজুরী ও অসাম্যের অবসান করার ইস্যূ নানা ক্ষেত্রে আলোচিত হয়ে আসছে। সাম্যবাদকে সামনে রেখে সাম্যবাদিদের উদ্যোগের নানা কর্মসূচির ও অভাব নেই। তবে এই বিষয়ে কোন প্রকার চরম পন্থার সুযোগ নেই। সেই বিষয়ে মাওসেতুং কথা বলেছেন, তিনি বলেছিলেন ধনী  ও গরীবের অসাম্য এবং প্রথম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের বৈষম্য দূর করতেই হবে। সাম্যবাদ দাবী করে বিশ্ব সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থায় যেন সুসম বন্ঠনের নিয়ম যতটুকু সম্ভব মানা হয়।

কেহ কেহ এই কথা বলতে পারেন যে, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা তো সাম্যবাদি ব্যবস্থা নয়। বরং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সম্পদ সুসম ভাবে সঞ্চালিত হয় না, যারা বা যে সকল দেশ বেশী কাজ করে তাদের নিকট চলে যায়ঃ যারা কাজ করবে না তাঁরা খেতেও পাবে না। অনেকে শ্রম মূল্যের তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে বলেন, সাম্রাজ্যবাদ অসাম্য সৃজন করলে ও সেখানে কাজ না করে ও খেতে পায় মানুষ। যদি ও তা পর্যাপ্ত নয়। এই ধরনের বিতরন ব্যবস্থা উন্নয়ন শীলতার নীতির চলমান সমস্যাকে গুরুত্ব দেয় না । তবে অনুন্নত তৃতীয় বিশ্বের মানুষ সেই সুযোগের কোন প্রকার নাগালই পায় না । তৃতীয় বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের উপকার ভোগী নয়। বিশ্ব সমাজতন্ত্র কায়েম করতে গেলে সাম্রাজ্যবাদের উপকার ভোগীদের পাতের খাবারে টান পরতে পারে।

তৃতীয় বিশ্বের সকল দেশে তাদের “ শিল্প শ্রমিকগন” এখনও উৎপাদনে যুক্ত হতে পারেন নাই, তবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কি সেই সকল দেশের সকল সম্পদকে কাজে লাগাবার ব্যবস্থা করা হত না ? জনসংখ্যা তত্ত্ববিগনের মতে, ইতিহাসের এটা ই এমন একটি সময় যখন সব চেয়ে বেশী মানুষ শহরে ও নগরে বসবাস করছেন। গন সংগ্রামের উপযোগী এলাকা “ বিশ্ব পল্লী” তৃতীয় বিশ্বের বড় বড় শহরে ও নগরে বিদ্যমান আছে। বস্তীর মানুষের জীবনে এখনও স্থায়ীত্বশীল উৎপাদনের পরিবেশ তৈরী হয়নি। এখানে এখনও পুঁজিবাদী ধরনের উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক নৈরাজ্যকর অবস্থা বিরাজ করছে। তবে সামাজতন্ত্রের কথা পরিস্কার যে, সকলের জন্যই উৎপাদনের ব্যবস্থা হবে সকলেই তার প্রতিদান পাবেন। কেহই বেকার থাকবেন না ।

বিশ্ব অর্থনীতি হলো দুনিয়ার সকল স্থান থেকে জমা হওয়া একটি সম্মিলিত রূপ। যা একজন থেকে আরেক জনে  স্থানান্তরিত হয়েছে। যদি কেহ কোন জায়গায় বেশী পায় তা হলে কোথাও না কোথাও কেহ কম পাবেনই। এটাই বিশ্ব ব্যবস্থার অমিয় নিয়ম। এক জন বেশি পেলে অন্যজন কম পাবেন এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। সাম্রাজ্যবাদ দুনিয়ায় এমন একটি ব্যবস্থা সৃজন করেছে যেখানে তৃতীয় বিশ্ব কম পাবে আর প্রথম বিশ্ব বেশী পাবেই। নানা কথার মার প্যাচে সমতা ও ন্যায়ের বানী শোনালেও তা বাস্তবে কোন দিনই এই ব্যবস্থায় সম্ভব নয়। যখন কোন দেশকে তাঁরা শোষণ করতে চায়, তা স্বাভাবিক ভাবেই হয় তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশ বা অঞ্চল। তখন সেই অঞ্চলের বিপুল সংখ্যার মানুষকে শোষণ করে তার নির্যাস প্রথম বিশ্বে নিয়ে আসে।

এক নজরে অসমতা

সাম্রাজ্যবাদী দেশ সমূহ ও তৃতীয় বিশ্বের দেশের মাঝে আয় বৈষম্য এক বিরাট ও ব্যাপক আকার ধারন করে আছে। প্রথম বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ কিছু পরগাছা ও সৃজন করেছে। পরগাছাবাদ এখন এক বিশাল রূপ ধারন করেছে। আগের তুলনায় এখন তা আরো পাঁচ গুন বৃদ্বি পেয়েছে। ১৯৯৭ সালে ছিলো ৭৪ জনে্র সমান ১জন, ১৯৯০ সালে ৬০ জনে্র সমান ১ জন, ১৯৬০ সালে ৩০ জনে্র সমান ১ জন সম্পদের মালিক। অর্থাৎ প্রথম বিশ্বের ১ জনের নিকট যে সম্পদ পুঞ্জিভূত আছে সেই হিসাবে তৃতীয় বিশ্বের ৭৪ জনের নিকট সেই পরিমান সম্পদ আছে। এটা একটা সাধারন গড় হিসাব মাত্র।

এখন সারা বিশ্বে যে পরিমান বার্ষিক আয় হয় তার  মালিক হয় মাত্র ২০% মানুষ। যার পরিমান দাড়ায় দুনিয়ার মোট সম্পদের ৮৫% । কিন্তু অন্য হিসাবে দেখলে দেখা যায় মাত্র ২% মানুষ পৃথীবীর ৫০% এর ও বেশী সম্পদের মালিক বনে আছে। কেবল প্রথম বিশ্বের ২% মানুষ ৩৫% সম্পদের মালিক হয়ে আছেন। পক্ষান্তরে, ৮০% মানুষ কেবল মাত্র ১৫% সম্পদের মালিকানায় আছেন। এই চিত্র সম্পদের উপর প্রথম বিশ্বের একক আধিপত্য স্পস্ট করে দেয়। ১৯৯৮ সালের এক প্রতিবেদন বলছে, উন্নত বিশ্বের ২০% মানুষ ৮৬% বিশ্ব সম্পদ ভোগ করে থাকেন। ২০০২ সালের বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন এই পরগাছাবাদের অবাক করা চিত্র তুলে ধরেছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রায় ৫০ মিলিয়ন ইউরূপ ও উত্তর অ্যামেরিকার মানুষ যে আয় করে, তা দুনিয়ার দরিদ্র ২.৭ বিলিয়ন মানুষের আয়ের সমান।

“উন্নয়ন দশকের” পর উদারতাবাদ, অবকাঠামোগত সমন্বয়বাদ বাস্তবায়নের পর ওয়াশিংটন জরিপে দেখা যায়, তৃতীয় বিশ্বের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা প্রথম বিশ্বের তুলনায় ১৫% এর ও কম। বৈদেশিক মূদ্রায় তা রূপান্তর করলে দাড়ায় মাত্র ৫% এ।
পরগাছাবাদ সম্পদ উপভোগের ক্ষেত্রে ও লক্ষ্যনীয়। পৃথিবীর মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগ মানুষ উচ্চ আয়ের দেশে বসবাস করে ও উপভোগের সুযোগ লাভ করেঃ

বিশ্বের  মোট উৎপাদনের ৮৬% এর মধ্যে নিচের তলার পাঁচ ভাগ মানুষ মাত্র ১% অর্জন করেন
বিশ্বের রপ্তানি মূলক বাণিজ্যের সুবিধার ৮২% এর মধ্যে নিচু তলার পাঁচ ভাগ মানুষ মাত্র পায় ১%
বিদেশী বিনিয়োগের মুনাফার ৬৮% এর মধ্যে নিচু তলার পাঁচ ভাগ মানুষ মাত্র পেয়ে থাকে ১%
টেলিফোন সুবিধার ৭৪% এর মধ্যে মাত্র ১.৫% পেয়ে থাকে নিচুতলার পাঁচ ভাগ মানুষ
ইন্টারনেট ব্যবহার কারী ৯৩.৩% এর মধ্যে নিচু তলার মানুষ ব্যবহার করে মাত্র ০.২%
কাগজের ব্যভারের ক্ষেত্রে ৮৪% এর মধ্যে নিচু তলার পাঁচ ভাগ মানুষ ব্যবহার করেন  মাত্র ১.১%
গাড়ী ব্যবহারের ক্ষেত্রে ৮৭% এর মধ্যে মাত্র নিচুতলার মানুষ ব্যবহার করেন ১% এর ও কম
জ্বালানী ব্যবহারের ক্ষেত্রে ৫৮% এর মধ্যে নিচু তলার পাঁচ ভাগ মানুষ ব্যবহার করেন ৪% মাত্র।

১৯৯০ সালের তথ্য মতে, বিশ্বের যে পরিমান প্রবৃদ্বি অর্জন করা হয়েছে এর মধ্যে  বিশ্বের উচ্চ পর্যায়ের উপার্জন কারী ১০%  এর মাঝে নানা ভাবে তা বিতরন করা হয়েছে। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০১ সালের মধ্যে উপভোগের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তা ৫০ – ৬০% উন্নত দুনিয়া ভোগ করেছে। যাদের বার্ষিক মাতা পিছু আয় ১০,০০০ ডলারের উপরে, ১৯৯৩ সালের হিসাবের এদের সংখ্যা বিশ্বে মাত্র মোট জন সংখ্যার ১০%। আর  ১০% যাদের ৪/৫ ভাগই বাস করে লাতিন আমেরিকায়। বাকী ৪০-৫০% উপভোগকারী যাদের মাথা পিছু আয় ৩০০০-৬০০০ ডলার। এরা মধ্যবিত্ত। বাস করে চীনের মত দেশে। তবে সব চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন যাদের মাথা পিছু আয় বার্ষিক ১০০০ ডলার। এরা নিম্ন বিত্ত। বাস করে চীন, দক্ষিন এশিয়া ও আফ্রিকায়।

বিশ্বসাম্য ব্যবস্থা কায়েম হলে বর্তমান প্রথম বিশ্বের শ্রমিকরা বিশ্ব সম্পদের অংশ থেকে তেমন কিছুই অর্জন করতে পারবেন না । সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করা হলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা কোন ভাবেই এড়ানো সম্ভব নয়। যেমন – বর্তমানে প্রথম বিশ্বের শ্রমিকদের উচ্চ আয়, সম্পদ, ও নানা উপভোগের সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি তাঁরা পেয়ে থাকেন। তাই, স্বাভাবিক ভাবেই  প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তন হোক, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতি প্রথম বিশ্বের শ্রমিকদের আগ্রহ কম থাকবে। তাঁরা সাম্যব্যবস্থা চাইবেন না ।

সংস্কারপন্থীরা এই বিষয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আশাবাদ ব্যাক্ত করে থাকে। তাঁরা তাদের আশাবাদের পিছনে কিছু যুক্তি ও হাজির করার প্রায়স পায়। তারা বিশ্ব বৈশ্বম্যের জন্য সম্পদের উৎপাদনের পার্থক্য, ধর্মীয় নৈতিকতা, ভাগ্যবাদিতা, সাদাদের অধিক যোগ্যতাবাদ ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করে থাকে। সাম্রাজ্যবাদিরা ও প্রথম বিশ্ববাদি চক্র যে সকল যুক্তি দেখায় তাদের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য রেখা টানা যায় না । তাদের মতে প্রথম বিশ্বের মানুষ বেশী পাবে বেশী খাবে এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। কার্ল মার্ক্স ও লেনিন ও এখন যদি এসে পরাগাছাবাদের বক্তব্য দেন তবু তাঁরা তা শোনবেন বলে মনে হয় না ।  বাস্তবতাই কথা বলে। তত্ত্বকে অবশ্যই বাস্তব সম্মত হতে হবে, ইহা বিজ্ঞান সম্মত ভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। আলোকিত সাম্যবাদ একটি উন্মোক্ত মানসিকতা নিয়ে সাধারন জনগণের দৃষ্টিভঙ্গিতে দুনিয়াকে দেখে থাকে। আমরা কি অন্ধের মত দুনিয়ার দিকে থাকাব, নাকি বাস্তববাদী মন ও মনন নিয়ে কাজ করব, আমরা কি সংস্কারবাদি হব নাকি আলোকিত সাম্যবাদি হয়ে উঠব। তা আমাদেরকেই ভেবে দেখতে হবে।