আলেকজান্ডার বার্কম্যানের জীবন ও কর্ম
মূল: পিটার ই. নিউয়েল / অনুবাদ: আসিফ আযহার
এনার্কিজমের প্রথম পাঠ বইটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৯ সালে। সে বছর বইটি প্রকাশ করেছিল নিউইয়র্কের ভ্যানগার্ড প্রেস। সাম্যবাদী এনার্কিজম কী নামে বইটি তখন প্রকাশিত হয়েছিল? এটি তিনটি অংশে বিভক্ত ছিল; যথা- বর্তমান, এনার্কিজম এবং সামাজিক বিপ্লব। ১৯৩৬ সালে এটি নিউইয়র্কে পুনরায় প্রকাশিত হয়। তখন এর নতুন নাম দেওয়া হয়েছিল বর্তমান এবং ভবিষ্যত: সাম্যবাদী এনার্কিজমের প্রথম পাঠ। বইটি এনার্কিজমের প্রথম পাঠ নামে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ব্রিটেনের ফ্রিডম প্রেস থেকে; প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে। তবে তখন প্রথম অংশ ছাড়াই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীতে বইটি পূর্ণাঙ্গ আকারে আরও চারবার প্রকাশিত হয়। বর্তমান সংস্করণটি হুবহু পূর্বের সংস্করণগুলোর মতোই, যদিও কিছু শব্দে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
এনার্কিজমের প্রথম পাঠ বইটি এখন একটি ঐতিহাসিক দলিল। জর্জ উডকক এ বইটিকে মুক্তিকামী সাহিত্যের একটি ছোটখাটো উপাদান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বইটির গুরুত্ব কেবল একারণেই বাড়েনি যে, এটি বার বার প্রকাশিত হয়েছে; বরং বইটির গুরুত্বের মূল কারণ হল এটি এখনও এনার্কিস্ট আদর্শ পরিচিতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ বই। সাম্যবাদী এনার্কিস্ট দৃষ্টিভঙ্গী থেকে রচিত ইংরেজি বইয়ের মধ্যে এটি অন্যতম। বইটির রচয়িতা আলেকজান্ডার বার্কম্যান কেবল একজন তাত্ত্বিক কিংবা বুদ্ধিজীবীই ছিলেন না; তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে একজন সংগ্রামী এনার্কিস্ট কর্মী হিসেবে।
আলেকজান্ডার বার্কম্যান ১৮৭০ সালের নভেম্বর মাসে তৎকালীন রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত উইলনোতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই অঞ্চলটি বর্তমানে (১৯৭৭ সাল) লিথুনিয়ান সোভিয়েত সোসালিস্ট রিপাবলিকের অন্তর্ভুক্ত। আলেকজান্ডার বার্কম্যান যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন তখন রাশিয়ায় প্রতিক্রিয়াশীলতার এক কালো যুগ চলছিল। অধিকন্তু সেখানকার জার বিরোধী এবং বিপ্লবী আন্দোলনেও পরিবর্তন আসছিল। খানদানী নিহিলিস্টরা, যারা এতদিন ধরে কেবল কৃষকদেরকেই আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে আসছিল তাদের ঘোর কাটতে শুরু করেছিল। ছোট ও বড় শহরগুলোতে ক্রমশ আন্দোলন দানা বাধছিল। ১৮৭০ এর দশকে জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদও মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠেছিল।
অসংখ্য শ্রমিক এবং কারিগররা যাদের অনেকেই ছিল ইহুদি, আন্দোলনে যোগ দেয়। ১৮৮০ এর দশকে রাশিয়ার জার এই উদীয়মান আন্দোলন দমনের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। হাজার হাজার বিপ্লবীদেরকে ফাঁসি দেওয়া হয় অথবা কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় কিংবা সাইবেরিয়ায় নির্বাসন দেওয়া হয়। তরুণ আলেকজান্ডার তখনকার এসব বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ এবং আদর্শ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত তাঁর চাচা ম্যাক্সিমের চেয়ে তিনি কোন অংশেই কম প্রভাবিত ছিলেন না। পনেরো বছর বয়সে বার্কম্যান একটি বিপ্লবী অধ্যয়নচক্রে যোগ দেন। বলাই বাহুল্য যে, সে সময়ে বিপ্লবী বই-পুস্তক অধ্যয়ন একটি রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কাজ ছিল।
এ অপরাধে বার্কম্যানকে স্কুল থেকে বহিস্কার করা হয় এবং কথিত ‘নেকড়ের পাসপোর্ট’ প্রদান করা হয়। এ পাসপোর্ট যাদেরকে দেওয়া হতো তারা কোন কাজে বা ব্যবসায় যুক্ত হতে পারত না। ষোল বছর বয়সে বার্কম্যান রাশিয়া ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৮৮৮ সালের প্রথমদিকে তিনি আমেরিকায় পৌঁছান। তবে অভিবাসীদের জন্য আমেরিকা দেশটি কোনভাবেই স্বর্গসম ছিল না। ১৮৮২ সালে জার্মান বিপ্লবী আন্দোলনের প্রবক্তা জোহান মোস্ট নিউ ইয়র্কে পৌঁছান। তিনি সেখানে পৌঁছার পর পরই সকল আমেরিকান শহরে ঘুরে ঘুরে বক্তব্য দিতে থাকেন। সেসব শহরে অ্যানার্কিস্ট এবং বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের অস্তিত্ব ছিল।
বিপ্লবী প্রচারকর্মের জন্য আমেরিকার সকল শহরের মধ্যে শিকাগো ছিল সবচেয়ে সম্ভাবনাময় শহর। ১৮৮৩ সালে শিকাগো শহরে কমপক্ষে ৩০০০ হাজার সক্রিয় অ্যানার্কিস্ট ছিলেন। জার্মান ভাষায় তাদের একটি দৈনিক পত্রিকা, দুটি সপ্তাহিক পত্রিকা; বোহেমিয়ান ভাষায় একটি সপ্তাহিক পত্রিকা এবং ইংরেজি ভাষায় একটি পাক্ষিক পত্রিকা চালু ছিল। ১৮৮৩ সালে একটি কেন্দ্রিয় শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৮৮৬ সালে সংগঠনটি শিকাগো শহরের শ্রমিকদের নিরঙ্কুশ সমর্থন লাভ করে। সে বছরের বসন্তে দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবীতে আন্দোলন শুরু হয় এবং মে মাসের শুরুতে প্রায় ৭০০০০ শ্রমিক ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে।
অনেক শ্রমিক তখন তাদের মালিক প্রতিষ্ঠানের হাতে আটকা পড়েছিল। ম্যাকক্রমিক হার্ভেস্টার ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠানটি আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত ছিল। এই প্রতিষ্ঠানটি তাদের শ্রমিকদেরকে তালাবদ্ধ করে রাখে এবং তাদেরকে দমনের জন্য শহরের গুন্ডা-পান্ডাদেরকে ভাঁড়া করে নিয়ে আসে ও ৩০০ পিনকার্টেন রাইফেলধারী রক্ষী নিয়োগ করে। আন্দোলনকারি শ্রমিকদের সমাবেশগুলো পুলিশের হাতে পণ্ড হতে থাকে। ৩ মে শিকাগোর পুলিশ সমাবেশকারিদের উদ্দেশ্যে গুলি ছুড়ে। গুলিতে কয়েকজন শ্রমিক নিহত হয়। পরের দিন এ ঘটনার প্রতিবাদে হে মার্কেট স্কয়্যারে একটি প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
সেদিন সমাবেশ চলাকালে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হওয়ায় লোকজন কিছুটা সরে গিয়েছিল। সে সুযোগে প্রায়২০০ পুলিশ স্কয়্যারের দিকে এগিয়ে যায়। সে মুহুর্তে পাশের রাস্তা থেকে পুলিশের উদ্দেশ্যে একটি বোমা নিক্ষেপ করা হয়। পুলিশ সমাবেশের উদ্দেশ্যে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে। পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে তারা নিজেরাও আহত হয়। সমাবশ থেকেও পুলিশের উদ্দেশ্যে কিছু গুলি আসতে থাকে। গুলাগুলিতে সাত পুলিশ এবং বিশ থেকে ত্রিশজন শ্রমিক নিহত হয়। এই ঘটনার পর শিকাগোর প্রচুর অ্যানার্কিস্টদেরকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পারসন ও স্পিয়েসসহ আটজন প্রধান বিপ্লবীর বিরুদ্ধে পুলিশ হত্যার অভিযোগ আনা হয়।
বিচারকদের কেউই এটি প্রমাণ করার চেষ্টা করেনি যে, আট নেতার কেউই পুলিশের উদ্দেশ্যে বোমাটি ছুঁড়ে নি। বিচারকদের মূল মনযোগ ছিল কেবল তাদের অ্যানার্কিস্ট আদর্শ এবং বিপ্লবী বিবৃতিগুলি উপরে। বিচারে সাত নেতাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয় এবং ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর এদের চারজনকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। বাকীদেরকে জেলে পাঠানো হয়। কয়েক বছর পর, মামলাটি পুনরায় তদন্ত করা হলে অভিযুক্ত অ্যানার্কিস্ট নেতাদের অপরাধের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। ফলে জীবিত নেতারা জেল থেকে মুক্তি পান। কিন্তু পারসন, স্পিয়েস এবং তাদের আরও দুজন কমরেড প্রহসনের বিচারের রায়ে রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন।
এর কয়েক মাস পরেই তরুণ বার্কম্যান আমেরিকায় পৌঁছান। জোহান মোস্টের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আলেকজান্ডার বার্কম্যান শীঘ্রই আমেরিকার বিপ্লবী অ্যানার্কিস্ট আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি প্রথমে যুক্ত হন ইডীশ ভাষাভাষী অ্যানার্কিস্ট দলের সাথে। এ দলটি মুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছিল। আরেকজন দৃঢ় মনের অ্যানার্কিস্ট এমা গোল্ডম্যানের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এমা গোল্ডম্যানও শিকাগো ট্র্যাজেডির পরপরই আমেরিকায় পৌঁছেছিলেন। একসময় তাদের মধ্যে ভালভাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু হোমস্টিড স্টিল কোম্পানির শ্রমিকদের ধর্মঘটের সময়ে বার্কম্যানকে কাজের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠতে হয়।
এমা গোল্ডম্যান সেই ভয়াবহ ঘটনাপ্রবাহের কথা তোলে ধরেছেন এভাবে: এটি ছিল ১৮৯২ সালের কথা! তখন হোমস্টিড স্টিল ধর্মঘট চলছিল। এটি ছিল পেনিসিলভানিয়ার স্টিল শ্রমিকদের জন্য এক জীবন-মরণ সংগ্রামের মুহুর্ত! তাদের সামন্ত কর্তা অ্যান্ড্রু কার্নেগির বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম একটি বড় আন্দোলনে নেমেছিল তারা। এ ঘটনায় স্টিল শিল্পে প্রচলিত দাসত্ব ও শোষণের বিরুদ্ধে সারা দেশ জেগে ওঠে। আলেকজান্ডার বার্কম্যান তাঁর প্রিজন মেমরিস বইয়ে এই মহান সংগ্রামের কথা অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় বর্ণনা করেছেন।
এর পাশাপাশি পিনকারটন খুনীদের নৃশংসতার কথাও তোলে ধরেছেন। পিনকারটন খুনীরা ছিল তৎকালীন আমেরিকান ধনতন্ত্রের পোষা গোয়েন্দা দল। এরা পেনিসিলভানিয়ার এগারো জন ধর্মঘটকারিকে হত্যাকরেছিল; এর মধ্যে দশ বছর বয়সী একজন শিশুও ছিল। এই অপকর্মের জন্য দায়ী ছিল কার্নেগির ব্যবসায়িক অংশীদার ও প্রতিনিধি হেনরি সি ফ্রিক। ধর্মঘটকারিদের প্রতি হেনরির পাশবিক মনোভাব এমনই ভয়াবহ ছিল যে, সে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিল- ধর্মঘটকারিদের একটি দাবীও মেনে নেওয়ার চেয়ে সে বরং প্রতিটি ধর্মঘটকারির মৃত্যু মেনে নিতে ইচ্ছুক।
তাঁর এহেন মনোভাবের ফলেই ১৮৯২ সালের ৬ জুলাই ১১ জন নিরস্ত্র শ্রমিককে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা আমেরিকাজুড়ে ক্রোধের সঞ্চার করে। এমনকি রক্ষণশীল পত্র-পত্রিকাও তীব্রভাবে ফ্রিকের নিন্দা করে।আমেরিকাজুড়ে চলতে থাকা প্রতিবাদ সমাবেশগুলোতে শ্রমিকরা তাদের জ্বালাময়ী অনুভূতির উদগীরণ ঘটায়। কিন্তু মাত্র একজন মানুষই ক্রোধকে কাজে পরিণত করল। তিনি হলেন আলেকজান্ডার বার্কম্যান। ১৮৯২ সালের ২২ জুলাই তিনি হেনরি সি ফ্রিকের অফিসে পিস্তল নিয়ে প্রবেশ করেন।
এরপর খুনীর দিকে তাক করা তাঁর পিস্তল ঝলসে ওঠে। ফ্রিকের শরীরে তিনটি বুলেট বিদ্ধ হলেও সে বেঁচে যায়। বার্কম্যানকে ২২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়; যদিও পেনিসিলভানিয়ার আইনে তাঁর এ কাজের জন্য ৭ বছরের কারাদণ্ড হওয়ার কথা! কমরেড বার্কম্যানকে এ কঠোর সাজা দেওয়ার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর কারণ হল, তিনি আমেরিকান ধনতন্ত্রের হৃৎপিণ্ডে আঘাত করার সাহস দেখিয়েছিলেন।
এমা গোল্ডম্যান অবশ্য এটি উল্লেখ করেননি যে, খুনী ফ্রিককে খতমের পরিকল্পনায় তিনিও বার্কমেনের সহযোগী ছিলেন। আলেকজান্ডার বার্কম্যান মোট ১৪ বছর পেনিসিলভানিয়ার জেলে ছিলেন; এর মধ্যে এক বছরের বেশী সময় তাকে নির্জন কারাবাসে রাখা হয়েছিল। রিচার্ড ড্রিনন বলেছেন, তাঁর সংকল্প ভাঙ্গার জন্য রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের চাপাচাপি প্রতিহত করেও তিনি কম বীরত্বের পরিচয় দেননি। জেল থেকে মুক্তির পর বার্কম্যান তাঁর বিখ্যাত বই প্রিজন মেমরিজ অভ অ্যান অ্যানার্কিস্ট রচনার কাজ শুরু করেন।
তিনি আবারও নিজেকে বিপ্লবী সংগ্রামের কাজে নিয়োজিত করেন। তিনি বক্তব্য প্রদানের জন্য ঘুরে বেড়াতে থাকেন এবং নিউইয়র্কের ফ্রি ফেরার স্কুল প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেন। তিনি এ স্কুলটির প্রথমদিকের শিক্ষকদের একজন ছিলেন। একসময় বার্কম্যান এমা গোল্ডম্যানের সাথে সম্পাদনার কাজে যোগ দেন। এনার্কিস্ট মাসিক সাময়িকী মাদার আর্থ সম্পাদনায় তিনি এমা গোল্ডম্যানের সহযোগী হয়েছিলেন। ১৯১৪ সালে সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সে সময় বার্কম্যান আমেরিকায় একটি যুদ্ধবিরোধী প্রচারণা কার্যক্রম শুরু করেন।
এই প্রচারণা শীঘ্রই আমেরিকা মহাদেশজুড়ে বিস্তৃতি লাভ করে। এমা গোল্ডম্যানকে সাথে নিয়ে তিনি নো কনস্ক্রিপশন লীগ প্রতিষ্ঠা করেন (কনস্ক্রিপশন মানে হল, বাধ্যতামূলকভাবে সৈন্যদলে নিয়োগ)। ১৯১৫ সালে তিনি সান ফ্রান্সিসকোতে চলে যান। সেখানে তিনি ব্লাস্ট নামে একটি অ্যানার্কিস্ট পত্রিকা চালু করেন, যা ১৯১৬ সালের জুলাই পর্যন্ত টিকেছিল। ইউরোপে বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হলে কিছু আদর্শত্যাগী সমাজতন্ত্রী ও অ্যানার্কিস্ট বুদ্ধিজীবীরা বিশ্বযুদ্ধ বাধানোর জন্য জার্মানিকে দোষারোপ করতে থাকেন এবং আঁতাত জোটকে সমর্থন করতে শুরু করেন।
কিন্তু অধিকাংশ অ্যানার্কিস্টরাই তাদের আন্তর্জাতিকতাবাদী এবং যুদ্ধবিরোধী নীতিতে অটল থাকেন। এদের মধ্যে গোল্ডম্যান, মেলাতিস্তা, ফ্যুরে, রকার এবং বার্কম্যান ছিলেন উল্লেখযোগ্য। বার্কম্যান এই যুদ্ধকে একটি পুঁজিবাদী লড়াই হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, মুনাফা-বাণিজ্য পথ ও ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে সংঘটিত এই যুদ্ধে জনগণকে কামানের খোরাক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। যাই হোক, ১৯১৬ সালে আমেরিকা এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং আমেরিকান সৈন্যদের একটি প্রস্তুতি মহড়ায় বোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনার জন্য অ্যানার্কিস্ট বিপ্লবী মোনেই এবং বিলিংসকে অভিযুক্ত করা হয়। এ পরিস্থিতিতে অতি দেশপ্রেমিক ‘সমাজতন্ত্রীরা’ সকল কর্মসূচি থেকে হাত গুটিয়ে নেয় এবং অভিযুক্তদেরকে তাদের ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেয়। কিন্তু অ্যানার্কিস্টরা হাত গুটিয়ে বসে রইল না। মোনেই এবং বিলিংসকে বাঁচানোর জন্য বার্কম্যান সারা দেশে সমাবেশ করতে থাকেন। কিন্তু তিনি তেমন সুবিধা করতে পারলেন না। যুদ্ধ এবং বাধ্যতামূলক সৈন্যদলে ভর্তির বিরুদ্ধে বার্কম্যানের প্রচারাভিযান একসময় রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর কার্যক্রমকে যথেষ্ট বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এর ফলে বার্কম্যান এবং গোল্ডম্যানকে একটি উচিত শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯১৭ সালে নো কনস্ক্রিপশন লীগের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন শুরু হয়। আলেকজান্ডার বার্কম্যান, এমা গোল্ডম্যান এবং আরও অনেক অ্যানার্কিস্ট নেতৃবৃন্দকে নিউইয়র্ক শহরে গ্রেফতার করা হয়। আলেকজান্ডার বার্কম্যান এবং এমা গোল্ডম্যানকে দুই বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। তাদের ওপর ১০০০০ ডলার জরিমানাও করা হয়। একই সময়ে ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকো কর্তৃপক্ষ বার্কম্যানকে যুদ্ধ প্রস্তুতি মহড়ায় বোমা নিক্ষেপের ঘটনায় সহায়তার অভিযোগে অভিযুক্ত করে।
নিউ ইয়র্ক কর্তৃপক্ষ তাকে সান ফ্রান্সিসকো কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের ইচ্ছা পোষণ করে। কিন্তু নিউ ইয়র্ক কর্তৃপক্ষ এবং ওয়াশিংটনের ফেডারেল সরকারকে অন্য বিষয়েও ভাবতে হয়। বার্কম্যানকে ক্যালিফোর্নিয়ায় হস্তান্তরের পরিকল্পনা রুখতে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষ থেকে নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের গভর্নরের কাছে অনেকগুলো প্রতিনিধিদল পাঠানো হয়। তবে এর চেয়েও গুরুতর হয়ে দেখা দিয়েছিল বহির্বিশ্বের অ্যানার্কিস্টদের প্রতিক্রিয়া। পেত্রোগ্রাদের অ্যানার্কিস্ট শ্রমিকরা এবং ক্রনস্ট্যাডের নাবিকরা বার্কম্যানের পক্ষে বড় ধরণের বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
এতে রাশিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশংকা দেখা দেয়। ফলে আমেরিকান সরকার ভয় পেয়ে যায় এবং বার্কম্যানকে ক্যালিফোর্নিয়ায় হস্তান্তরের পরিকল্পনা থেকে তারা পিঁছু হটে আসে। বার্কম্যান তাঁর দুই বছরের কারাবাস সম্পন্ন করেন জর্জিয়ার আটলান্টা জেলে। এর মধ্যে সাত মাস কেটেছিল নির্জন কারাবাসে। এরপরও বার্কম্যান কুখ্যাত জে এডগার হুভারকে বলিষ্ঠ ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, আমেরিকার আইন যা-ই বলুক না কেন তিনি তাঁর বিবেকের নির্দেশনা মতোই চলতে ইচ্ছুক।
জেল থেকে ছেড়ে দেওয়ার পর আলেকজান্ডার বার্কম্যান এবং এমা গোল্ডম্যানকে দেশান্তরিত করা হয়। ১৯১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে তারা রাশিয়ায় পৌঁছান। সেখানে তারা বীরোচিত সংবর্ধনা লাভ করেন। কিন্তু তারা অবাক হয়ে দেখলেন যে, নবগঠিত ‘সোভিয়েত’ রাশিয়ায় অনেক কিছুই অন্যপথে চলতে শুরু করেছে। ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে রাশিয়ায় বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। তখন বিদ্রোহ দমনের জন্য শ্রমিক এবং কৃষকদের বিরুদ্ধে যেসব সৈন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল সেসব সৈন্যরা শ্রমিক এবং কৃষকদের পক্ষেই চলে গিয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিয়োজিত রুশ সেনাবাহিনীর ফ্রন্টলাইনে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছিল। লক্ষ লক্ষ সৈন্য সেনাবাহিনী ছেড়ে বাড়ীর পথ ধরেছিল। গ্রীষ্মকালীন সময়ে শ্রমিকরা তাদের কারখানাগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে তোলে নিয়েছিল। কৃষকরাও জমিদার-জোতদারদের কাছ থেকে জমির নিয়ন্ত্রণ কেঁড়ে নিয়েছিল। বিপ্লবের পটভূমিতে পর পর দুটি উদারনৈতিক শ্রমিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়; প্রথমে গঠিত হয়েছিল প্রিন্স লেভভের সরকার; এরপর গঠিত হয় আলেকজান্ডার কেরনস্কির সরকার। কিন্তু দুটি সরকারই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চেয়েছিল। অক্টোবর মাসে কেরনস্কি সরকারের জনপ্রিয়তা পুরোপুরিভাবে হ্রাস পায়।
এর ওপর আবার বলশেভিকরা (১৯১৮ সালের পর থেকে এরা নিজেদেরকে কমিউনিস্ট হিসেবে অভিহিত করে) কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সোভিয়েতের নিয়ন্ত্রণ দখল করে নেয়। এর মধ্যে পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত ছিল অন্যতম। ২৫ অক্টোবর (নতুন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৭ নভেম্বর) তারিখে বলশেভিক নিয়ন্ত্রিত পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের বিপ্লবী কমিটির নেতৃত্বে রাজধানী শহরে এক ক্যু দেতা বা সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এর পরবর্তীতে মস্কো এবং অন্যান্য শহরেও অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। বলশেভিকরা জনপ্রতিনিধিদের একটি কাউন্সিল (কাউন্সিল অভ পিপল’স কমিশার) প্রতিষ্ঠা করে। তারা রাতারাতি একটি নতুন ‘সরকারে’ পরিণত হয়!
রাশিয়ার অ্যানার্কিস্টরা প্রথম বিপ্লব অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। এ বিপ্লব কিছুটা মুক্তিও এনে দিয়েছিল। অ্যানার্কিস্টরা কৃষকদের হাতে জমির নিয়ন্ত্রণ তোলে নেওয়ার ক্ষেত্রে এবং শ্রমিকদের হাতে কারখানার নিয়ন্ত্রণ তোলে নেওয়ার ক্ষেত্রেও সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল। মস্কো অ্যানার্কিস্ট ফেডারেশনের সদস্যরা অক্টোবরের বিদ্রোহেও অংশ নিয়েছিল। কিন্ত বলশেভিকরা যখন ‘সরকার’ গঠন করে বসল তখন থেকে অ্যানার্কিস্টরা আর তাদেরকে সমর্থনের কোন উপায় খুঁজে পেল না।
অ্যানার্কিস্ট এবং বলশেভিকদের পারস্পরিক সম্পর্কে শীঘ্রই টানাপোড়েন দেখা দেয়। কয়েকমাসের মধ্যেই অ্যানার্কিস্ট এবং সামাজিক বিপ্লববাদীদেরকে ধরপাকড় করা শুরু হয়। এদের অনেকেই ‘গোপন’ কমিউনিস্ট পুলিশ চেকার হাতে প্রাণ দিয়েছিলেন। ১৯১৮ সালে রাশিয়ার বলশেভিক সরকার এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কেন্দ্রিয় জোটের মধ্যে ব্রেস্ট-লিটভস্ক চুক্তি সম্পাদিত হলে বিশ্বযুদ্ধ থেকে রাশিয়ার আনুষ্ঠানিক বিদায় ঘটে। এর পরবর্তীতে রাশিয়ায় বিভিন্ন শ্বেত শক্তির হস্তক্ষেপ শুরু হলে কিছু অ্যানার্কিস্ট শর্তসাপেক্ষে বলশেভিক সরকারকে সমর্থন দিতে রাজী হয়।
এমনকি কিছু অ্যানার্কিস্ট বলশেভিকদের রেড আর্মিতেও যোগদান করেন। কিন্তু বলশেভিক এবং অ্যানার্কিস্টদের সম্পর্ক অবনতির দিকেই যেতে থাকে। সে সময় ইউক্রেনের অ্যানার্কিস্ট নেতা নেস্টর মাখনো এবং তাঁর পার্টিজান সেনাবাহিনীর সাথে বলশেভিকদের একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। ইউক্রেনের নেস্টর মাখনো এবং তাঁর পার্টিজান সেনাবাহিনী প্রথমে যুদ্ধ করেছিল সেখানকার অস্ট্রো-জার্মানদের সাথে, এরপর তাদের যুদ্ধ হয় ডেনিকিনের শ্বেত বাহিনীর সাথে; তাদের সাথে সম্পাদিত রেড আর্মির অত্যন্ত দূর্বল একটি চুক্তি ভেস্তে গেলে তাদেরকে বলশেভিকদের সাথেও যুদ্ধ করতে হয়।
বলশেভিকরা ক্ষমতায় বসার পর রাশিয়ার শিল্প ও কৃষি উৎপাদনে অচলাবস্থা দেখা দেয়। দূর্ভিক্ষে মারা যায় কয়েক মিলিয়ন মানুষ। আলেকজান্ডার বার্কম্যান এবং এমা গোল্ডম্যান রাশিয়ার এহেন পরিস্থিতিতেই সেখানে পৌঁছেছিলেন। যদিও বার্কম্যান তখন রাশিয়ার রাষ্ট্র ও সরকারের একজন প্রতিপক্ষ ছিলেন, রাশিয়ার পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার অভাবে তিনি বলশেভিকদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু যেসব অ্যানার্কিস্টরা রাশিয়ার বিপ্লবে অংশ নিয়েছিল এবং দু’বছর ধরে কমিউনিস্ট শাসনের অধীনে বাস করে আসছিল তারা রাশিয়ার প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকায় বলশেভিকদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল হতে পারে নি।
আলেকজান্ডার বার্কম্যান অনিবার্যভাবেই রাশিয়ার শ্বেত হস্তক্ষেপকারি শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে ছিলেন। তাই প্রথমে তিনি এবং এমা গোল্ডম্যান বলশেভিকদের সাথেই কাজ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা শীঘ্রই উপলব্ধি করলেন যে, এটি অসম্ভব! ১৯১৮ সালের এপ্রিল মাসে মস্কো ফেডারেশনের ওপর চেকার প্রথম আক্রমণের পর থেকে অ্যানার্কিস্টদের ওপর বলশেভিকদের অত্যাচার কেবলই বাড়ছিল। ১৯২০ সালের বসন্তকালে হাজার হাজার অ্যানার্কিস্ট, মেনশেভিক এবং সামাজিক বিপ্লববাদীদেরকে গ্রেফতার করা হয়। তাদেরকে হয় জেলে ভরা হয় অথবা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয় অথবা সাইবেরিয়ায় নির্বাসন দেওয়া হয়।
একই বছর বসন্তকালে অনুষ্ঠিত হয় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেস। সে কংগ্রেসে আলেকজান্ডার বার্কম্যান এবং এমা গোল্ডম্যান উভয়েই উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তারা অ্যানার্কিস্টদের ওপর চলমান অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। লেনিন তাদেরকে এটা বলে আশ্বস্থ করার চেষ্টা করেন যে, কোন অ্যানার্কিস্টই তার মতাদর্শের জন্য নিগৃহীত হবে না এবং যাদেরকে দমন করা হচ্ছে তারা মূলত ‘দস্যু’ এবং মাখনোর অনুসারী অ্যানার্কিস্ট বিদ্রোহী। কিন্তু অতি শীঘ্রই, ১৯২১ সালে চূড়ান্ত আঘাত এসে গেল।
ইতোপূর্বে বিভিন্ন শ্বেত বাহিনী যথা- কোলচাক বাহিনী, ডেনিকিন বাহিনী, রেঙ্গল বাহিনী এবং সকল শ্বেত হস্তক্ষেপকারি শক্তি একযোগে রেড আর্মির হাতে পরাজিত হয়েছিল। বলশেভিকরা পোল্যান্ডের সাথে যুদ্ধবিরতির ইতি ঘটিয়েছিল। জর্জিয়ার মেনশেভিক সরকারকে রেড আর্মির সাথে যুদ্ধে নামতে হয়েছিল। ১৯২০ সালে কয়েকটি কৃষক বিদ্রোহও সংঘটিত হয়েছিল। ১৯২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বলশেভিক সরকার ঘোষণা দেয় যে, অতি অল্প রুটির যে সরকারি রেশন চালু ছিল তা থেকেও তিন ভাগের এক ভাগ কেটে নেওয়া হবে।
এর ফলে স্মতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট পালিত হয় এবং মস্কো ও পেত্রগ্রাদ শহরে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। বলশেভিক সরকার পেত্রগ্রাদ শহরে বিপুল সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে ধর্মঘট পণ্ড করার চেষ্টা করে। শ্রমিকরা কাজে না গেলে রেশন দেওয়া হবে না- মর্মেও ঘোষণা দেওয়া হয়। ক্রনস্ট্যাডের নৌ-ঘাঁটিতে অবস্থানরত বাল্টিক ফ্লিটের নাবিকরা রাশিয়ার এ দৃশ্য দেখে কিছু করার কথা ভাবতে থাকে। ২৪ ফেব্রুয়ারি তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তারা স্বাধীন ও মুক্ত সোভিয়েতের দাবী তোলে এবং সকল শ্রমিক-কৃষক-অ্যানার্কিস্ট ও সামাজিক বিপ্লববাদীদের বাক স্বাধীনতা ও প্রচার স্বাধীনতার পুনঃপ্রবর্তনেরও দাবী জানায়।
কিন্তু বলশেভিক সরকার, বিশেষ করে ট্রটস্কি এবং জিনোভিয়েভ আক্রমণাত্মক ভূমিকায় নেমে গেলেন। তারা নৌ-ঘাঁটিতে বোমা বর্ষণ করে বিদ্রোহের জবাব দেন। বোমাবর্ষণের পর রেড আর্মি এবং চেকার কয়েকটি ইউনিট নৌ-ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। এমা গোল্ডম্যান, বার্কম্যান এবং আমেরিকাস্থ রুশ শ্রমিক ইউনিয়নের সেক্রেটারি পেরকুস মিলে নৌ-বিদ্রোহী এবং বলশেভিক সরকারের মধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা করেন। তারা প্রেসিডেন্ট জিনোভিয়েভের কাছে একটি মৈত্রীসূচক বিবৃতি পাঠিয়েছিলেন।
তারা লিখেছিলেন: বর্তমান পরিস্থিতিতে চুপ থাকা একটি অসম্ভব কাজ; এটি একটি অপরাধও বটে! সবেমাত্র যেসব ঘটনা ঘটেছে তা অ্যানার্কিস্ট হিসেবে আমাদেরকে মুখ খুলতে বাধ্য করছে; বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের কী মনোভাব নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিত তা নির্ধারণেও বাধ্য করছে। শ্রমিক এবং নাবিকদের মধ্যে অসন্তোষের পেছনে এমন কিছু কারণ রয়েছে যেসব বিষয়ে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নজর দেওয়া উচিত। শীত এবং ক্ষুধা অসন্তোষ বাড়িয়ে দিয়েছে।
কিন্তু আলোচনা এবং সমালোচনার ন্যূনতম সুযোগও না থাকায় শ্রমিক এবং নাবিকরা তাদের দুর্দশার কথা বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছে। এমতাবস্থায় শ্বেত শক্তিগুলো এই অসন্তোষকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইবে এবং তা তারা পারবেও। নাবিকদের পেছনে লুকিয়ে থেকে তারা সংবিধান-সভা, মুক্ত বাণিজ্য এবং এ ধরণের অন্যান্য বিষয়ের দাবী জানাচ্ছে। আমরা অ্যানার্কিস্টরা অনেক আগেই এসব বিষয়ের মৌলিক সমস্যাগুলো উদঘাটন করে দেখিয়েছি।
আমরা সবার সামনে এই মর্মে ঘোষণা করছি যে, আমরা যে কোন প্রতিবিপ্লবী প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়ে লড়াই করব; সকল সমাজবিপ্লবী বন্ধুদেরকে সাথে নিয়ে এমনকি বলশেভিকদের পক্ষে দাঁড়িয়েওপ্রতিবিপ্লবের বিরুদ্ধে লড়াই করব। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা এই অভিমত পোষণ করছি যে, সোভিয়েত সরকার এবং শ্রমিক-নাবিকদের মধ্যে চলমান সংঘাতের একটি মিটমাট হওয়া প্রয়োজন। অস্ত্র দিয়ে নয়, বরং বিপ্লবী কমরেডসুলভ চেতনায় একটি ভ্রাতৃপ্রতিম সন্ধির মধ্য দিয়ে এ সংঘাতের মিটমাট করা উচিত।
সোভিয়েত সরকারের জন্য বর্তমান পরিস্থিতিতে রক্তপাতের আশ্রয় নেওয়া উচিত হবে না; এতে শ্রমিকরা ভীতও হবে না, শান্তও হবে না। পক্ষান্তরে এহেন পদক্ষেপ সংকট আরও বাড়িয়ে তোলবে এবং প্রতিবিপ্লবীদেরকে আরও শক্তিশালী করবে। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, সরকার কর্তৃক শ্রমিক-কৃষকদের ওপর শক্তি প্রয়োগের ঘটনা আন্তর্জাতিক বিপ্লবী আন্দোলনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এটি সামাজিক বিপ্লবের জন্য অপরিমেয় ক্ষতিকর ফলাফল বয়ে আনবে।
বলশেভিক কমরেডগণ! এসব নিয়ে ভাবার সময় চলে গিয়েছে! আপনারা একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়ে ফেলেছেন। আমরা আপনাদের কাছে যেসব প্রস্তাবনা পেশ করতে চাই তা হল: অ্যানার্কিস্টদেরসহ পাঁচ সদস্যের একটি কমিশন গঠন করুন। এই কমিশন শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংঘাত নিরসনের জন্য ক্রনস্টাডে যাবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি হল সবচেয়ে মূলগত সমাধান। এ সমাধান আন্তর্জাতিক বিপ্লবী গুরুত্ব অর্জন করবে।
কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হল যে, বলশেভিকরা বার্কম্যানের দোহাই শুনল না। বার্কম্যান এবং এমা গোল্ডম্যানের পেছনের জীবনের দিকে তাকালে তাদেরকে অত্যন্ত সরল ও সহৃদয় মানুষ মনে হয়। কিন্তু লেনিন, ট্রটস্কি এবং জিনোভিয়েভ ছিলেন তুখোড় রাজনীতিবিদ; ক্ষমতা হারানোর কোন ইচ্ছা তাদের ছিল না। পক্ষান্তরে, ভিক্টর সার্জের ভাষায়- বার্কম্যান ছিলেন এমন একটি আদর্শবাদী প্রজন্মের প্রতিনিধি যারা রাশিয়া থেকে পুরোপুরিভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।
তিনি বলেন, বার্কম্যান তাঁর তরুণ বয়সের আদর্শপ্রসূত উত্তেজনা অভিব্যক্ত করেছিলেন কিন্তু উত্তেজনা প্রশমনের পর তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। মার্চ মাসের ৭ তারিখে পুরোমাত্রায় একটি আর্টিলারি যুদ্ধ চলছিল। এ প্রসঙ্গে বার্কম্যান তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন: গোলা বর্ষণের দিনগুলি ছিল বড়ই যন্ত্রণা ও দূঃখের! হতাশা আমার হৃদয়কে অসাড় করে দিয়েছিল; আমার ভেতরের কিছু একটা যেনো মারা গিয়েছিল। রাস্তার লোকজন দুঃখ ও বিমূঢ় বিস্ময়েরধাক্কায় আনত মস্তকে চলছিল। কথা বলার মতো আত্মবিশ্বাস কারও ছিল না। ভারী কামানের গর্জন বাতাসকে বিদীর্ণ করে দিচ্ছিল।
ক্রনস্ট্যাডের দমন অভিযান বার্কম্যানের আত্মবিশ্বাসকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। তাকে সেদিন পেত্রগ্রাদের রাস্তায় অসহায়ভাবে হাঁটাহাঁটি করতে দেখা গিয়েছিল। রুশ অ্যানার্কিস্টরা সোভিয়েত রাশিয়ার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন তথা সারা পৃথিবীকে সচেতন করার জন্য শেষবারের মতো চেষ্টা চালায়। আলেকজান্ডার বার্কম্যান এবং এমা গোল্ডম্যান কয়েকটি অ্যানার্কিস্ট সংগঠনের একটি বিবৃতিতে নিজেদের নাম যুক্ত করেন। লীগ অভ অ্যানার্কিস্ট প্রোপাগান্ডা, দি অ্যানার্কো-সিন্ডিকালিস্ট লীগ (গোলোস ত্রুদা) এবং রাশান কনফেডারেশন অভ অ্যানার্কো-সিন্ডিকালিস্টস প্রভৃতি সংগঠনের এ বিবৃতিটি অনেক জায়গায় পাঠানো হয়।
১৯২১ সালের জুলাই মাসে এ বিবৃতিটি পাঠানো হয় বলশেভিক নেতা লেনিনের কাছে। এছাড়াও কমিউনিস্ট পার্টি, কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল, রুশ ট্রেড ইউনিয়নসমূহের কেন্দ্রিয় কাউন্সিলসহ অন্যান্য সংগঠনের কাছেও বিবৃতিটি পাঠানো হয়। এই দীর্ঘ দলিলটিতে অ্যানার্কিস্টদের ওপর বলশেভিক সরকারের নির্যাতনের ফিরিস্তি তোলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু বিবৃতিটি কোন প্রভাব ফেলতে পারে নি।
আলেকজান্ডার বার্কম্যান তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন: কেটে যাওয়া দিনগুলি ছিল ধূসর ও নীরস। আশার সবক’টি আলোই একে একে নিভে যাচ্ছিল। অক্টোবরে জন্ম নেওয়া জীবনের বুকে থাবা গেঁড়েছিল এক সন্ত্রাস ও স্বৈরতন্ত্র। বিপ্লবের সকল বাণী হয়েছিল প্রত্যাখ্যাত। বিপ্লবী আদর্শের কণ্ঠরোধ করেছিল মানুষের রক্ত। বিগত দিনের প্রাণের কন্ঠে ঘোষিত হচ্ছিল মিলিয়ন মৃত্যুর রায়। সারা দেশের বুকে বিস্তার লাভ করেছিল সেই দিনগুলির কালো ছায়া। স্বৈরতন্ত্রের পাঁয়ের তলায় দলিত হয়েছিল অগণিত জনতা। নির্জন প্রান্তরে কেঁদে বেড়াচ্ছিল মৃত বিপ্লবের আত্মা। ......আমি রাশিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
ক্রনস্ট্যাডের বাল্টিক ফ্লিটের বিদ্রোহী নাবিকদেরকে ধ্বংস করে দেওয়ার পর ট্রটস্কি দম্ভভরে ঘোষণা করেছিলেন: শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত সরকার রাশিয়া থেকে সকল অ্যানার্কিজমকে ঝেঁটিয়ে বিদায়করতে সক্ষম হয়েছে! কমিউনিস্টরা আলেকজান্ডার বার্কম্যানকে রাশিয়া থেকে চলে যাওয়ার জন্য চাপ দেয়। ১৯২১-২২ সালে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত অ্যানার্কিস্ট কংগ্রেসে যোগদানের জন্য বার্কম্যান ও এমা গোল্ডম্যানকে দুটি পাসপোর্ট দেওয়া হয়।
কিন্তু জার্মান সরকার তাদের প্রবেশাধিকার প্রত্যাখ্যান করে। তবে সুইডিশ কর্তৃপক্ষ তাদেরকে তিন মাসের জন্য সুইডেনে প্রবেশের অনুমতি দেয়। এরপর বার্কম্যান অবৈধভাবে জার্মানিতে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি এক বা দুই বছর অবস্থান করেছিলেন। এ সময় তিনি রাশিয়া এবং ক্রনস্ট্যাড বিদ্রোহ নিয়ে কয়েকটি পুস্তিকা রচনা করেছিলেন। এরপর তিনি ফ্রান্স চলে যান। ফ্রান্সে অবস্থানরত সময়ে তিনি রাশিয়ায় বন্দী অ্যানার্কিস্ট এবং উদার সমাজতন্ত্রীদের সহায়তার জন্য বিভিন্ন কমিটি গঠনে ভূমিকা রেখেছিলেন।
এমা গোল্ডম্যানের মতো বার্কম্যানকে আমেরিকায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করা হয় নি। বার্কম্যান প্যারিসেই বাস করতে থাকেন। ১৯২৫ সালে তাঁর দ্য বলশেভিক মিথ (ডায়েরি ১৯২০-১৯২২) বইটি নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত হয়। এক পর্যায়ে তিনি অ্যানার্কিস্ট সংগঠনের ধরণ কেমন হবে তা নিয়ে পিটার আর্কিনভ ও নেস্টর মাখনোর সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। বার্কম্যান, গোল্ডম্যান, মাখনো এবং অন্যান্যদের মত আর্কিনভকেও প্রবাসে যেতে হয়েছিল। ১৯২২ সালে বার্লিন পৌঁছার পর তিনি রাশিয়ার প্রবাসী অ্যানার্কিস্ট-কমিউনিস্টদেরকে নিয়ে একটি দল গড়ে তোলেছিলেন যা তিন বছর পর প্যারিসে স্থানান্তরিত করা হয়।
আর্কিনভ রুশ অ্যানার্কিজমের পতনের ক্ষেত্রে এর নিত্য অবিন্যস্ত অবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন; ছত্রভঙ্গ অবস্থার ফলে রুশ অ্যানার্কিজম সুসংগঠিত কমিউনিস্টদের সামনে দাঁড়াতেই পারে নি। ১৯২৬ সালে আর্কিনভ তাঁর ‘সাংগঠনিক প্ল্যাটফর্ম’ প্রতিষ্ঠার পর বলেন যে, রুশ অ্যানার্কিজমের পুনরুজ্জীবনের একমাত্র সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে অ্যানার্কিস্টদের একটি সাধারণ ইউনিয়ন গঠনের মধ্যে; পলিসি এবং কর্মসূচির সমন্বয়ের জন্য এ সাধারণ ইউনিয়নের একটি শক্তিশালী কেন্দ্রিয় কমিটি থাকবে।
নেস্টর মাখনো আর্কিনভের এ মতামতকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। কিন্তু আলেকজান্ডার বার্কম্যান, এমা গোল্ডম্যান, ভলিন প্রমুখ অ্যানার্কিস্টরা এ মতামতের বিরোধীতা করেন। বার্কম্যান অভিযোগ করেন যে, আর্কিনভরা মূলত একটি অ্যানার্কিস্ট-কমিউনিস্ট ‘পার্টি’ গঠন করতে চাচ্ছেন। তিনি বলেন: আমাদের অধিকাংশ লোকের সমস্যা হল, তারা দেখতে পাবে না যে, বলশেভিক ‘পদ্ধতি’ মুক্তি আনতে পারছে না; আর্কিনভের যুক্তি এবং পদ্ধতিসমূহ সারমর্ম এবং কার্যকারিতার দিক থেকে বলশেভিকদের সমতুল্য।
এটি ছিল সেই সময়ের কথা যখন আলেকজান্ডার বার্কম্যান এবং এমা গোল্ডম্যান সন্ত্রাসবাদ এবং সংঘর্ষের ব্যাপারে ভিন্ন চিন্তা করছিলেন। ১৯২৮ সালের নভেম্বর মাসে বার্কম্যান এমা গোল্ডম্যানের কাছে লিখা এক চিঠিতে উল্লেখ করেন: আমি এখন আর ব্যাপকভাবে সন্ত্রাসবাদী সমর-কৌশলের পক্ষে নই; অবশ্য পরিস্থিতি খুবই অস্বাভাবিক হলে সেটি ভিন্ন কথা। এমা গোল্ডম্যান এ চিঠির জবাবে লিখেন: স্পর্শকাতর মানব মনের বহিঃপ্রকাশের ক্ষেত্রগুলো ছাড়া সহিংস কর্মকাণ্ডসমূহ চরমভাবে অনর্থক প্রমাণিত হয়েছে। ......আমি অনুভব করি যে, আঘাতের যে ধরণ আগে কখনও ছিল না এবং ভবিষ্যতেও সম্ভবত আর থাকবে না- কেবল সেটিই গঠনমূলক হতে পারে।
তবে এমা গোল্ডম্যান কিংবা বার্কম্যান কেউই পুরোপুরিভাবে হতাশাবাদী হয়ে পড়েননি। অ্যানার্কিজমের প্রথম পাঠ বইটিতে বার্কম্যান সংঘাত সম্পর্কে পুরো একটি অধ্যায় (অ্যানার্কিজম মানে কি সংঘাত?) রচনা করেছেন। শেষ অধ্যায়েও তিনি এ বিষয়েই ফিরে এসেছেন। এই অধ্যায়টির নাম ‘বিপ্লবের প্রতিরক্ষা’। ১৯২৯ সালে তিনি যখন ঐ অধ্যায়টির ওপর কাজ করছিলেন তখন এমাকে লিখা এক পত্রে বলেন, এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন আমার মনে হয় যে, অ্যানার্কিস্ট নীতিগুলো নিয়ে বোধহয় বিপ্লব করা যাবে না। কিন্তু বিপ্লবের ক্ষেত্রে পুরনো পদ্ধতিগুলো একবার অনুসরণ করা হয়ে গেলে ঐ বিপ্লব আর কোনভাবেই অ্যানার্কিজমের পথে যেতে পারে না।
বার্কম্যানের বয়স তখন ৬০ বছর; ইতোমধ্যে তিনি অসুস্থও হয়ে পড়েছেন। হতাশা তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল। ১৯৩৫ সালের আগস্টে পিয়েরে রেইমাসের কাছে লিখা এক পত্রে তাঁর হতাশা ফুঁটে উঠেছে এভাবে: পুরনো প্রহরীরা চলে যাচ্ছে এবং তাদের স্থানে বসার জন্য নতুন প্রজন্মের কেউ নেই। পৃথিবীতে একটি ভাল সময় এনে দেওয়ার জন্য যে কাজটুকু অবশ্যই প্রয়োজন, অন্ততপক্ষে সে কাজটুকু করার জন্যও কেউ নেই। ১৯৩৬ সালের প্রথমদিকে তাঁর শরীরে একটি গুরুতর অস্ত্রোপচার করা হয়; মার্চ মাসে করা হয় আরেকটি অস্ত্রোপচার। দুটি অস্ত্রোপচারই ব্যর্থ হয়েছিল।
এর ফলে তাঁর শরীরে পাকাপোক্তভাবে যন্ত্রণা বাসা বাঁধে। তীব্র ব্যাথায় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর নিশ্চয়তা নিয়ে তিনি হাসপাতাল ছাড়েন। ১৯৩৬ সালের ২৮ জুন তিনি নিজের রিভলবারের গুলিতে নিজেকে গুলিবিদ্ধ করেন। স্পেনের অ্যানার্কিস্ট বিপ্লবের বীর বুয়েনাভেনতুরা দুরুতির মৃত্যুর মাত্র তিন সপ্তাহ আগে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর স্পেনের স্বৈরশাসক ফ্রাংকোর ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সেখানকার অ্যানার্কিস্টরা এক ঐতিহাসিক বিপ্লবের সূচনা ঘটিয়েছিলেন। যদি তিনি আরও কয়েকটি দিন বেঁচে থাকতেন তাহলে নতুন প্রজন্ম নিয়ে তিনি আর হতাশ থাকতেন না।
আসলে পুরনোদের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য সবসময়ই একটি নতুন প্রজন্ম এগিয়ে আসবে। আলেকজান্ডার বার্কম্যান সম্পর্কে এমা গোল্ডম্যান লিখেছেন: যদি তিনি আর মাত্র ক’টি দিন বেঁচে থাকতেন! নির্বাসনের অনেকগুলো বছর, অবিশ্বাস্য অবমাননা, অস্বস্তিকর কর্মকর্তাদের নাগালের বাইরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার বাসনা এবং তাঁর গুরুতর অসুস্থতা- সবকিছু তাঁর জীবনকে অসহনীয় করে তোলেছিল। আলেকজান্ডার পরনির্ভরশীল হওয়াটাকে মেনে নিতে পারেননি। তিনি তাঁর প্রিয় মানুষদের জন্য বোঝা হতে চাননি। তাই দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি তাঁর শেষটাকে নিজের হাতেই ত্বরান্বিত করেছিলেন।
(আলেকজান্ডার বার্কম্যানের এই জীবনীটি লিখেছেন পিটার ই. নিউয়েল। জীবনীটি তিনি লিখেছিলেন ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে। ১৯৭১ সালে আলেকজান্ডার বার্কম্যানের একটি বিখ্যাত বইয়ের পুনর্মুদ্রণের সময় এই জীবনীটি জুড়ে দেওয়া হয়। বইটির নাম ‘অ্যানার্কিজমের অ আ ক খ’। প্রকাশক- ফ্রিডম প্রেস।
এ বইটি প্রথম রুশ ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৯ সালে। তখন বইটি এই নামে ছিল না। তখন ‘কমিউনিস্ট অ্যানার্কিজম কী’ নামে বইটি প্রকাশ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যানগার্ড প্রেস। ১৯৩৬ সালে বইটির নতুন রুশ সংস্করণ প্রকাশিত হয় নিউইয়র্ক থেকে। তখন এর নাম হয় ‘বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ: অ্যানার্কিজমের অ আ ক খ’।
১৯৪২ সালে বইটির প্রথম ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করে ফ্রিডম প্রেস। তখন এর নাম দেওয়া হয় ‘অ্যানার্কিজমের অ আ ক খ’। বইটির তৃতীয় ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। ১৯৭১ সালে এ সংস্করণেরই পুনর্মুদ্রণের সময় পিটার ই. নিউয়েল রচিত জীবনীটি জুড়ে দেওয়া হয়।
পিটার ই. নিউয়েল রচিত বার্কম্যানের জীবনী তথা বার্কম্যানের পুরো বইটি প্রথমবারের মতো বাংলায় অনুবাদ করছেন শাবিপ্রবি শিক্ষার্থী আসিফ আযহার। যথাসময়ে এই অনুবাদকর্মটি সম্পন্ন হলে ২০২০ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বইটি পাঠকের হাতে পৌঁছে যাবে বলে আশা রয়েছে।)